somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লাওয়াছড়াঃ প্রকৃতির এক জীবন্ত জাদুঘর।

২৩ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ৮:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দুরুদুরু বুকে হেঁটে চলেছি অন্ধকারে ঢাকা আঁকাবাঁকা পথ ধরে। সামনে ঘন অন্ধকারে ঢাকা অরণ্য। বুনো লতাপাতা গুলো পা জড়িয়ে ধরছে যেন নিষেধ করছে সামনে না যেতে। কারন সামনের পথ অনেক বিপদসংকুল। কৌতূহলী মন যেন তবুও কোনও বাঁধা মানতে চায়না। এমন সময় ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলে দেখি ভোরের সূর্যোদয়। এভাবে ছোটবেলার স্বপ্নগুলো বারবার ভেঙ্গে গেছে। বারবার কৌতূহলী মন ফিরে এসেছে কাচের দেয়ালের মত অদৃশ্য কোনও দেয়ালে বাঁধা পেয়ে। জানি এই কাহিনী শুধু আমার নয়। প্রতি ঘরে ঘরে এই কাহিনীর বিস্তৃতি। অনেকের মনে এই স্বপ্ন গুলো এখনও হয়তো শাখা- প্রশাখা মেলছে, ভবিষ্যতেও মেলতে থাকবে। কারও কারও জীবনে শহুরে যান্ত্রিকতায় গুমরে মরবে স্বপ্নগুলো। আবার কেউ কেউ তাঁদের স্বপ্নগুলোকে বাস্তব হতে দেখবে। আমি হয়তো ২য় ধরনের মানুষের মধ্যেই পড়ি এখন কারন আমি আমার ছোট বেলার সপ্নকে বাস্তবে রূপ নিতে দেখেছি। নিজের ভালবাসার জগতকে সত্যি হতে দেখেছি। কারন এদেরকেই কাছে চেয়েছি সারাজীবন।
তারিখটা ছিল ২৫ মে ২০১৪ । আর জায়গাটা ছিল লাওয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। শিক্ষা সফর এর অংশ হিসেবে আমরা ৩৩ জন ছাত্রছাত্রী লাওয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটি ঘুড়ে দেখার সুযোগ পাই। আমাদের শিক্ষা সফরটা সফল করার পেছনে বড় অবদান অবশ্যই প্রফেসর ডঃ কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন স্যার এবং প্রফেসর ডঃ সালমা বেগম ম্যাডামের। প্রথমেই তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
বাংলাদেশের ৭ টি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যের মধ্যে লাওয়াছড়া অন্যতম। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ১২৫০ হেক্টর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই প্রাকৃতিক বনাঞ্চল যেন অসংখ্য ধরনের প্রাণীর এবং অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদের কোনও জীবন্ত জাদুঘর। ১৯২৫ সালের তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এই উদ্যানের গোঁড়াপত্তন করলেও কালের বিবর্তনে জৌলুস শুধু বেড়েছে এই প্রাকৃতিক উদ্যানের। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার একে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা প্রদান করে। এটি নর্থ ইস্টার্ন ইকোসিস্টেম মডেল হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। এই উদ্যানের পূর্ববর্তী নাম ছিল পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বন।
ইতিহাসের সাক্ষী এ বনের পাশঘেঁষে যে রেলপথ চলে গেছে সেটিও সাক্ষী হয়ে রয়েছে অসংখ্য ঘটনার। জুলভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত পৃথিবী কাঁপানো হলিউড সিনেমা 'অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ' ছবিটির একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল এই রেল লাইনের উপরে।
পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি হওয়ার কারনে উঁচুনিচু অসংখ্য টিলার উপর এই বনাঞ্চল গড়ে উঠেছে। অসংখ্য প্রজাতির জীব বৈচিত্র্যের মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রানী এখানে দেখা যায়।
