বিজ্ঞানের দৃশ্যপটে মুসলমানেরা আবির্ভূত হওয়ার আগ্মূহুর্ত পর্যন্ত প্রাচীন বিজ্ঞানের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে আগের পর্বে। এখানে মনে রাখা উচিৎ যে, বিজ্ঞানের উপর সে সময়ের কাজের একটা ক্ষুদ্র অংশই এখানে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। স্থানাভাব, মূল আলোচনায় প্রবেশের ব্যাগ্রতা ইত্যাকার নিয়ামকই এ কাজে বাধ্য করেছে। সামনের দিকে, আলোচনার খাতিরে কিংবা প্রাসঙ্গিকভাবেই হয়তো আরো অনেক গ্রীক-রোমান-মিশরীয় বিজ্ঞানীর নাম এসে যাবে। সেইসঙ্গে, আরো মনে রাখা উচিৎ যে, ঐ সময়ে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যত কাজই হোক না কেন, তা তখনো পর্যন্ত প্রাথমিক পাঠের চৌকাঠ অতিক্রম করতে পারে নি।
মুসলমানদের অবদান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার ঠিক পূর্বমূহুর্তে অর্থাৎ ষষ্ঠ শতকে আরবের অবস্থা একটু জেনে নিই, এবার। আরব উপদ্বীপ(جزيرة العرب; jazīrat al-ʻArab) হচ্ছে লোহিত সাগর(Red Sea), আরব সাগর(Arabian Sea) এবং পারস্য উপসাগর(Persian Gulf) দিয়ে পরিবেষ্টিত পৃথিবীর বৃহত্তম উপদ্বীপ(Peninsula)। খৃষ্টের জন্মের ৫০০০ বছর আগে থেকেই এখানে মানুষের বসবাস বলে জানা যায়। পরবর্তীতে ৩৫০০ অব্দের দিকে সিমাইট(Simite) জনগোষ্ঠির একটা অংশ মেসোপটেমিয়া হতে এ অঞ্চলে চলে আসে। সে সময় থেকে মরুময় এ বিশাল প্রান্তরে যাযাবর জীবন বেছে নেয় এর অধিবাসীরা। আরো ১৫০০ বছর পর ইব্রাহিম(আ) এবং ইসমাঈল(আ) কর্তৃক মক্কায় কাবা পুনর্নির্মানের পর এটি একটি ধর্মীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। এছাড়া, প্রাচ্য, পাশ্চাত্য এবং আফ্রিকা মহাদেশের মিলনস্থানে এবং বিশ্বের প্রধান বানিজ্য পথের উপরে অবস্থিত হওয়ায় এখানে কিছু ব্যবসায়ী দলের আনাগোনা পাওয়া যায়। এসবের বাইরে ষষ্ট শতকে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত আরবে বিজ্ঞানের বলার মত কোন কাজের দেখা আমরা পাই না। সত্যি কথা বলতে কী, এই কয়েক সহস্রাব্দব্যাপী সময়ে একজন বিখ্যাত মানুষও পাওয়া যায় না। কেবল খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে রোমান সম্রাজ্যের সম্রাট ফিলিপ(Philip the Arab; ২৪৪-২৪৯ খৃষ্টাব্দ) এর পূর্বপুরুষ আরবীয়(Arabian) এই পরিচয়টুকু দেয়া যেতে পারে। সন্দেহ নেই, কাব্যক্ষেত্রে ভাষাগত বুৎপত্তিতে আরবীয়রা অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। সেই সময়ের ইমরুল কায়েস(امرؤ القيس بن حجر بن الحارث الكندي) কিংবা খানসার(تماضر بنت عمرو بن الحرث بن الشريد السُلمية) মত কবিদের কবিতা আজো বিশ্বসাহিত্যের অমর সম্পদ। কিন্তু, এর বাইরে পুরো আরব জাতিই জ্ঞান-বিজ্ঞান আর সভ্যতা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছিল। ‘যে ব্যক্তি আমার গোত্রভুক্ত নয়, তাকে কেন আমি খুন করবো না? তার সম্পদ কেন আমি কেড়ে নেবো না?’ –এ কথা তাদের মাথায়ই ঢুকত না! পূর্বে পারস্যের সাসানীয় কিস্রা সম্রাট আর পশ্চিমে রোমান কাইজার সম্রাটেরা সেসময় জানা পৃথিবীর প্রতিটি ইঞ্চিতে নিজেদের দখলদারি প্রতিষ্ঠার জন্য একে অন্যের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। সে লোভী চোখগুলোও একপ্রকার অবজ্ঞায়-অবহেলায় আরবকে এড়িয়ে চলেছে। এমন একটা অবস্থাকে অন্ধকার ছাড়া আর কীবা বলা যেতে পারে।
