দেশে বিদেশে ভ্রমনের অভিজ্ঞতা অনেকের আছে। কিন্তু আমার একটা নিজস্ব মতামত আছে এ ক্ষেত্রে। নিজের দেশকে আগে পুরোপুরি না দেখে সমগ্র বিশ্ব ভ্রমন করা বৃথা। আমি যে খুব ভ্রমন পিপাসু এটা ঠিক কিন্তু ভ্রমনের খুব একটা সুযোগ হয়ে ওঠে না। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এই অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই বাংলাদেশের পার্বত্য চত্তগ্রামের এলাকা এবং হাওর বেষ্টিত সিলেট এলাকা ভ্রমনের।
২০ মে ২০১৪ এর পড়ন্ত বিকালে আমাদের ৩৫জনকে নিয়ে বাস ভার্সিটি কাম্পাস থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হয়। বিকালে ভ্রমন শুরু করার উদ্দেশ্য ছিল দুপুরের প্রচণ্ড গরম থেকে নিজেদেরকে বাঁচানো। সারারাত বাসের মধ্যে গানবাজনায় মুখর থেকে খাগড়াছড়ি পৌছাইতে পরদিন প্রায় দুপুর হয়ে যায়। সারারাত হইচই করার পর সবাই মোটামুটি ক্লান্ত ছিল। রাবার বাগানের মধ্যে দিয়ে যখন আমাদের বাস চলছিল তখন রোদের প্রখর উত্তাপ থেকে রাবার গাছগুলো আমাদের বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা করছিল। রাবার হল রাবার গাছ থেকে সংগৃহীত একধরনের সাদা রঙের আঠালো পদার্থ। এদের সংগ্রহ করার পদ্ধতিটাও অনেকটা খেজুরের রস সংগ্রহের মতো। রাবার বাগান থেকে আমরা আলুটিলার উদ্দেশে রওনা হই। আলুটিলার উপর থেকে সমস্ত খাগড়াছড়ি শহরের সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। আঁকাবাঁকা বন্ধুর পথগুলো সর্পিল ভাবে নেমে গেছে পাহাড় থেকে। আলুটিলার সেই বিখ্যাত সুরঙ্গের কথা আগে থেকেই শুনেছিলাম। কিন্তু সুরঙ্গটা যে এতটা অন্ধকার এবং পিচ্ছিল হবে ওখানে যাবার আগে বুঝতে পারিনি। আমাদের কাছে মশাল না থাকায় অনেকেই সুরঙ্গের মধ্যে ঢুকতে ভয় পায়। তবে আমাদের মধ্যে কিছু নাছরবান্দা মানুষদের কাছে তখন যেন ওই আলু টিলার সুরঙ্গই যেন এডভেঞ্চার এর মূল আকর্ষণ। ভয়কে জয় করার উদ্দেশে আমরা ১০-১১ জন মোবাইল টর্চ এর আলোকেই সম্বল করে নেমে গেলাম সেই আলু টিলার সুরঙ্গে। চলার পথ ছিল অনেক অমসৃণ। একসময় মনে হচ্ছিলো এই অন্ধকার বোধহয় শেষ হবার নয়। কিন্তু এই দুর্দমনীয় মন যেন আলু টিলার ওই অন্ধকারের প্রতি আরও বেশি আকর্ষিত হতে থাকে। অবশেষে আলোর দেখা মেলে আর মন ভরে ওঠে আলু টিলার সুড়ঙ্গ জয় করার এক ভয়ঙ্কর আনন্দে। ছবি তুলে সেই জয় উদযাপন করার পর আমরা পর্যটন কর্পোরেশনের মোটেলে পউছালাম। মোটেলটি একটা টিলার উপর এবং অনেক রঙবেরঙের ফুলে সাজানো। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম শেষে আমরা বেরিয়ে পড়লাম খাগড়াছড়ি শহর ভ্রমনের উদ্দেশে। পুরো বিকাল এবং সন্ধ্যা শহরের রাস্তা এবং দোকানে ঢু মারলাম আমরা সদলবলে এবং রাতে ফিরে এলাম মোটেলে। রাতের খাবার খেয়ে বসলো আমাদের গানের জলসা। মোটেলের সামনের নির্জন রাস্তায় বসে গলা খুলে গাইতে যেন কেউ কার্পণ্য করেনি সেদিন।
