ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে আজ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনুসের দ্বিপাক্ষিক একটি বৈঠক হয়েছে। ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতনের পরে দীর্ঘ প্রায় ৭ মাসের মাথায় দুই প্রতিবেশী দেশের প্রধানদের এই বৈঠক বিবিধ কারণে গুরুত্ববহ। উভয়ের এই বৈঠক নিয়ে সামুতে বাংলাদেশী পরিচয়ে একজন মনের মাধুরি মিশিয়ে একটি লেখা লিখেছেন। তার লেখাটি পড়ে মনে হয়েছে, তিনি নিজের বাংলাদেশী পরিচয় দিলেও ভারতীয় আধিপত্যবাদী মনোভাবকে সাদরে গ্রহণ করেছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীন চিন্তা-চেতনাকে "ভারত-বিরোধিতা" বলে আখ্যায়িত করে নিজের দালালি স্পষ্ট করেছেন। তাঁর লেখার প্রতিটি বাক্য যেন ভারতীয় কর্তৃত্বকে প্রমোট করার জন্য এক অদ্ভুত মানসিক দাসত্বের পরিচয় দেয়। নিচে তাঁর ভ্রান্তিগুলোর জবাব দেওয়া হলো:
১. "ভারতের সাথে শত্রুতা নয়, বন্ধুত্বই কাম্য"—এ কথার আড়ালে কী লুকিয়ে?
লেখক বারবার বলেছেন, "ভারতের সাথে শত্রুতা করা উচিত নয়"। কিন্তু প্রশ্ন হলো— কে শত্রুতা করছে? বাংলাদেশের স্বাধীন নীতি নির্ধারণ, নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা এবং প্রতিবেশীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করাকে কি "ভারত-বিরোধিতা" বলা যায়? ভারত যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে (যেমন: নির্বাচনে প্রভাব, গুপ্তচরবৃত্তি, সীমান্তে গুলি করে পাখির মত বাংলাদেশীদের হত্যা), তবে তার প্রতিবাদ করাই স্বাধীন দেশের কর্তব্য। লেখক যেন মনে করিয়ে দিতে চান, "ভারত যা চায়, তাই মেনে নাও—নইলে শাস্তি পাবে!"
২. "মোদি-ইউনূস বৈঠক = বাংলাদেশের আত্মসমর্পণ"—এ কী অদ্ভুত যুক্তি?
লেখক আনন্দে নেচে উঠেছেন এই ভেবে যে, প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের সাথে মোদির দেখা হওয়ায় "জুলাইপন্থীরা" (যারা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে) হতাশ হয়েছে। কিন্তু এটি কি আদৌ রাজনৈতিক বৈঠক ছিল? নাকি একটি প্রোটোকল সৌজন্য সাক্ষাৎ মাত্র? প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ ইউনূস একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, তাঁর সাথে বৈঠককে ভারতের "বন্ধুত্বের জয়" বলে চালানো কতটা হাস্যকর? যদি এতেই বাংলাদেশের "আত্মসমর্পণ" হয়, তাহলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কি এতটাই হীনম্মন্য যে একটি সাধারণ সাক্ষাত্কারেই তাঁর "জয়গান" করতে হবে?
৩. "শেখ হাসিনা ভারতের দালালি করেছেন, তাই তিনিও ভালো"—এ যুক্তির অসারতা
লেখক শেখ হাসিনার "ভারত-সমর্থক" নীতিকে যুক্তি দিয়েছেন এভাবে: "ভারতের সাথে বন্ধুত্ব রাখলে শান্তি থাকে, না রাখলে শাস্তি পেতে হবে।" কিন্তু এটা কোন যুক্তি? একটি স্বাধীন দেশের নীতি কি প্রতিবেশীর "ভয়" দিয়ে নির্ধারিত হওয়া উচিত? লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতি ও স্বৈরাচারের কারণে তিনি বিদেশে পালিয়েছেন। তাহলে ভারতের সমর্থন পেয়েও তিনি কেন জনগণের সমর্থন হারালেন? কারণ, ভারতের অজিত দোভালদের চাপে চলা সরকার কখনই স্থায়ী হয় না।
৪. "ভারত-বিরোধীরা জঙ্গি, পাকিস্তানি এজেন্ট"—এ কেমন প্রোপাগান্ডা!
