somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পঁচিশে পা এবং শৈশবকথন

২৫ শে আগস্ট, ২০১২ দুপুর ২:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সময়ের হিসাবটা বড়ই গোলমেলে। প্রবাসে থাকা প্রিয়জনের জন্য বছর দুয়েক অপেক্ষার সময়টা মনে হয় অনন্তকাল আর স্কুল লাইফ,কলেজ লাইফ পেরিয়ে এসে পিছন ফিরে তাকালে মনে হয় এই তো সেদিন স্কুলে গেলাম । গত পরশুদিন পঁচিশ বছর পূর্ণ হলে হঠাৎ মনে হল, গড়পড়তা জীবনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ সময় পার করে ফেলেছি ! কি অদ্ভুত ! কবে কবে বড় হয়ে বুড়ি হতে শুরু করেছি ! অনেক বছর পর ,মনে হয় দশ বছর পর বাসায় বার্থডে পেলাম। বাবা মা ছাড়া আর যেই মানুষগুলোর সাথে আমার শৈশব কেটেছে, ওইদিন আবার তাদের সাথে দেখা হল অনেকদিন পর। হুড়মুড় করে একগাদা স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এই মানুষগুলো না থাকলে হয়ত ছোটবেলাটা নিতান্ত ঘরবন্দী সাদামাটা কাটাতে হত। আমাদের মানুষ করার জন্য মায়ের পড়াশুনাটাও হয়ত হতনা। তাই এই প্রিয় মানুষগুলোর কাছে বড় বেশি দায়বদ্ধ আমি।


আমার যখন জন্ম ,আমার মা তখন কলেজে পড়তেন। আমাকে পাশের বাসার দাদীর ( বাবার বেশ দূর সম্পর্কের চাচী) কাছে রেখে মা কলেজে যেতেন। ছোটবেলায় যতটুকু আমাদের বাসায় কাটিয়েছি তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি আমি কাটিয়েছি দাদীর বাসায়। দাদীর চার মেয়ে, এক ছেলে। বড় আন্টির বিয়ে হয়েছিল আর বাকি সবাই তখন ছোট ,বড় ,মাঝারি । মেজ আন্টি আফরোজা, সেজ সায়রা, ছোট আন্টি রশিদা আর আংকেল আনোয়ার। রশিদা আন্টি আর আনোয়ার আংকেল আমাদের খেলার সাথী ছিল,আমার চেয়ে মাত্র পাঁচ ছয় বছরের বড়।


লিকলিকে সেজ আন্টি সায়রাকে আমরা সবচেয়ে বেশি পছদ করতাম। আমরা মানে আমি আর ছোটবোন দিবা। তখন বিটিভিতে কি যেন একটা নাটকের ডায়লগ ছিল "ধুর মিয়া" । সেই শুনে আমরা সায়রা আন্টিকে "মিয়া আন্ট" বলে ডাকতাম। আর রশিদা আন্টিকে খেপানোর জন্য ওশিদা ! মা কলেজ থেকে বাড়ি ফিরলে আন্টিরা বাসায় নিয়ে যেতেন। উনাদের দেখাদেখি মাকে আমিও নাকি ভাবী ডাকতাম। দরজা খুলতে দেরী হলে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতাম আর মুখে বলতাম, " ভাবী, ভাবী, দরজা খোল "


মা বাসায় থাকত না আর আমরা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতাম। খুব কাছেই ছিল নদী। রশিদা আন্টি , আনোয়ার আংকেল আমরা সারাদিন মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতাম, ঘণ্টা খানেক নদীতে ঝাপাঝাপি করতাম আর দাদীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়িতে ঢুকে শুকনা জামাকাপড় পরে নিপাট ভালমানুষের মত সামনে আসতাম। খেতে বসলেই কিছুক্ষন পর দিবাকে আংকেল বলত, দিবা দেখ তো, পেয়ারা গাছে একটা পাখি। দিবা যেই তাকাত, অমনি আংকেল ওর পাত থেকে মাছ,মাংস,তরকারি কিছু একটা তুলে নিত । অনেকক্ষণ পর দিবা সেটা বুঝতে পেরে শুরু হত মারামারি। মিনিপ্যাকেট সাইজের দিবাকে আংকেল মারত না কখনোই, বরং সব মার হজম করতে হত। নাইলে দিবা দাদাকে বলে দিলে দুই দফা মার খাওয়া লাগত।


