(১.) ‘বিজয় নিশান, উড়ছে ঐ ’- যে গান দিয়ে শুরু হয় প্রতি বিজয় দিবসে আমার সকাল
বলা যায় বিষয়টা এখন আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বিজয় দিবসের সকাল মানেই আমার পিসির সিডিরমে ঠাঁই করে নেবে বিশেষ একটি সিডি। এ সিডিতে রেকর্ড করা আছে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট এর উদ্যোগে সুরকার সমর দাশের সংগীত পরিচালনায় নতুন করে রেকর্ডকৃত এবং তৎকালীন সময়ে একটি STEREO লং প্লে রেকর্ডে প্রকাশিত স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো।
সিডি থেকে গানগুলো বাজানোর সময় আমার সারা শরীরে একটা অন্যরকম শিহরণ অনুভব করি। সিডি থেকে একটি নির্দিষ্ট গান সিলেক্ট করে আমি আমার বাসার ব্যালকনিতে গিয়ে দাড়াই। যতদূর দৃষ্টি যায় আশেপাশের বাসাগুলোর দিকে তাকাই। অন্যরকম এক শহরের উৎসবময় অন্যরকম এক রাস্তার দিকে তাকাই। চতুর্দিকে শুধু লাল আর সবুজ। ভীষণ গৌরবে সারা শহরময় উড়ছে বিজয় দিবসের উজ্জল আনন্দের পতাকা। ঠিক সেই মুহূর্তে কম্পিউটার থেকে শুরু হয়ে যায় আমার নির্বাচিত প্রথম গান- ‘বিজয় নিশান, উড়ছে ঐ, খুশীর হাওয়ায় শুধু উড়ছে...... উড়ছে উড়ছে উড়ছে, বাংলার ঘরে ঘরে.....।’.... হ্যা, এই গানটিই সবচেয়ে বেশী আন্দোলিত করে আমাকে প্রতি বিজয় দিবসের সকালে। এটি দিয়েই শুরু হয় আমার বিজয় দিবসের সকাল।
গানটির মধ্যে কী যাদু আছে তা বিধাতাই জানেন। তবে গানের মধ্যে কোরাস কণ্ঠে যখন ঐ লাইনটা পরপর তিনবার উচ্চারিত হয় -
‘মুক্তির আলো ঐ ঝরছে... মুক্তির আলো ঐ ঝরছে... মুক্তির আলো ঐ ঝরছে...’ তখন আমার সারা শরীর কেঁপে ওঠে । আমি যেন সারা শহরময় দেখতে পাই সেই মুক্তির আলো ঝরে পড়ার অসামান্য দৃশ্য কণিকা।
(২.) সালাম সালাম হাজার সালাম- আব্দুল জাব্বারের বেদনার্ত কণ্ঠের অসাধারণ শ্রদ্ধাঞ্জলী
মুক্তিযুদ্ধের গান শুনতে বসেছি, অথচ আব্দুল জাব্বারের বেদনার্ত ভরাট কন্ঠের ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি শুনবোনা এটা ভাবাই যায়না। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট এর উদ্যোগে প্রকাশিত STEREO লং প্লে রেকর্ডে আব্দুল জাব্বারের কণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধের বহুল আলোচিত এ গানটি নতুন করে রেকর্ড করার উদ্যোগ নেন ঐ লং প্লে রেকর্ড বের করার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগীত পরিচালক বিশিষ্ট সুরকার সমর দাশ।
আমার যতোদূর মনে পড়ে তখনকার সংবাদপত্রের রিভিউ থেকে জেনেছিলাম আব্দুল জাব্বার সে সময়ে বেশ অসুস্থ থাকায় গানটি রেকর্ডিং এর ক্ষেত্রে অনেকবারের চেষ্টার পর OK হয়। গায়ক আব্দুল জাব্বারের সামনে তখন ছিল বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। গান হতে হবে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তার এ গানের প্রথম রেকর্ডর মতোই দরদ-সমৃদ্ধ আবার একই সাথে STEREO পদ্ধতিতে অত্যাধুনিক সিস্টেমে রেকর্ডিং করা হবে বলে সকল ট্রাকে সংযুক্ত মিউজিক ছাপিয়ে তার কন্ঠস্বর উপরে উঠতে হবে, নইলে গানটি মার খাবে।
অতঃপর অসুস্থ অবস্থায় থেকেও কেমন গাইলেন নতুন করে আব্দুল জাব্বার তার সেই বিখ্যাত গান? যদি আপনার কম্পিউটারে Sub-Woofer Speaker থেকে থাকে, যদি আপনার কম্পিউটারের Media Player -এর Equalizer ব্যবহার করার বিষয়ে আপনার মোটামুটি ধারণা থাকে, তবে একদিন শুনে দেখুন আব্দুল জাব্বারের বেদনার্ত ভরাট কন্ঠের সেই নতুনভাবে রেকর্ডকৃত গানটি।... বলা বাহুল্য অনেকেই Mono Player-এ অথবা রেডিওতে নতুনভাবে রেকর্ডকৃত এ গানটি শুনে মন্তব্য করে ফেলেন- গানটি আগের মতো তেমন ভালো হয়নি, কিন্তু আমি এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করি। আব্দুল জাব্বারের নতুনভাবে রেকর্ডকৃত গানটিতেও অসাধারণ দরদের ছোঁয়া পাওয়া যায়।
(৩.) ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ - কোথায় স্বপ্না রায়? কার কাছে আছে আসল রেকর্ড?