পরদিন সকাল ৫ টায় বাস রাঙ্গামাটির উদ্দেশে রওনা হয়। পাহাড়ি উচুনিচু পথগুলো যেন দলবেঁধে আমাদের স্বাগতম জানাচ্ছিল অকৃত্রিম মমতায়। রাঙ্গামাটির মনোরম রাস্তা কখন যে আমাদের মোটেলে চলে এসেছিল সেটা যেন আমরা বুঝতেই পারিনি। মোটেলের পাশেই কাপ্তাই লেক আর রাঙ্গামাটির সেই বিখ্যাত ঝুলন্ত সেতু। ওখান থেকে বোট ভাড়া করে আমরা বের হয়ে পড়লাম কাপ্তাই লেক ভ্রমনের উদ্দেশে। বর্তমানের কাপ্তাই লেকের জায়গায় ছিল রাঙ্গামাটির পুরাতন শহর। কিন্তু লেক এ বাঁধ দেবার কারনে পুরাতন শহরটি এখন পানির নিচে। সেই পুরাতন শহরের কিছু নিদর্শন লেকের উপর থেকেই এখন চোখে পরে। পুরাতন কিছু মৃত গাছ এখনো মাথাতুলে দাঁড়িয়ে আছে লেকের মাঝে। আমরা দুপুরটা কাটালাম শুভলং এর ঝরনায়। অবশ্য ঝরনাতে এপ্রিল- মে মাসের দিকে পানি থাকে না। আমরা কয়েকজন ঝরনার মুখে স্যার দের কথা না শুনেই ঝরনার মুখে ওঠার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওঠার পথটি প্রায় অসম্ভব ই ছিল। তাও আমরা কয়েকজন হাল ছাড়িনি তখনো। কিন্তু বেশখানিকটা ওঠার পর প্রায় ২০-২৫ ফিট খাড়া একটা দেয়াল বেয়ে ওঠার দরকার পরে। এই জিনিসটাই আমাদের জন্য একদম অসম্ভব হয়ে পরে তবুও আমাদের ২ বন্ধু ইমরান আর তুষার জীবন বাজী রেখে উঠে পরে শুভলং এর ঝরনার উপরে।
শুভলং থেকে ফেরার পথে আমরা মারমাদের জীবনযাত্রা দেখার জন্য ওদের গ্রামে ঢুকি। ওরা যে এতটা অতিথিপরায়ণ হবে এটা আমরা আগে ভাবতেই পারিনি।এরা অনেক কষ্টসহিষ্ণু।এদের জীবনযাত্রাটা যে এতটা কঠিন না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না। বাইরে থেকে এরা কোনও সাহায্য না পেয়ে নিজেদের খাবার নিজেরাই ফলন করে নিজেদের পরার কাপড় নিজেরাই বুনে পাহাড়ি এলাকায় এরা বেঁচে আছে। পাহাড়ের সাথে যেন এদের জনম জনমের মিতালী।
কাপ্তাই থেকে ফিরতে আমাদের বিকাল হয়ে যায়। সেই নিরুত্তাপ বিকালে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা বের হই কয়েকটি বৌদ্ধবিহার ভ্রমনের উদ্দেশে। সেখান থেকে বৌদ্ধ বিহার ঘুরে এবং সাতটা স্বর্গ দেখে আমরা রাঙ্গামাটির শহরে কিছু কেনাকাটার উদ্দেশে বের হই। শপিং শেষে ফিরে আসি মোটেল সেই রাতটা আমরা সবাই আড্ডা মেরে কাটাই।
পরদিন ভোরে বাস বান্দরবান এর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। বান্দরবান এর রাস্তাটা অনেক বিপদজনক। বান্দরবান যাওয়ার পথেই আমরা স্বর্ণমন্দির দেখি। দূর থেকে মন্দিরের চুড়া দেখে স্বর্ণের মনে হওয়াটাই এই নামকরণের উদ্দেশ্য। মন্দিরের কারুকাজ গুলো অনেক নিখুঁত। প্রতিটা মূর্তি দেখেই স্বর্ণের মনে হয়। যদিও ওগুলো স্বর্ণের কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। কিন্তু মন্দিরে উঠতে যেয়েই আমাদের অনেকের প্রান প্রায় ওষ্ঠাগত। সেখান থেকে দেবতার পুকুর দেখার উদ্দেশে রওনা হই আমরা ২-৩ জন খালি পায়ে। পাহাড়ের তপ্ত মাটি যেন তখন আমাদের পায়ের তালুকে দগ্ধ করে চলেছে। কিন্তু এত কষ্ট করে যেয়েও দেবতার পুকুর দেখে খানিকটা কষ্ট পেতে হল। দেবতার পুকুর এই সময় শুকনা থাকে। নিচে সামান্য পানি দেখলাম।