আমি ছোটবেলা থেকেই আমার বয়সের বাচ্চাদের তুলনায় সাইজে দেড়গুণ ( দৈর্ঘ্যে না ,প্রস্থে ) আর দিবা ছিল ওর বয়সী বাচ্চাদের অর্ধেক। জন্মের সময় ওর ওজন নাকি ছিল দুই কেজি ! তাই আমি ভাবতাম দিবা জন্মাইছে মামনির পেট থেকে আর আমি বাবার বিশাল ভুড়ি থেকে !তো যা বলছিলাম, আমার সাইজের কারনেই অন্যান্য বাচ্চারা আমার সাথে বেশি তেড়িবেড়ি করতনা। এমনিতে নাকি আমি বেশ শান্তই ছিলাম, কিন্তু আমাদের বাসায় কোন নাদুস নুদুস বাচ্চা এলে চলে যাওয়ার সময় চিমটি কাটা নাকি আমার খুব প্রিয় একটা কাজ ছিল ! একবার কি জন্য কাঁদতে কাঁদতে দম আটকে গিয়েছিল। মা ভেবেছিলেন আমি মারা গেছি। সেই থেকে মা বাবা কেউ আমাকে বকাও দেয়না বেশি আর মারেওনা কখনো । এইজন্য আমি মোটামুটি লাটসাহেবের মত ঘুরে বেড়াতাম। এমনিতে কারো সাথে ঝগড়াঝাঁটি আর মারামারির ভার ছিল দিবার উপর, সে প্রবল উৎসাহে এই কাজগুলো করে বেড়াত। তবে দিবাকে একবার আমাদের পাশের বাড়ির রাজন ভাইয়া মেরেছিল বলে আমি তার হাত কামড়ে রক্ত বের করে দিয়েছিলাম খুব বেশি রেগে গিয়ে। দিবার আরও কিছু কাহিনী লিখার ইচ্ছা ছিল,কিন্তু দিবা আমাকে এইবার আল্টিমেটাম দিয়েছে। "ডেইলি প্যাসেঞ্জারে" আমি নাকি ওর প্রেস্টিজ পাংচার করে দিয়েছি,তাই ওর গুন্ডামির কথা আর লিখা যাবেনা । এইজন্য ক্ষান্ত দিলাম ।


সায়রা আন্টির বিয়ের দিন আমাদের খুব মন খারাপ হয়েছিল সায়রা আন্টি চলে যাবে বলে। তাই আমাদের সব রাগ গিয়ে পড়েছিল উনার জামাইয়ের উপর । রশিদা আন্টি ,আনোয়ার আংকেল আর আমরা একটা ব্যাঙ ধরে তাই ছেড়ে দিয়েছিলাম জামাইয়ের পাতে। আর দিবা বাবার ওষুধের বাক্সের টিংচার আয়োডিন ( পানি দিলে বেগুনী হয়ে যেত) নিয়ে জামাই বাবাজীর টাকে মাখিয়ে দিয়েছিল। জামাই বাবাজী সেদিন নিশ্চয় টের পেয়েছিলেন বিয়ের কি জ্বালা !


রশিদা আন্টির বিয়ের পর আমরা মোটামুটি এতিম হয়ে গেলাম। রশিদা আন্টি মানেই ছিল হাসি ঠাট্টা, ফাজলামি আর মানুষের হাড় জ্বালাতন। ছোটবেলায় আন্টির সাথে আমরা ঈদগাহে যেতাম, ফেরার সময় বাঁশি, বুনবুনি( টিকটিকির ডিমের মত দেখতে সাদা গোল লজেন্স ), আলুর চিপস নিয়ে ফিরতাম। আর ঈদের আগেরদিন চাঁদ দেখে সবাইকে সালাম করে বেড়াতাম যাতে পরদিন সালামি দেয়ার কথা সবার মনে থাকে ।আমাদের সব বাদরামির সঙ্গী দলছুট হওয়াতে আমরা শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াতাম আর দাদীকে মনে মনে গাল দিতাম খুব।