লেখক বাংলাদেশের সকল ভারত-সমালোচনাকে "জঙ্গিবাদ" বা "পাকিস্তানি প্রোপাগান্ডা" বলে চালিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, বুদ্ধিজীবী—যারা ভারতের সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য বৈষম্য, ফারাক্কা বাঁধের বিরোধিতা করে, তারাও কি জঙ্গি? ভারত যদি সত্যিই বন্ধুত্বপূর্ণ হতো, তবে তিস্তার পানি চুক্তি, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, অস্ত্র ও গুপ্তচরবৃত্তি কমাতে পারত। কিন্তু লেখকের মতে, "ভারত যা দেবে, তাই নিতে হবে—প্রতিবাদ করলে তুমি জঙ্গি!"
৫. "চা বিক্রেতা" বিতর্ক: শ্রেণীঘৃণা নাকি লেখকের মানসিক দাসত্ব?
লেখক মোদিকে "চা বিক্রেতা" বলার সমালোচনা করেছেন, কিন্তু মোদি নিজেই তাঁর বাবার চায়ের দোকানের গল্প গর্ব করে বলেন! তাহলে এটা নিয়ে হাসি-তামাশা কেন? কারণ, লেখকের আসল উদ্দেশ্য— "মোদিকে সমালোচনা করো না, তিনি এখন 'বড়লোক'!" এখানে শ্রেণীঘৃণা নয়, বরং লেখকের মানসিকতাই প্রকাশ পেয়েছে— "যারা নীচু থেকে উঠে এসে ক্ষমতায় যায়, তাদের সমালোচনা করা যাবে না!"
৬. "ভারতের দালালদের শেষ যুক্তি: 'না মানলে শাস্তি পাবে!'"
লেখকের মূল বক্তব্য: "ভারতের সাথে শত্রুতা করে লাভ নেই, কারণ তারা শক্তিশালী।" অর্থাৎ, দুর্বলের ন্যায্য দাবি নয়, শক্তির দাপটই শেষ কথা! এটাই কি বাংলাদেশের স্বাধীন চেতনা? পাকিস্তানের শাসনামলে বলা হতো— "পাকিস্তানের বিরোধিতা করো না, তারা বড় শক্তি!" আজ লেখক সেই একই যুক্তি দিচ্ছেন, শুধু "পাকিস্তান" এর জায়গায় "ভারত" বসিয়ে।
শেষ কথা: দালালি নয়, স্বাধীন চিন্তাই মুক্তির পথ
লেখক হয়তো ভাবেন, ভারতের গলগ্রহ হয়ে তিনি "বুদ্ধিমান" এর ভূমিকায় আছেন। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, যারা পরাশক্তির দালালি করে, তারা শেষমেশ সেই পরাশক্তিরই ভোগ্য পণ্যে পরিণত হয়। বাংলাদেশের মানুষ চায় না পাকিস্তানি বা ভারতীয় প্রভু—তারা চায় একটি স্বাধীন, স্বাধিকারসম্পন্ন বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে, ভয় বা দাসত্বের ভিত্তিতে নয়!
"ভারত যদি সত্যিকার বন্ধু হয়, তবে সে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করবে—নয়তো যে কোনো ধরণের আগ্রাসনের জবাব দিতে স্বাধীনচেতা বাংলাদেশর দামাল সন্তানেরা বুক চিতিয়ে প্রতিরোধের অপ্রতিরোধ্য ব্যুহ তৈরি করে দেশ মাতৃকার সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে সদা প্রস্তুত।"
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৮