[একজন হেলাল হাফিজ। কবি, আবার কখনো রূপকথার গল্পের কোনো মনোযোগী চরিত্র। কখনো উধাও, আবার কখনো হঠাৎ উদিত নক্ষত্রটি, উজ্জ্বল। জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ই অক্টোবর, নেত্রকোনা জেলার বড়তলী গ্রামে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কবিতার ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় একটি বই হিসেবে দুই যুগ ধরে পঠিত হয়ে আসছে। কবিতার রাজকুমার আর ব্যক্তিজীবনে চিরকুমার এই কবি সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছেন শিলালিপির। কবিতা-যাপন কিংবা কবিতা-বিচ্ছেদ থেকে ব্যক্তিজীবনের একান্ত গোপন কথাটিও তিনি বলেছেন এই সাক্ষাৎকারে। শিলালিপির পক্ষ থেকে সাক্ষাকারটি গ্রহণ করেছেন মাহমুদ শাওন।]
মাহমুদ শাওন: শুরুটা ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইয়ের কথা দিয়ে শুরু না হলে আমার নিজের কৌতূহল মিটবে না। এই একটা বই লিখেই রূপকথার নায়ক হয়ে ওঠার গল্প যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে কবিতা থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনের প্রসঙ্গও? সবকিছুর মূলেই রয়েছে এই বই। সুতরাং...
হেলাল হাফিজ: এই প্রশ্নের মুখোমুখি গত ছাব্বিশ বছরে আমাকে কয়েক হাজারবার হতে হয়েছে। সত্যি বলতে কী, এর সবচে বড় কারণ হলো, আমি খুব কম প্রতিভাবান। এটা আমার বিনয় নয়। আমি এই বইটির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি এবং এত ধৈর্য্য স্থৈর্য্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছি যে, শুনলে অবাক হবে, সতের বছর লেখালেখির পর ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটি প্রকাশ করেছি। বইটি বেরোনোর আগেই আমার জেদ ছিল এবং আকাক্সক্ষা ছিল, আমার এই বইটি যেন অন্যান্য কবিতার বইয়ের মতো বেনোজলে ভেসে না যায়। এই বইটি প্রকাশের আগেই আমি কিন্তু বাংলাদেশে কবিতার জগতে প্রতিষ্ঠিত। এবং এক ধরনের তারকা খ্যাতিও পেয়েছি। তারপরও আমি অপেক্ষা করেছি, ৮০/৯০ টি কবিতা থেকে বাছাই করে কবিতা নিয়েছি। মূল পান্ডুলিপি তৈরির জন্য আমার প্রিয় এই প্রেসক্লাবের লাইব্রেরিতে বসে ছয় মাস ধরে কাটাছেঁড়া করেছি। আজকে একটা লিস্ট করি, আবার রাতে মনে হয়, আহা, ওই কবিতাটি তো বাদ পড়ে গেল! পরেরদিন সকাল বেলা এসে আরেকটা লিস্ট করি, ওই কবিতা ঢোকাই আরেকটা কবিতা বাদ দিয়ে। আবার ৫৬টির বেশি কবিতা দেওয়াও যাবে না। তখন আবার ভাবি, আহা এই কবিতাটা বাদ গেল, যাকে নিয়ে কবিতাটি লিখেছি তার সাথে তো আমার একটা সম্পর্ক ছিল! আবার মনে হয় ওই আন্দোলনের কথাটা বোধ হয় বাদ গেল! তাহলে ওইসময় স্বৈরাচার বিরোধী যে কবিতাটি লিখেছিলাম, ঘরোয়া রাজনীতি নিয়ে লিখেছিলাম-ওটা অবশ্যই দেয়া উচিৎ; তা না হলে সময়টা তো ধরা পড়লো না;- এই করতে করতেই ছয় মাস লেগেছে। এভাবেই বাছাই করা হয়েছে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র ৫৬টি কবিতা।
মাহমুদ শাওন: বইটি আপনার জীবনকে কীভাবে বদলে দিল?
