তিনি ছিলেন এক সময়ের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি ছিলেন সেই নারী, যিনি অফিসের চেয়ারে বসে দেশ চালাতেন আবার অফিসের বাইরেও সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমনকি বিরোধী দলের বাথরুমেও কী হচ্ছে, তাও তার গোয়েন্দারা রিপোর্ট দিতো। আজ তিনি সেই দেশেরই একজন পলাতক নাগরিক, ভারতের গেস্ট হাউসে একজন অবাঞ্ছিত 'মেহমান'। ইতিহাস, এই নির্মম অথচ ন্যায্য বিচারক, শেখ হাসিনাকে এখন এক বিচ্ছিন্ন চরিত্রে রূপ দিয়েছে—যার পাশে ক্ষমতাও নেই, দলও নেই, ভক্তও নেই।
শেখ হাসিনা এখন কেবল একটি অতীত। সময়ের সেই ক্ষমতাবান কণ্ঠস্বর এখন সীমান্তের ওপারে কেবল ফিসফিস করে। শোনা যায়, তিনি এখন নিয়মিত ফোন করেন তার ধ্বজ্জভংগ সহকর্মীদের। বলেন, “আমি আবার আসবো। সব ঠিক হয়ে যাবে।” কিন্তু সেই আশ্বাস এখন এতটাই গীতিকবিতার মতো শুনায় যে, দলের লোকেরাও সেটি নোটিফিকেশন স্কিপ করে দেন। একসময় যারা 'হাসিনা' বলতেই জোশে গলা চড়াতো, তারাই এখন প্রোফাইল পিকচারে নতুন পতাকা লাগিয়ে ফেলেছে। কেউ জামাতের হেডকোয়ার্টারে ঝাড়ু দিচ্ছে, কেউ বি এন পি-তে চায়ের কাপ এগিয়ে দিচ্ছে।
তার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার নাটকও ছিল যথেষ্ট নাটকীয়। ৪ থেকে ৫ আগস্ট, অজিত দোভালকে একাধিকবার ফোন করে তিনি বুঝাতে সক্ষম হন যে গণভবনের চারপাশে যেভাবে ‘বাতাস’ ঘোরাফেরা করছে, তাতে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সেনাবাহিনীও তাকে “গুড লাক” জানিয়ে নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এমনকি দিল্লিকেও তিনি বুঝাতে পেরেছিলেন, “আমি থাকলে আপনাদের লাভ”—দিল্লি তখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি এই লাভটা আসলে কার জন্য।
তার অনুপস্থিতিতে দেশে যা হয়েছে, তা আসলে তার ‘সাজানো বাগানের’ বিলুপ্তি। ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি এখন আর কোনো ইতিহাস নয়, বরং একটি সাবেক ‘ক্ষমতার জাদুঘর’ হয়ে গেছে। নতুন সরকার, নতুন প্রশাসন, নতুন গল্প। ড. ইউনূসের সরকারের কাছে এখন হাসিনার প্রত্যর্পণ ইস্যু ঠিক যুদ্ধবন্দি ফেরত আনার মতোই একটি ‘কাঁটা’। মোদির সঙ্গে বৈঠকে ইউনূস নাকি বিষয়টি তুলেছিলেন, কিন্তু মোদি কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। বলেছিলেন, “উনি তো এখন আর আপনার সমস্যা না, উনি আমাদেরও সমস্যা।”
আওয়ামী লীগ ? সেটা এখন ইতিহাস বইয়ের একটি চ্যাপ্টার। কেউ কেউ এখনো বিশ্বাস করতে চায় এই দল ফিরে আসবে, কিন্তু তারা সংখ্যায় এত কম যে ফেসবুকেও এক পোস্টে ২০টা রিঅ্যাকশন পর্যন্ত পায় না। কেউ কেউ আবার ভাবছে দল নিষিদ্ধ হবে, কেউ ভাবছে রেজিস্ট্রেশন বাতিল হবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে—দলটি এখন ‘লিডারলেস’। আর শেখ হাসিনা, তিনি নেতৃত্ব ছাড়তে রাজি নন, এমনকি নিজের সন্তানকেও না।
নির্বাচনের প্রসঙ্গেও ধোঁয়াশা। নির্বাচন কমিশন এখনো সরকার থেকে সবুজ সংকেত পায়নি। গুছানো নির্বাচনের দাবিতে খসড়া ফাইল পড়ে আছে প্রফেসর ইউনূসের ডেস্কে, ঠিক যেমন করে কোনো পুরোনো পত্রিকায় হাসিনার বক্তৃতা পড়ে থাকে অলস লাইব্রেরিতে।
সব মিলিয়ে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন একটি ইতিহাসের রেফারেন্স মাত্র—যেখানে ক্ষমতার পিরামিড ভেঙে পড়ে একাকী একজন মানুষ বাঁচার লড়াই করছেন। তিনি কি ফিরবেন? কেউ জানে না। তবে ইতিহাস একটাই বলছে—ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, এবং যারা ইতিহাসকে পাত্তা দেয় না, তারা অবশেষে ইতিহাসেই হারিয়ে যায়।
শেখ হাসিনা এখন ইতিহাসের পাতায় এক ক্লান্ত মেহমান। প্রশ্ন শুধু, এই পাতা আবার খোলা হবে কি ? নাকি চিরতরে বন্ধ?
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১০:০৬