সেখান থেকে আমরা নীলগিরির উদ্দেশে রওনা হই। নীলগিরির উপরে বাস এ পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব কারন এর অসম্ভব ঢালু রাস্তা আর ভয়ানক পাহাড়ি বাঁক গুলো। নীলগিরির এই বিপদসংকুল রাস্তা আর এর উচ্চতার কারনে একে ডেথ হিল নাম দিলেও ভুল হবে না। নীলগিরির উপরে পৌঁছানোর জন্য আমরা একধরণের গাড়ি ভাড়া করলাম। গাড়ীগুলোর নাম ও অদ্ভুত – ‘চাঁদের গাড়ি’। গাড়িগুলোর নামকরণ সার্থক কারণ এ গাড়িতে করে আমরা প্রায় চাঁদের কাছাকাছি পৌঁছে গেছিলাম। কারণ নীলগিরি হল ২০০০ ফুট উঁচু। এবং নীলগিরি থেকে নিচের যে পাহাড়ি সৌন্দর্য আর মেঘের সাথে পাহাড়ের যে গভীর সম্পর্ক তা খুব স্পষ্ট ভাবেই যেন বোঝা যায়। এই নীলগিরির উপরে যেন মেঘ আমাদের ছুঁয়ে যায়- এরকম পরিবেশ আমি আমার জীবনে কখন পাইনি। নীলগিরির উপর থেকে নিচের দিকে তাকালে হালকা কুয়াশার চাদরে মোড়ান পুরো পার্বত্য অঞ্চল দেখা যায় এক নিমিষে। উপভোগ করা যায় সূর্যের আলো ছায়ার খেলা। কথিত আছে নীলগিরির উপর থেকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ও দেখা যায়। অনেক খুজেও আমি এর সত্যতা পেলাম না। নীলগিরির উপরে একটি সুন্দর মনোরম রিসোর্ট আছে। সেখানে রাত্রিযাপন, খাওয়া দাওয়া করার সব ধরনের সুযোগ আছে। বাংলাদেশ আর্মি পরিচালিত এই রিসোর্টের থাকার ইচ্ছা থাকলেও এবার আমাকে হতাশ হয়েই ফিরতে হল। উচ্চতার কারনে আমাদের কয়েকজন সঙ্গী অসুস্থ হয়ে পরে। আমরাও কানের মধ্যে বাতাসের একটি অস্বাভাবিক চাপ উপলব্ধি করছিলাম। চারিদিক যেন অদ্ভুত ভাবে শান্ত ছিল একটা পাখির ডাক ও যেন আসছিল না কানে। বালুকা বেলায় তো আমরা অনেক সূর্যাস্ত দেখেছি কিন্তু এই নীলগিরি থেকে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। তারপর ওই পাহাড়ি ঢালু রাস্তা বেয়ে যখন আমরা নেমে আসছিলাম তখন যেন পাহাড়ের টান উপলব্ধি করতে পারছিলাম। সেই রাতটা আমরা বাংলাদেশ তুলা কর্পোরেশন এ থেকে পরদিন খুব ভোরে আমরা রওনা হই শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশে। যাওয়ার পথে প্রতিটা পাহাড়কেই যেন অনেকে বেশি আপন মনে হয়। সামান্য এই কয়টা দিনেই যে ওদের সাথে আমাদের এত সখ্যতা গড়ে উঠবে আমি ভাবিনি কখন। আমাদের পথের দুইধার দিয়ে দাঁড়িয়ে যেন আমাদেরকে বিদায় জানাচ্ছিল ওরা। পিছনে ফেলে আসা পাহাড়ের ভয়ঙ্কর কিন্তু শান্ত একধরণের টান অনুভব করছিলাম যেন শরীরে। বারবার মনে হচ্ছিলো যেন এই টান ছিঁড়ে আমি বের হতে পারব না। অনেক খারাপ লাগছিলো কষ্টও লাগছিলো।
শ্রীমঙ্গলে ঢুকতেই সে তার চিরচেনা রূপ- বৃষ্টি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানালো। চা বাগানের প্রতিটা পাতা যেন বৃষ্টিস্নাত হয়ে আরও সবুজ রঙ ধারন করল। বাস থেকে রাস্তার এদিক ওদিক তাকালে যেন মনে হচ্ছিলো সবুজ কার্পেটে মোড়ান কোনও স্বর্গীয় উদ্যান। শ্রীমঙ্গলের হীড(HEED-হেলথ, এডুকেশন, ইকনমিক ডেভেলপমেন্ট) এর বাংলোতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে পৌছাইতে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আমরা সেদিন আর বের হতে পারিনি বাংলো থেকে। আমাদের বাংলোর পাশেই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটির অবস্থান ছিল। চা বাগানের বাংলো নিয়ে আমরা অনেক ভুতের গল্প শুনেছি। তাই এরকম একটা নিঝুম পরিবেশে জঙ্গলের মধ্যে রাতে অনেকেই ঘুমাতে পারেনি।