উল্লুক এই বনের বিরল প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে অন্যতম। এর বৈজ্ঞানিক নাম Hoolock gibbon। বিশ্বজুড়ে প্রায় বিপন্ন এই প্রাণীটির প্রায় ৪৯ টি এই বনে অবশিষ্ট আছে।এদের প্রিয় খাদ্য চাপালিশ ফল। শুনেছিলাম এই বনে আসলে উল্লুকের দেখা পাওয়া যাবে অথবা শোনা যাবে তাঁদের ডাক। এর একটারও সৌভাগ্য আমার হয়নি। জানিনা আমার সব সহপাঠী এবং সহপাঠিনীরা আমার সাথে একমত হবেন কিনা। জঙ্গলে যাবো আর সাপের ভয় থাকবেনা এটা আবার হয় নাকি। অসংখ্য প্রজাতির সাপের আনাগোনা এই জঙ্গলে। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অজগর, কিং কোবরা। বাংলাদেশের কোথাও যে কিং কোবরা পাওয়া যায় এটা আমার জানা ছিল না আগে। তবে এক্ষেত্রে ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন বলতেই হবে যে কোনও কিং কোবরা আমাদের পথ আগলে দাড়ায়নি। এছাড়াও বনের অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মুখপোড়া হনুমান, বানর, শিয়াল, মেছোবাঘ, বন্য কুকুর, ভাল্লুক, মায়া হরিণ অন্যতম।
লাওয়াছড়ার অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে গর্জন সেগুন চাপালিশ, শিমুল জাম, ডুমুর, তুন, কড়ই, জামরুল, গামার, লোহাকাঠ অন্যতম। লাওয়াছড়ার ক্লোরোফর্ম গাছের কথা শুনেছিলাম আগে থেকেই কিন্তু ওই গাছটাকে জীবিত অবস্থায় দেখার পরিবর্তে গাছটার শুকনা গুড়ি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে আমাদের। গাছটার বৈজ্ঞানিক নাম Clorophora excelsa । সকলের সন্দেহদূর করার জন্য জানিয়ে রাখছি যে ক্লোরোফর্ম কেমিক্যাল এর সাথে গাছটার আসলেই কোনও সম্পর্ক নেই। শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক নাম থেকে ক্লোরোফর্ম নামটা এসেছে। কারন আমার মত অনেকেরই ভ্রান্ত ধারনা থাকতে পারে যে এই গাছটা থেকে ক্লোরোফর্ম পাওয়া যায়।
লাওয়াছড়া উদ্যানের একজন কর্মকর্তা মোঃ সরোয়ার আলম উদ্যানটি সম্পর্কে আমাদের ব্রিফিং করেন। সবাই অনেক মনোযোগ সহকারে তাঁর কথাগুলো শুনছিলাম আমরা। প্রকৃতির কাছে আসলে আমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডই যেন অনেকটা প্রাকৃতিক হয়ে যায়। ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা, রাগ, ক্ষোভ অভিমান যেন কিছুই আমাদের স্পর্শ করতে পারে না।
বনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য ৬৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে একটি কো ম্যানেজমেন্ট কমিটি কাজ করছে। এই কমিটিতে সমাজের সর্ব পর্যায়ের প্রতিনিধি বিদ্যমান। এটি ইনটিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে বলে আমার মনে হয়।
তবে বনটা ঘুড়ে দেখার পর আমার একটা জিনিস মনে হয়েছে যে এতো বড় একটা জাতীয় সম্পদ পরিচালনা এবং দেখাশোনার জন্য জনবল পর্যাপ্ত নয়। সেই জন্যই হয়তো এই বনের অমূল্য সম্পদ গুলো আজ বনদস্যুদের দ্বারা লুণ্ঠিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
অবশেষে আসে ফেরার পালা। সারি সারি গাছ দুপাশে বিদায়ী ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে যেন বিদায় দেয় আমাদের। বনের মধ্যে দিয়ে যতক্ষণ হেঁটেছি আমি হয়তো এই জগতে ছিলামনা। হারিয়ে গিয়েছিলাম আমার সেই স্বপ্নের চিরচেনা জগতে যেখানে এক হয়ে মিশে গিয়েছিল রঙিন একটি স্বপ্ন আর অপহৃত কোনও এক বাস্তব।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×