ইসলামের আবির্ভাব পূর্ব আরব উপদ্বীপ
এমনি সময়েই, ৫৭০ খৃষ্টাব্দে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ(স) মক্কায় জন্ম নিলেন। ৪০ বছর বয়সে তিনি নিজের ধর্মমত প্রচারে ব্রতী হলেন এবং পরবর্তী ২৩ বছরের অবিশ্রান্ত পরিশ্রমে সমগ্র আরব উপদ্বীপকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে এলেন। তাঁর অবর্তমানে তাঁরই চার বিশ্বস্ত সহচরের পর্যায়ক্রমিক শাসনকালে(৬৩২-৬৬১ খৃষ্টাব্দ) মিশর, সিরিয়া ও পারস্য ইসলামের শাসনাধীনে আসে। এরপর উমাইয়া শাসনামলে (৬৬১-৭৫০ খৃষ্টাব্দ) উত্তর আফ্রিকা, স্পেন, তুর্কিস্থান এবং ভারতবর্ষের সিন্ধু মুসলমানদের সরাসরি কর্তৃত্বাধীনে চলে আসে। এরপরে শুরু হয় প্রায় সাড়ে সাতশ’ বছরের আব্বাসীয় শাসনামল(৭৫০-১৫১৭ খৃষ্টাব্দ)। বিজ্ঞানের জগতে মুসলমানদের সদর্প পদচারনা আমরা এ সময়েই দেখতে পাই। মুহাম্মাদ(স) থেকে আব্বাসীয় শাসনামল শুরু আগপর্যন্ত ঘটনাবহুল দেড়টি শতকে বিভিন্ন নিয়ামক এই পদচারণার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। সে আলোচনা(কিভাবে? এবং কেন?) পরের দিকের জন্য রেখে দিয়েছি বলে, এ পর্যায়ে কেবল বিজ্ঞানে অবদানের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করা হবে।
উমাইয়া খেলাফত পর্যন্ত মুসলমানদের অধিকৃত ভূমি
বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানদের সদম্ভ পদচারনা একটি ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা। এর মাঝে চিকিৎসাবিজ্ঞান(Medicine), রসায়ন(Chemistry), জ্যোতির্বিদ্যা(Astronomy), গণিত(Mathematics), পদার্থবিজ্ঞান(Physics), দর্শন(Philosophy), ভূগোল(Geography), স্থাপত্যবিদ্যা(Architecture) এবং হস্তলিখনবিদ্যায়(Calligraphy) তাঁদের অবদানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনই অবকাশ নেই। এর বাইরেও আইনশাস্ত্র(Law), ইতিহাস(History), সমাজবিজ্ঞান(Sociology), রাষ্ট্রবিজ্ঞান(Political Science), সমরবিজ্ঞান(Military Science) এবং প্রত্নতত্ত্বে(Archeology) মুসলমানদের মৌলিক কিছু অবদান রয়েছে। এখানে, বিস্তারিত না বলে কেবলমাত্র বিষয়ভিত্তিক মূল অবদানগুলো তৎসংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের কাজ সহকারে তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে। অবশ্য এক্ষেত্রেও একটা সমস্যা তৈরী হয়। কিছু কিছু বিজ্ঞানীর অবদান এত বহুমুখী, এত বেশী ক্ষেত্রে তাঁদের মৌলিক কাজসমূহ বিস্তৃত যে, বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় বাহুল্যতা(Redundancy) চলে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখা দরকার।
প্রথমেই আসা যাক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে। মানবজীবনের অন্য কয়টি নিত্য-নৈমত্তিক ঘটনার মত অসুস্থতাও একটি। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই রোগ-ব্যাধি মানুষের নিত্যসঙ্গী। আর সেই রোগ হতে মুক্তির উপায়-উপকরণের আবিষ্কার ও ব্যবহার থেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রের জন্ম। এটি বিজ্ঞানের প্রাচীনতম শাখার একটি। মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার বিকাশকালে লিখিত যে সব ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে তার একটি বড় অংশ চিকিৎসাসম্পর্কিত, যদিও এতে বিজ্ঞানের চাইতে তুক্-তাক, যাদুবিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র এবং কুসংস্কারের প্রাধান্যই বেশী। এরপরে মিশরীয় সভ্যতায়ও চিকিৎসা একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এছাড়া, ভারত এবং চীনেও এ শাস্ত্র মানুষের প্রয়োজনেই বিকশিত হয়। তবে, সবই তখনো যাদুবিদ্যা আর কুসংস্কারে ঢাকা পড়েছিল। গ্রীক বিজ্ঞানী হিপোক্র্যাটস্ই(Hippocrates; ৪৬০-৩৭০ খৃষ্টপূর্বাব্দ) প্রথম চিকিৎসাকে বিজ্ঞানের পথে চালিত করেন। অভিশাপ নয় বরং পরিবেশগত কারনেই রোগ-বালাই হয়- একথা তিনিই প্রথম বলেছেন। এছাড়া, বিভিন্ন রোগের শ্রেনীবিভাগ এবং কিছু কিছু রোগের কারন ও প্রতিকার নির্ণয় করে তিনি পাশ্চাত্য ‘চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক’(Western father of medicine) নামে অভিহিত হন। এরপরে, গ্যালেনের অবদান তো আগেই বলা হয়েছে।
মূলতঃ এই গ্রীক চিকিৎসাবিজ্ঞানই মুসলমানদের হাতে এসে শাখায়-প্রশাখায় বিকশিত হয়। এছাড়া, ভারত, চীন এবং মিশরীয় চিকিৎসা পদ্ধতিও মুসলমানরা আয়ত্ত্বে আনেন। জ্ঞানের এই চতুর্মুখী মিশেলে তৈরী মঞ্চের(Platform) উপর যথাযথ গবেষনা চিকিৎসাশাস্ত্রকে বিজ্ঞানের কাতারে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। মহানবীর(স) সময়েই হারেস বিন কালাদা (Harets ben Kaladah; অমুসলিম), আবু হাফসা ইয়াযিদ(মুসলিম) সহ বেশ ক’জন চিকিৎসকের নাম পাওয়া যায়। এরপরেই আসে ইয়াহ্হিয়া আন নাহ্বীর(খৃষ্টান) নাম যিনি মিশরের শাসনকর্তা আমর ইবনুল আ’সের(রা) ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে বিপ্লবী সূচনা হয় [link|http://en.wikipedia.org/wiki/Hunayn_ibn_Ishaq|হোনাইন ইবন্ ইসহাকের(أبو زيد حنين بن إسحاق العبادي; ৮০৯-৮৭৩) হাতে হিপোক্র্যাটস্ ও গ্যালেনের কাজসমূহ আরবীতে অনুবাদের পর; এই ব্যক্তিটিও খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী ছিলেন। এছাড়া আল বাত্রিকের(৭৯৬-৮০৬) হাতেও একই বিষয়ে বেশ কিছু গ্রীক গ্রন্থ অনূদিত হয়। অবশ্য এর আগে জাবির ইবন হাইয়ানের(جابر بن حيان; ৭২১-৮১৫) হাতে কিছু মৌলিক কাজের সূচনা হয়ে যায়। ইহুদী হতে ধর্মান্তরিত মুসলিম আলী ইবন্ রাব্বান(৮৩৮-৮৭০) ৮৫৫ খৃষ্টাব্দে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর প্রথম বিশ্বকোষ ‘ফিরদাউসুল হিক্মাহ্’(Paradise of Wisdom) প্রনয়ন করেন, যা এখনো পর্যন্ত বেশ উচ্চমূল্যের অধিকারী। আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবন্ ইস্হাক আল-কিন্দি(أبو يوسف يعقوب إبن إسحاق الكندي; ৮০১-৮৭৩) দর্শনে অনন্য অবদান রাখলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ পাওয়া যায়। তিনি ঔষধ এবং গণিতের সামঞ্জস্য বিধানে ব্রতী হন। তাঁর লিখিত ২৭০টি মৌলিক গ্রন্থের মাঝে ২৭টি চিকিৎসাসংক্রান্ত যাতে তিনি কমপক্ষে ২২৬টি বিভিন্ন রোগের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে আলোচনা করেন। আবু বকর মুহাম্মাদ ইবন যাকারিয়া আল রাজী(محمد زکریای رازی; ৮৬৫-৯২৫) নবম শতকের চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক বিস্ময়। শুধুমাত্র যে দু’জন ব্যক্তির আবির্ভাব অন্যান্য মুসলমান বা আরবীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের শত শত মৌলিক কাজকেও পেছনের সারিতে ঠেলে দেয়, আল রাজী তাঁদের প্রথম জন। সর্বকালের জন্য চিরস্মরণীয় এই ব্যক্তি ৩৫ বছরের চিকিৎসক পেশায় নিয়োজিত থাকাকালে এ বিষয়ের উপর ১১৭টি গ্রন্থ রচনা করেন। অনেকগুলো রোগের ক্ষেত্রে তিনি নতুন মতবাদের প্রয়োগ করেন এবং এক্ষেত্রে পূর্বে অপ্রচলিত নতুনধরনের ঔষধের ব্যবহার শুরু করেন। বিশেষ করে, শিশুরোগ সম্পর্কে তাঁর মৌলিক আলোচনা তাঁকে শিশুরোগের জনক (Father of Pediatrics) হিসেবে দাঁড় করায়। ১০ খন্ডের ‘কিতাবুল মান্সুরী’ শরীরবিদ্যায় এক অনন্য সুসংবদ্ধ গ্রন্থ। তাঁর লিখিত ৩০ খন্ডে সমাপ্ত ‘কিতাবুল হাবী’(The Virtuous Life; الحاوي) সেসময়কার ইতিহাসের সর্ববৃহৎ চিকিৎসা সংকলন(Medical Encyclopedia)।
আল-রাযীর একটি গ্রন্থের পাতা
এধরনের আরো একটি সংকলন করেন আলী ইবন আব্বাস(?-৯৯৪) ‘কিতাবুল মালিকী’(Royal Book, Latin:Liber Regalis) নামে। গ্রীক চিকিৎসা থেকে শুরু সমসাময়িক বিজ্ঞানীদের চিকিৎসাসংক্রান্ত মতবাদ এতে ঠাঁই পাওয়ায় একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস গ্রন্থও বলা চলে। এছাড়া শৈল্যচিকিৎসায়(Surgery) তিনি ভূমিকা রাখেন। এরপরই যাঁর নাম নিতে হয়, তিনি মুসলিম স্পেনের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী আবুল কাসিম খালফ্ ইবন্ আব্বাস আল-যাহ্রাবী(أبو القاسم بن خلف بن العباس الزهراوي); ৯৩৬-১০১৩)। ইউরোপে শৈল্যচিকিৎসা এঁর হাত দিয়েই প্রচলিত হয়। তাঁর ২ খন্ডে সমাপ্ত আল-তাস্রীফ(كتاب التصريف لمن عجز عن التأليف;The Method of Medicine) পরবর্তী পাঁচশত বছর অস্ত্রোপচার সংক্রান্ত বিষয়ে প্রামান্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার অস্ত্রোপচার যন্ত্রের সচিত্র সংকলন এই গ্রন্থের কাছে গ্যালেনও ম্লান হয়ে পড়েন। কুষ্ঠ রোগ, শিশুরোগ, রকেট, কানের সমস্যা এবং গ্লুকোমার চিকিৎসা নিয়ে তিনি মৌলিক কাজ করেছেন। এত কিছুর পরেও মুসলমানদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর নাম চাপা পড়ে যাওয়ার কারন দুইটি। এক. তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের সার্জারির প্রতি বিদ্বেষ এবং দুই. জগতে ইবন্ সীনা নামের এক মহারথীর আবির্ভাব।
আল-তাসরীফে বর্ণিত এবং চিত্রিত বিভিন্ন অস্ত্রোপচার যন্ত্র
আবু আলী আল হুসাইন ইবন্ আবদুল্লাহ্ ইবন্ সীনা(ابوعلی سینا; ৯৮০-১০৩৭) সেই দ্বিতীয় ব্যক্তি যাঁর কথা আল-রাযীর সাথে বলা হয়েছিল। বোখারা নগরীতে জন্মগ্রহন করা সীনা ১০ বছর বয়সেই কুরআন ও সমকালীন অন্যান্য বিজ্ঞানে বুৎপত্তি অর্জন করেন আর মাত্র ১৭ বছর বয়সে চিকিৎসাবিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে উঠেন। এ বিষয়ে তাঁর অনুসন্ধিৎসা এত প্রবল ছিল যে, পরের বছর হতেই চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ২১ বছর বয়স হতে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকে গ্রন্থ রচনা করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর রচিত ১৬টি মৌলিক গ্রন্থের ১৫টিতে তিনি বিভিন্ন রোগের কারন ও চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। হৃদ্রোগের কারন হিসেবে তিনিই প্রথম মানুষের মানসিক অবস্থাকে(ক্রোধ, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি) দায়ী করেন। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় তিনি মানসিক প্রশান্তির সাথে সাথে ঔষধ হিসেবে বিভিন্ন লতা-গুল্ম ও অন্যান্য বস্তুর বিবরণ দিয়েছেন। এছাড়া, আজকের মনো-চিকিৎসা(psyco-therapy) তাঁর হাত দিয়েই যাত্রা শুরু করে। কিন্তু, যে একটি গ্রন্থ তাঁকে অমর করেছে তার নাম ‘কানুন ফি-তিব্ব’(القانون في الطب Al-Qanun fi al-Tibb; The Law of Medicine; Latin: Canon Medicinae )। মানবসভ্যতায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এর চেয়ে প্রভাবশালী গ্রন্থ আর নেই। ৫ খন্ডে এবং ৮০০ পরিচ্ছেদে সমাপ্ত এই চিকিৎসা বিশ্বকোষে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে যেন একসাথে বেঁধে ফেলেছেন। প্রথম খন্ডে রয়েছে শরীরতত্ত্ব(Physiology) ও স্বাস্থ্যতত্ত্বের(Hygiene) মৌলিক আলোচনা। দ্বিতীয় খন্ডে ৭৫০ টি গুল্ম, পানীজ ও খনিজ ঔষধের বর্ণনা। এজন্য তিনি গ্রীক, রোমান, চীনা এবং ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতির সার নির্যাস সংগ্রহ করেন। তৃতীয় খন্ডে মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একাধিক রোগ এবং সেগুলোর উপসর্গ(Symptom), নির্ণয়(Diagnosis), পূর্বাভাস(prognosis) এবং কারণতত্ত্ব(Etilogy) নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মজার ব্যাপার হলো, তিনি মাথা হতে শুরু করে ধীরে ধীরে চোখ, কান, নাক, মুখ, দাঁত- এভাবে নিচের দিকে নেমে এসেছেন। চতুর্থ খণ্ডে বিশেষকিছু রোগ যেমন- জ্বর, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, ভয়, বেদনা, প্রদাহ, পচন, বসন্ত, যক্ষ্মা, হাড়ের ভাঙ্গন বা স্থানচ্যুতি, বিষক্রিয়া, ফোঁড়া, ঘা, চুল-নখ-চামড়া বিভিন্ন রোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সর্বশেষ খন্ডে আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন রোগের ব্যবস্থাপত্র, বড়ি, পাউডার ও সিরাপসহ নানান প্রকারের ঔষধসামগ্রী। সঙ্গতকারনেই, এ গ্রন্থটি বিপুলভাবে সমাদৃত হলো। সমগ্র এশিয়া এবং ইউরোপে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর উপরে কোন কথা ছিল না। ইউরোপে এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাইবেল(Bible of Medicine) নামে সমাধিক পরিচিত। এতে উল্লেখিত অনেকগুলো ঔষধ আজো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন রোগের কারন, উপসর্গ এবং ব্যবস্থাপত্র আজো অপরিবর্তিত রয়েছে। এজন্য তাঁকে অনেকে চিকিৎকদের চিকিৎসক(Doctor of doctors) বলে অভিহিত করেন।
কানু ফি-তিব্ব