পরদিন আমরা চা বাগান ঘুরতে বের হই। এনটিসি (ন্যাশনাল টি কোম্পানি) এর ১৩ টি চা বাগান আছে। কয়েকটি চা বাগান আমরা ঘুরে দেখি এবং মাধবপুর প্রাকৃতিক লেক এবং ম্যানেজার এর বাংলো দেখে আমরা ওদের একটা চা প্রক্রিয়াজাতকরন কারখানাতে চা এর প্রসেসিং দেখি। চা মূলত ৩ গ্রেড এ তৈরি করা হয়। এর মধ্যে গ্রেড ১ শুধুমাত্র এক্সপোর্ট এর জন্য উৎপাদন করা হয়। গ্রেড ২ ও এক্সপোর্ট হয় আবার লোকাল মার্কেটেও বেচাকেনা হয়। তবে লোকাল মার্কেটে যে চা গুলো পাওয়া যায় সামান্য গ্রেড ২ মিশ্রিত গ্রেড ৩ চা। সেখান থেকে আমরা মনিপুরীদের গ্রাম হয়ে মাগুরছড়াতে এসে পৌছাই। ওদের পান চাষ করার পদ্ধতিটাও বড়ই অদ্ভুত। পান গাছ গুলোকে ওরা সুপারি গাছ বেয়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়। এবং ওই পান গাছ গুলো তরতর করে বেয়ে উঠে যায় সুপারি গাছের মাথায়।
সেখান থেকে আমরা বাস এ করে পৌছাই লাউয়াছরা জাতীয় উদ্যানে। ১২৫০ হেক্টর জায়গার উপর বিস্তৃত এই জাতীয় উদ্যানে আছে ১৬৭ প্রজাতির গাছ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তনপায়ী এবং ১৭ প্রজাতির পোকা। সিলেট শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ উদ্যানের প্রধান আকর্ষণ হল উল্লুক। তাছাড়া আজগর, কিং কোবরা সহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ পাওয়া যায়। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার লাউয়াছরাকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে।
পরদিন সকালে নাশতা করে আমরা সিলেট এর উদ্দেশে বের হই। সিলেটে যাওয়ার পথেই আমরা মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত এবং জাফলং এ কিছু সময় কাঁটাই। জাফলং এর সচ্ছ জলের মত সেই স্মৃতি গুলো এখনও আমাদের মনের অনেকটা জুড়ে আছে। জাফলং এর টলটলে জলে অনেকেই নিজেকে ভিজিয়ে ঠাণ্ডা করে নিচ্ছিলো তখন। কিন্তু সময়ের সল্পতার জন্য আমরা মাধবকুণ্ড এবং জাফলং কোথাও গোসল করতে পারিনি।
সিলেট পর্যটন মোটেলে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। সিলেট পর্যটন মোটেল অসম্ভব সুন্দর জায়গায় অবস্থিত। পাশেই একটা ইকো পার্ক । অবশ্য পার্কে যাবার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। সেখানে রাতে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন আমরা শাহ জালাল (রঃ)এঁর মাজার পরিদর্শন করি। তারপর ছাতক সিমেন্ট কারখানা দেখার উদ্দেশে ছাতকে পৌছাই। দুপুরে ওখানেই আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত ছাতক সিমেন্ট কারখানা ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। এর কাঁচামাল মাটি,জিপসাম, কালসিয়াম কার্বনেট। এগুলো কেব্ল ক্যারিয়ারে করে ইন্ডিয়া থেকে আনা হতো। বিস্তর জায়গার উপর অবস্থিত এই কারখানার জনবল অন্যান্য কারখানার তুলনায় অনেক বেশি কিন্তু পদ্ধতি অনেক পুরানো। ছাতক থেকে বেরোনোর সময় আমরা সবাই ধুলো মেখে একাকার। ছাতক থেকে আমরা সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউজের উদ্দেশে যাত্রা করি। পথে হাসন রাজা জাদুঘর দেখে সার্কিট হাউসে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। টানা যাত্রার ধকলে অনেকেই নাজেহাল ছিল। তবুও সবাই ঢুলুঢুলু চোখে বসে রিপোর্ট লিখতে। কারন রাত ১২টা ছিল ট্যুরের রিপোর্ট জমা দেবার শেষ সময়সীমা। রিপোর্ট লিখে সবাই ঘুমিয়ে যায় শান্তির ঘুমে।