হেলাল হাফিজ: অন্তত পাঁচ হাজার কবিতাপ্রেমী দেশে এবং বিদেশে আমাকে বলেছেন, ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটির নাম আমি কোথায় পেলাম? কীভাবে পেলাম? অন্তত একশ ছেলে মেয়ে আমাকে বলেছেন, তারা কবিতার পাঠক নন, তবু শুধু নামটি দেখেই বইটি তারা কিনেছেন এবং পড়েছেন।
বইটি প্রকাশ পায় ১৯৮৬ সালে। তারপর বইমেলায় সর্বাধিক বিক্রীত বই শুধু নয়, উপন্যাসের চেয়েও সে বছর বইটি বেশি বিক্রি হয়েছিল। তারপর গত পঁচিশ বছরে বইটি ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। পাঠক মহলে দিনে দিনে বইটির প্রতি আগ্রহ কেবলই বেড়েছে। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে আমার। কেন হলো? ক্ষতি হয়েছে এই জন্য, এই তুমুল জনপ্রিয়তা আমার মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি করেছে। আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি। এরপরে আমি আর কী লিখব? আমি যে নতুন করে লিখব, আমার লেখা যদি মানুষ পছন্দ না করে! আমার কবিতা যদি ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র কবিতার কাছাকাছি না যেতে পারে! আমার কবিতা যদি মানুষ না পড়তে চায়। এই এক অদ্ভুত আতঙ্ক আমার মধ্যে তৈরি হলো এবং দিনে দিনে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। বহু চেষ্টা করেছি এই ভীতি কাটিয়ে ওঠার জন্য। কোনো লেখকেরই সব লেখা সমান হয় না। তা যত বড় লেখকই হন। কবি তো বটেই, কোনো লেখাই উপন্যাস বলো, ছোটগল্প বলো, প্রবন্ধ বলো-এক লেখকের সব লেখাই তো এক মানের হয় না। কোনো লেখা একটু বেশি ভালো হয়, একটা মধ্যম মানের হয়। কিন্তু এই ভীতি আমার কাটলো না। বরং যত দিন যেতে লাগলো, ততই আমার বইটির জনপ্রিয়তা চললো বেড়ে।
তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। চিঠি-ই ছিল যোগাযোগের মাধ্যমে। তো শ’য়ে শ’য়ে চিঠি আসতো আমার কাছে। তাতে থাকতো নানা ধরনের কৌতূহল আর প্রশ্ন। এই যেমন- আমি কেন লিখি না? হেলেন কে? এই সবিতা সেন কে? হিরণ বালা কে? ইত্যাদি। এই নামগুলো আমার কবিতার মধ্যে আছে।
মাহমুদ শাওন: আপনার একটি কবিতায় আছে- ‘অসহায় একটি অঙ্গুরী/ কনিষ্ঠা আঙুলে এসেই বলেছিলো ঘর,/ অবশেষে সেও গেছে সভয়ে সলাজে।/ ওরা যাক, ওরা তো যাবেই/ ওদের আর দুঃখ কতটুকু? ওরা কি মানুষ?’ কিন্তু মানুষও তো গেছে! যারা আপনাকে ভালোবেসেছিল, কিংবা আপনি যাদেরকে ভালোবেসে কবিতা লিখেছিলেন? কারো সাথেই ঘর বাঁধা হলো না কেন?
হেলাল হাফিজ: দেখো, সত্যি বলতে কী, আমার নারী ভাগ্য কিন্তু বেশ ভালোই। সেটা একমাত্র কবিতার কারণেই। অন্য কোনো কারণে নয়।
আমার মতো সৌভাগ্যবান কবি এই দেশে খুব কমই আছে। এত অল্প লিখে এত আদর, ভালোবাসা মানুষেরÑএটা আমার মনে হয়, এই দেশে তো নয়ই, বিশ্বের যেকোনো সাহিত্যেই বিরল। বাংলা কবিতায় এরকম নজির আর দ্বিতীয়টি আছে বলে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। কিন্তু এই ভালোবাসাও আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার একটি নির্মাণাধীন কবিতা আছে হোটেল কর্ণফুলিতে উঠে লেখা। তার একটি পঙক্তি আছে, ‘এত ভালোবাসা পেয়ে, ভিতরে ভীষণ লাজে/ বেদনারা লাল হয়ে গেছে’। এই ভালোবাসা আমাকে বিপদেও ফেলেছে। মানে আমি এই ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারছি না।
মাহমুদ শাওন: আপনার জীবনে বাবা খোরশেদ আলী তালুকদারে প্রভাবের কথা বলেছেন। শৈশবে আপনার মাকে হারিয়েছেন। তো কবি হয়ে ওঠার পেছনে এই বিষয়গুলো কতটুকু কাজ করেছে?