চক্ষুচিকিৎসায়ও মুসলমানদের মৌলিক অবদান রয়েছে। [link|http://de.wikipedia.org/wiki/Ammar_ibn_Ali_al-Mawsili|আবুল কাসিম আম্মার ইবন্ আলী আল-মাওসুলী(عمار بن علي الموصلي) চোখের ছানি অপারেশনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। জর্জ সার্টন তাঁকে জগতের সর্বপ্রথম মুসলিম চক্ষুচিকিৎসক(The most original of Muslim oculists) বলেছেন। আলি ইবন্ ঈসা(علي بن عيسى; ৯৪০-১০১০) ছিলেন এ ব্যাপারে সকলের উপরে। তাঁর ‘তাজকিরাতুল কাহ্হালিন’ চক্ষুচিকিৎসায় সবচেয়ে প্রাচীংরন্থ যাতে চোখের ১৩০টি রোগ এবং ১৪৩টি ঔষধের বর্ণনা ঠাঁই পেয়েছে। তিনিই প্রথম চোখের রোগের সাথে পেট ও মস্তিষ্কের রোগের সম্পর্কিত হওয়ার কথা বলেন। প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ইবন্ হাইসামও( ابو علي، الحسن بن الحسن بن الهيثم; ৯৬৫-১০৩৯) এক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। চোখের ব্যবচ্ছেদকরণের(Anatomy) মাধ্যমে তিনি এর বিভিন্ন অংশ যেমন- রেটিনা, কর্ণিয়া, আইরিস্ ইত্যাদি আলাদা করে চিহ্নিত করে দর্শনে(View) এদের কাজের বর্ণনা দেন।
মুসলমানদের করা চোখের অ্যানাটমী
আরেকজনের কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন আবু হাসান আলী ইবন্ আবিল ইবন্ নাফিস(علاء الدين أبو الحسن عليّ بن أبي حزم القرشي الدمشقي; ১২১৩-১২৮৮)। চক্ষুরোগ এবং ঔষধের উপরে তাঁর দুইটি মৌলিক গ্রন্থ রয়েছে। কিন্তু, যে কাজের জন্য তিনি অমর তা হচ্ছে, মানবদেহের রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়ার আবিষ্কার। এক্ষেত্রে তিনি গ্যালেন এবং ইবন্ সীনার মত দুই মহারথীর মতবাদকে উপেক্ষা করেন এবং তাঁর আবিষ্কৃত মতবাদটিই আধুনিক যুগে প্রতিষ্ঠিত।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে মুসলমানদের অগ্রগতির ক্ষেত্রে তিনটি পরিবারের অবদান উল্লেখ না করলেই নয়।
ক) সাবিত ও সিনান পরিবার, যাঁদের মধ্যে সাবিত ইবন ক্বুরা(৮৩৬-৯০১) এবং তাঁর পুত্র সিনান ইবন্ সাবিত(سنان بن ثابت بن قرة) ও পৌত্র ইবরাহিম ইবন সাবিত(৯০৮-৯৪৬) সবচেয়ে বিখ্যাত।
খ) বখত্ইয়াসু পরিবার, যাঁরা কয়েক পুরুষ ধরে চিকিৎসা পেশায় সুনামের সাথে নিয়োজিত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, তাঁরা সকলেই ছিলেন খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী।
গ) জুহর পরিবার, যাঁরা প্রায় তিন শতাব্দী এবং ছয় পুরুষ ধরে স্পেনে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান রাখেন এবং আবদুল মা’লিক ইবন্ জুহর(أبو مروان عبد الملك بن زهر; ১০৯১-১১৬১) সবচেয়ে বিখ্যাত। তাঁর পুত্র, কন্যা, দৌহিত্র সকলেই চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
চতুর্দশ শতকে মুসলমানদের ক্ষমতা হারানোর পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞানেও অবদান কমে যেতে থাকে। তার মাঝেও ফিলিস্তিনী আবু সাঈদ আল আফিক, স্পেনের মোহাম্মাদ ইবন্ মোহাম্মাদ, তুর্কী আলী হাজালী, হাজী পাশার মত চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা টিমটিমে হয়ে জ্বলতে থাকেন।
মৌলিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানের এই হচ্ছে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। এর বাইরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের আরো দুইটি ক্ষেত্রে মুসলমানেরা অনন্য অবদান রেখেছেন, যার একটি হচ্ছে ঔষধবিজ্ঞান(Pharmacology) এবং অন্যটি হচ্ছে হাস্পাতাল(Bimaristan) প্রতিষ্ঠা। এ নিয়ে আলোচনা আসছে পরের পর্বে।
চলবে.....
১.ভূমিকা পর্ব
২.বিজ্ঞানের দর্শন পর্ব
৩.বিজ্ঞানের ইতিহাস পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১০ রাত ১২:২৬