পরদিন আমরা বের হই সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমনের উদ্দেশে। ৫১ টি বিল নিয়ে গঠিত এই হাওর প্রায় ৯৭২৭ হেক্টর জায়গার উপর বিস্তৃত। একটা হাওর যে এতোটা বড় হতে পারে এটা আমাদের জানা ছিল না। নদীর দুই পাশ দিয়ে দুইটি হাওর বয়ে গেছে। বর্ষার সময় নদী হাওর সব মিলেমিশে এক হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় অথৈ পাথার। আমরা যখন বিভিন্ন পথঘুরে টাঙ্গুয়ার হাওরে পৌছালাম তখনই মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টির সময় যেন কুয়াশার চাঁদরে ঢেকে যায় সম্পূর্ণ হাওর। যেন এক অলৌকিক দৃশ্য। মনে পরে যায় ক্যারিবিয়ান সিএর সেই জলদস্যুদের কথা- পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ান। বৃষ্টির সময় মাঝহাওরে প্রচুর ঢেউ থাকে। তাই ট্রলার থামিয়ে আমরা বৃষ্টি থামার প্রতীক্ষা করতে থাকি। বৃষ্টি থামার পর আমরা ফেরার পথে পা বাড়াই।
অসংখ্য মাছ ও পাখির বাস এই হাওর এলাকায়। প্রায় ২০০ প্রজাতির গাছ আছে এখানে। তাছাড়া ১১ প্রজাতির উভচর, ১৪১ প্রজাতির মাছ, ২৭ প্রজাতির সরীসৃপ, ২১৯ প্রজাতির পাখি এবং ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী। অসংখ্য মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে এই টাঙ্গুয়ার হাওর। তাদের জীবন জীবিকা সম্পূর্ণ ভাবে এই হাওর এর উপর নির্ভরশীল। প্রায় ৫৬০০০ মানুষ তাদের জীবিকার জন্য টাঙ্গুয়ার হাওরের উপর নির্ভর করে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার টাঙ্গুয়ার হাওরকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করে।
দুপুরে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমাদের উদ্দেশে খাওয়াদাওয়া এবং টাঙ্গুয়ার হাওর সম্পর্কে জানার জন্য একটা অনুষ্ঠানের আয়জন করেন। সেখান থেকে ফিরে রাতে আমাদের জন্য জেলা প্রশাসকের বাংলো তে ডিনারের দাওয়াত ছিল। তাঁরই সম্মানার্থে আমাদের অন্য ধরনের অভিজ্ঞতা হল। জানি এরকম সুযোগ অথবা সম্মান সবার জীবনে আসে না।
ভ্রমনের নয়টি দিন ফুরিয়ে গেলো। ইচ্ছাপূরণ হল অনেক। ক্লান্তিতে হয়তো চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে অনেকবার তবুও চোখ খুলে রখেছি অজানাকে জানার জন্য আর অদেখাকে দেখার জন্য। ফিরে আসতে হল অসংখ্য বাঁধনে মোড়া এই যান্ত্রিক জীবনে। বার বার মনে হচ্ছিলো কিছু যেন রেখে যাচ্ছি ওই পাহাড়ী জঙ্গলে ঘেরা আঁকাবাকা বন্ধুর পথে । তখন নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বারবার বলেছি ‘ যা হারিয়েছি ওখানে তা হয়তো কখনও খুজে পাবো না। কিন্তু সেই হারানো মনটার জন্য যখন অনেক খারাপ লাগবে তখন তাঁকে খুঁজতে চলে যাবো ওই সবুজে ঘেরা নীল পাহাড়ের দেশে। ‘
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:০৯