হেলাল হাফিজ: আমি চেয়েছিলাম, আমার প্রথম বইটি শুধু মাকে উৎসর্গ করব। কিন্তু তা করা হয়নি। আমার যখন মাত্র তিন বছর বয়স, তখন মা মারা যান। মাতৃহীনতার এই বেদনাই আমাকে কবি করে তুলেছে। তা না হলে আমি হয়তো অন্য কিছু করতাম। খেলোয়াড় হতাম। আমার কৈশোর এবং প্রথম যৌবনে খেলাধুলার প্রতি-ই ছিল আমার ঝোঁক। ফুটবল, লন টেনিস, টেবিল টেনিস, ভলিবল এসব নিয়েই ছিলাম। যতই বয়স বাড়তে লাগলো, দেখলাম, খেলাধুলা আমার এই বেদনাকে প্রশমিত করতে পারছে না। কৈশোর থেকেই কিছু কিছু লেখার অভ্যাস আমার ছিল। কিন্তু কলেজে উঠে মনে হলো আমাকে লেখালেখিই করতে হবে। তখন থেকেই আমার ভেতর কবিতা লেখার উন্মাদনা শুরু হয়েছে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হলাম বাংলা বিভাগে। সেটা ১৯৬৭ সন। বাড়িতে আব্বার সঙ্গে একটু অভিমান করে এক বছর পড়লাম না। চলে গেলাম মুন্সিগঞ্জ। সেখানে একটা হাইস্কুলে এক বছর মাস্টারি করেছি। পরের বছর আবার ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হলাম।
যাহোক, নির্মলেন্দু গুণের সাথে আগেই আমার পরিচয় ছিল। আমাদের বাড়ি একই জায়গায়, নেত্রকোনায়। আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ এরকম অনেকের সাথে পরিচয় হলো। রফিক আজাদকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। তিনি নেত্রকোনায় কলেজে পড়তেন। আমার আব্বা খোরশেদ আলী তালুকদারও কবি ছিলেন। উনি নেত্রকোনার একজন খ্যাতিমান শিক্ষকও বটে। খালেকদাদ্ চৌধুরী ‘উত্তর আকাশ’ নামে নেত্রকোনা থেকে একটি পত্রিকা বের করতেন। রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ আমার আব্বা ওই ম্যাগাজিনে লেখালেখি শুরু করেন।
মাহমুদ শাওন: আপনার ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতার লাইনগুলো অনেকটা স্লোগানের মতো। আপনি যেন যৌবনের ধর্মটাকে চোখে আঙুল দিয়ে আরও একবার দেখিয়ে দিলেন। তবু কবিতা ‘স্লোগান’ হয়ে গেলেও, স্লোগান কি ‘কবিতা’ হতে পারে?
হেলাল হাফিজ: কবিতার একটা প্রায়োগিক দিক থাকে। বিশেষ করে রাজনৈতিক কবিতার প্রায়োগিক দিক থাকেই। কিন্তু সব স্লোগানধর্মী কবিতা আবার শিল্প হয়ে ওঠে না। কিছু কিছু শিল্পগুণ সমৃদ্ধ কবিতাও স্লোগান হয়ে যায়। আমার ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটা অদ্ভুত কারণে ব্যাপক একটা সাড়া ফেলেছে। তার কারণ হলো, ‘সময়’। আমার প্রথম যৌবন, মধ্য যৌবন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌবন-তুমি আমার সময়গুলো চিন্তা করলেই দেখবে, কিংবা ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটির কবিতাগুলোর নিচে দেখবে রচনাকাল আছে। ওটা দেখলেই সময়টা বুঝতে পারবে। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লেখা হয়েছে ১৯৬৯ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে। অর্থাৎ তখন গণঅভ্যূত্থান একেবারে তুঙ্গে। ৬৯’এর গণঅভ্যূত্থান কী জিনিস ছিল সেটা আজকের ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারবে না। কারণ আজকাল তো টাকা দিয়ে মিছিলে লোক আনা হয়। ছাত্রদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে; রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের স্বচ্ছতা ও মনোবলের অধপতন ঘটেছে। ডাক্তাররা বিভক্ত, আইনজীবীরা বিভক্ত, রাজনীতিবিদেরা তো বিভক্ত বটেই। আমরা একটা অদ্ভুত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যাহোক, ৬৯’এর গণঅভ্যূত্থানে এটা রচিত এবং ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ এই পঙক্তিগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে উৎকীর্ণ ছিল। তখনো কিন্তু এটা সারা দেশে ছড়ায়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ যখন স্বাধীন হলো, ১৯৭২ থেকে ধীরে ধীরে এই কবিতা সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। এটা কেন ছড়ালো, এটা কি তখনকার শাসকদের ব্যর্থতার জন্য, নাকি তাদের কোনো নিপীড়ন নিষ্পেশনের কারণে, নাকি মানুষ স্বপ্নভঙ্গের বেদনা প্রশমিত করার জন্য এটা ব্যবহার করতো- জানি না। বিশেষ করে, তখন আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক দল অর্থাৎ বাম রাজনৈতিক দলগুলো এই কবিতাটিকে তাদের একেবারে সূচনা সঙ্গীতের মতো ‘সূচনা কাব্য’ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। তাদের সমস্ত পোস্টারে, লিফলেটে, দেয়ালে দেয়ালে, সমস্ত পুস্তিকায় এই কবিতা তারা ব্যবহার করতো। তারচেয়েও বড় কথা হলো, এই কবিতা আওয়ামীলীগ ব্যবহার করে, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, বাম দলসহ সবাই ব্যবহার করে।
মাহমুদ শাওন: এক সময় একজন তুখোড় জুয়াড়ি হিসেবে আপনার একটা পরিচয় ছিল। তখন তাস খেলা-ই ছিল আপনার অন্যতম জীবিকা। সেটা কিভাবে বা কেন শুরু হলো?