তার কিছুদিন পরেই ক্যাডেট কলেজে চলে গেলে শৈশব অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল আমার। তারপর ছুটিতে বাড়ি এলে কোন কোন বার আন্টিদের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে, কিন্তু আর একসাথে হওয়া হয়নি। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেন পরশুদিন আমার জন্মদিনে আবার সব আন্টি আর আংকেল দের একসাথে দেখতে পেলাম।আমি বাড়িতে আছি আর ঈদ পর দাদীর সব নাতি নাতনীর স্কুল ছুটি দেখে আমার জন্মদিনে দাদী আন্টিদের ডেকে এনেছিলেন বাড়িতে। আমার জন্য এইবারের জন্মদিনের সবচেয়ে বড় গিফট ছিল এইটা। সব আন্টি রা নিজের ছেলেমেয়ে , সংসার নিয়ে ব্যস্ত , তারপর ও আমাকে কাছে পেয়ে তারাও ফিরে গিয়েছিল পনের বিশ বছর আগে। বড় আন্টি দুইবার স্ট্রোক করে , ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় এখন অন্ধ। আমাকে বুকে নিয়ে যখন ছুঁয়ে অনুভব করতে চাইছিলেন, গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে গেল। সেজ আন্টি সবচেয়ে ছোট ছেলেটাকে যখন আমাকে দেখিয়ে বললেন, এইটা তোমার বড় আপু। তখন মনে হল,এমন তো হবার কথা ছিল না। খুব বেশি দূরে চলে গেছি বোধ হয়,তাই এই ভাইবোনগুলোকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া লাগে । দাদাকে ছোটবেলা থেকেই "শালা " বলে ডাকি। প্রতিবার বাড়িতে গিয়ে যতক্ষন দাদার সাথে দেখা না করি ততক্ষন দাদা বারবার দাদীকে বলে, এখনো তো আসল না । যাওয়ামাত্রই সামনের দুটো দাঁত পড়ে যাওয়া ফোকলা দাদা এত সুন্দর একটা অপার্থিব হাসি দেয়, মন নিমেষেই শরতের সাদা মেঘ।


ছোটবেলায় দাদী দোয়া করার সময় বলতেন,আমার সুষমা দিবা দুধে ভাতে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাক। এখন প্রতিনিয়তই আমার মনে হয়,এই প্রিয়মানুষগুলো ও সবসময় দুধে ভাতে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাক ...
৩৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ: ব্যাংককে মোদি-ইউনূস বৈঠক

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৪:৪০

[


ছুটির দিনে সুন্দর একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে, যা আমাদের এই অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনবে, ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের বিরোধিতাকারীদের মুখে ঝামা ঘঁষে দেবে এবং জঙ্গীদের ঘুম হারাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিবাদ: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিকৃত চিত্রণ ও দালালি মানসিকতার জবাব

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৫

প্রতিবাদ: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিকৃত চিত্রণ ও দালালি মানসিকতার জবাব

ছবি প্রথম আলোর সৌজন্যে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে আজ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনুসের দ্বিপাক্ষিক একটি বৈঠক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার জুলভার্নের কাউন্টার পোস্ট

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২৮

১। কমিশন বলছে, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এইসব রাষ্ট্র বা সংবিধানের মূলনীতিতে থাকবে না।
বিএনপি বলছে, থাকবে সব আগের মতোই।

২। কমিশন বলছে, প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের প্রধান ও সংসদ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার বড্ড ক্ষুধা পায়ঃমানুষের জন্য

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:৫৯




শুধু খাবারের জন্য ক্ষুধার্ত নই আমি,
কখনো কখনো ক্ষুধা পায়
স্মৃতির কুয়াশায় হারানোদের জন্য।
একটি হৃদ স্পন্দন থামিয়ে দেয়া
যাদুকরি কন্ঠের জন্য,
একজোড়া চঞ্চল চোখের চঞ্চলতার জন্য,
একটা উষ্ণ হাতের উষ্ণতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর পর যা হবে!

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১০:৪২



বেহেশত বেশ বোরিং হওয়ার কথা।
হাজার হাজার বছর পার করা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। দিনের পর দিন একই রুটিন। এরচেয়ে দোজক অন্য রকম। চ্যালেঞ্জ আছে। টেনশন আছে। ভয় আছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×