হেলাল হাফিজ: ১৯৭২ সালে আমি সাংবাদিকতা শুরু করি ‘দৈনিক পূর্বদেশ’-এ, সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। ১৯৭৫ সালে সরকারী আদেশক্রমে চারটা পত্রিকা ছাড়া সব কাগজ বন্ধ হয়ে যায়। পূর্বদেশও তখন বন্ধ হয়ে গেল। সরকার তখন প্রত্যেককে চাকরি দিয়েছিল। আমাকেও দিয়েছিল। কিন্তু আমি সরকারী চাকুরি করব না বলে আর কোথাও যোগ দেইনি। তখন বিচিত্র জীবনের মধ্যে ঢুকে গেলাম। সেটা হলো, আমি তখন বেশ কয়েক বছর জুয়া খেলে জীবিকা নির্বাহ করেছি। অর্থাৎ তাস খেলে। এবং আমার ভাগ্য এত ভালো ছিল যে, প্রায় প্রতিদিনই জিততাম। ফলে আমার অর্থের কোনো অভাব হতো না। পত্রিকা অফিসে যে বেতন পেতাম তারচেয়ে অনেক বেশি ছিল উপার্জন। এভাবে কয়েক বছর বেকার থাকার পর ১৯৭৮ সালে ‘দৈনিক দেশ’ নামে আরেকটা কাগজ বেরোলো। তারা আমাকে ডাকলো ওই পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। সেখানে আমি কাজে যোগ দিলাম, কিন্তু তাস খেলা ছাড়তে পারলাম না। একই সঙ্গে চাকরিও করেছি, জুয়াও খেলেছি। সেখানে কাজ করেছি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। তারপর ‘দৈনিক দেশ’ বন্ধ হয়ে যায়। তখন জীবিকার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে জুয়া খেলায় আবার ঝুঁকলাম। এবং প্রায় ১০-১২ বছর জুয়াই ছিল আমার চাকুরির মতো পেশা। এটাকে আমি স্পোর্টস হিসেবে নিইনি, আমার জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে নিয়েছিলাম। তখন লেখালেখি জগতে যারা ছিলেন বা যারা আমাকে চিনতেন, তারা সবাই জানতেন যে আমি একজন নামকরা কবি-ই শুধু নই, নাম করা জুয়াড়িও বটে! তো এটা আমাকে কখনো অস্বস্থিতে ফেলেনি।
আমার জীবনে চারটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক নম্বর অক্সিজেন। দুই শস্যদানা, তিন নম্বর প্রেম, চার হলো কবিতা। এই চারটা জিনিস ছাড়া আর কোনো কিছুর প্রতি আমার লোভ নেই, আকাক্সক্ষা নেই। অক্সিজেন প্রকৃতি থেকেই পাচ্ছি। খাদ্যের জন্য হয় চাকরি করতে হয়েছে অথবা ব্যতিক্রমী জীবন-যাপন করতে হয়েছে। ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে ‘জিগলৌ’ (Gigolo)। ‘জিগলৌ’ হচ্ছে বিত্তশালী নারীর এক্সট্রা মেরিটাল বন্ধু (যেহেতু তারা বিত্তশালী, তাই এরকম বন্ধু তারা রাখতে পারে)। আমি অকপটে তোমাকে বলছি, নির্দ্বিধায় তোমাকে বলছি, আমি এই জীবনও যাপন করেছি। অর্থাৎ বিত্তশালী মহিলাদের কবিতা শুনিয়ে আনন্দ দেয়া বা বন্ধু হিসেবে তাদের সঙ্গ দেয়া ইত্যাদি। এর বিনিময়ে তারা আমাকে প্রচুর অর্থও দিয়েছেন। এরকম বিচিত্রভাবে আমি জীবন-যাপন করেছি। মানুষ হয়তো চমকে উঠবে এসব শুনে। কিন্তু যেহেতু আমি কবি, তাই নির্দ্বিধায় এই কথা তোমাকে বললাম। সব ভালোবাসা অথবা বন্ধুত্বের পরিণতি যে শারীরিক কথপোকথনে শেষ হবে এমনটা ঠিক নয়। তারা আমাকে ভালোবেসেই সবকিছু দিয়েছেন। হয়তো ভেবেছেন আমি অর্থ কষ্টে আছি, তাই আমাকে সহযোগিতা করেছেন। সেটা করেছেন মূলত আমার কবিতাকে ভালোবেসে। তা না হলে আমার বেঁচে থাকাই কষ্টকর হতো।
মাহমুদ শাওন: ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশের পঁচিশ বছর পর এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে আপনার ‘কবিতা একাত্তর’। বইটি নিয়ে কিছু বলুন।
হেলাল হাফিজ: বস্তুত, ‘কবিতা একাত্তর’ সে অর্থে মৌলিক বই না। এখানে ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের ৫৬টি কবিতা আছে, সাথে আছে নতুন আরও ১৫টি কবিতা। এই ৭১টি কবিতা দিয়ে আমি ইচ্ছে করে বইটির নাম রেখেছি ‘কবিতা একাত্তর’। একাত্তর বললেই মুক্তিযুদ্ধের কথা আমাদের মনে ও মগজে জেগে ওঠে। একজন কবির কাজ তো এভাবেই মানুষকে উস্কে দেয়া, উজ্জীবিত করা। তবে আমার মূল লক্ষ ছিল ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র কবিতাগুলো ইংরেজিতে অনূদিত হোক। অনেকে বলছে দূর্বল অনুবাদ হয়েছে, অনেকে বলছে আরো সুন্দর অনুবাদ হতে পারতো; ঠিক আছে। একটা জিনিস মলাটবন্দী হলো। এখন ধীরে ধীরে আরও ইমপ্র“ভ করা যাবে। অন্য কেউ অনুবাদ করতে পারেন। বা যিনি করেছেন, তিনি-ই আবার নতুন করে অনুবাদ করতে পারেন।
মাহমুদ শাওন: মৌলিক কাব্যগ্রন্থ কবে পাবো?
হেলাল হাফিজ: আমার সবচে প্রিয় বিষয হচ্ছে আলস্য, খুব উপভোগ করি। আমার প্রিয় বিষয় অপচয় আর আত্মপীড়ন। ওই যে তুমি বললে, কেন লিখলাম না এতদিন! ওটাও এক ধরনের আত্মপীড়ন। আত্মহনন করার মতো সাহস হয়নি, কিন্তু এক দুইবার আত্মহননের ইচ্ছেও জেগেছিল মনে। সেখান থেকে বেঁচে গেছি ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইয়ের প্রতি পাঠকদের ভালোবাসার জন্য।
আমি কিন্তু এরই মধ্যে লেখালেখি শুরু করেছি। আমার পরবর্তী মৌলিক যে বই তার নামও মোটামুটি ঠিক করে রেখেছি ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। ওই বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরিতে এখন আমি হাত দিয়েছি। আগামী বইমেলার আগেই যাতে পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে পারি এটাই এখন আমার একমাত্র লক্ষ।
প্রায় পনের বছর হলো মদ্য পান, ধূমপান ও জুয়া খেলা ছেড়ে দিয়ে প্রায় ঋষির জীবন যাপন করছি। বর্তমানে আরও এক নতুন নেশায় মজেছি, তার নাম ‘ফেসবুক’।
বি:দ্র: ‘মাতৃহীনতার বেদনাই আমাকে কবি করে তুলেছে’- এই শিরোনামে সাক্ষাৎকারটি কালের কণ্ঠ’র শিলালিপি’তে ছাপা হয়েছে গত মে মাসে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১২ সকাল ১১:৫১