এ গান এমন এক গান, যা এ দেশের প্রত্যকটি মানুষ হাজার হাজার বার শুনেছে। লক্ষ কোটি বার এ গান হয়তো বেজেছে এ দেশের শহর-বন্দর গ্রামে গঞ্জে....। হ্যাঁ, এই গান মুক্তিযুদ্ধের সেই আলোড়ন সৃষ্টিকারী গান -‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলবোনা..’ । গানটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গেয়েছিলেন স্বপ্না রায়। শোনা যায় স্বাধীনতার পর স্বপ্না রায় ভারতে চলে যান। ফলে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট এর উদ্যোগে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো স্থায়ী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নতুনভাবে STEREO লং প্লে তে রেকর্ড করার সময় মুক্তিযুদ্ধের বহুল আলোচিত এ গানটি মূল শিল্পী স্বপ্না রায়ের কন্ঠে রেকর্ড করাতে ব্যর্থ হন সংগীত পরিচালক সুরকার সমর দাশ । তার বদলে বেছে নেওয়া হয় শিল্পী রিজিয়া কাবেরী এবং কোরাসে কন্ঠদানকারী কিছু সহ-শিল্পী। বলা বাহুল্য, গানটি মূল গানের কাছাকাছি হতে পারেনি।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার পর বেতার ও টেলিভিশনে এই ঐতিহাসিক গানটি শাহীন মাহমুদ সহ একাধিক শিল্পীকে দিয়ে বিভিন্নবার বিভিন্নভাবে রেকর্ড করা হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার, স্বপ্না রায়ের সেই অসাধারণ মেলোডিয়াস কন্ঠ ও তাঁর আবেগ আমি আর কোন শিল্পীর গলাতেই খুঁজে পাইনি। এ কারণেই এখনো কোন কোন বিজয় দিবসে যখন বাংলাদেশ বেতার থেকে স্বপ্না রায়ের কন্ঠে সেই মূল গানটি আমি শুনি, মুহূর্তে আমার চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে তা কোনভাবে ক্যাসেটে বা সিডিতে রেকর্ড করা যায় কী না ( এখনো পর্যন্ত তা করতে পারিনি..)।
খুব সম্ভবতঃ মূল গানটি বাংলাদেশ বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে সংরক্ষিত আছে। বাজারে মুক্তিযুদ্ধের গানের যেসব ক্যাসেট বা সিডি পাওয়া যায় তাতে মূল গানটি আমি পাইনি।
(৪.) ‘পূবের ঐ আকাশে সূর্য উঠেছে, আলোকে আলোকময়....’ যে গান হারিয়ে ফেলে আজ পথে পথে খুঁজি...
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী -মার্চ মাসের কথা বলছি। তখন আমি চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্র। স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক কিছুই তখন আমি বুঝি নাই। আমার শুধু মনে আছে, আমাদের ময়মনসিংহের বাসায় তখন প্রতিদিন ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকাটি রাখা হতো (স্বাধীনতার পর এটিই ‘দৈনিক বাংলা’ নামে প্রকাশিত হয়) । সেই পত্রিকায় খেয়াল করেছিলাম -শেষ পৃষ্ঠায় প্রায় অর্ধ পাতা জুড়ে বাটা কোম্পানীর এক বিজ্ঞাপনে একটি গানের বেশ কয়েকটি লাইন দিয়ে ছাপা একটি অভিনব বিজ্ঞাপন। ঐ বিজ্ঞাপনটিতে ঐ গানটির ঐ কয়েকটি লাইন ছাড়া আর কিছুই ছিলনা, শুধু নীচের দিকে তিনবার লেখা ছিল- বাটা, বাটা, বাটা ।
কী ছিল সেই গান? মনে আছে গানের প্রথম কটি লাইন ছিল এরকম-
পূবের ঐ আকাশে সূর্য উঠেছে, আলোকে আলোকময়...
পূবের ঐ আকাশে সূর্য উঠেছে, আলোকে আলোকময়...
জয় জয় জয়, জয় জয় জয়, জয় জয় জয়.... জয় বাংলা..
গানটি শুধু যে পত্রিকার বিজ্ঞাপনেই এলো, তা নয়, একইসঙ্গে গানটি বারবার রেডিও পাকিস্তান, ঢাকায় প্রচার করা শুরু হল (পরে জেনেছি তখন ছিল ফেব্রুয়ারী-মার্চের উত্তাল আন্দোলনের দিন, যার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে পাকিস্তান রেডিওর বাঙালী কর্মকর্তা কর্মচারীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো এ ধরনের উদ্দীপনামূলক সংগীত ও অনুষ্ঠান প্রচার করা শুরু করে..)।
আমার আব্বা তখন একটি অফিসিয়াল ট্যুর শেষে মাত্র তুরস্ক থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি তুরস্ক থেকে ফেরার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছেন একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট Sony ক্যাসেট রেকর্ডার। তখন বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায় আমরা স্পুল রেকর্ডার দেখে থাকলেও আর কোথাও কখনো ‘ক্যাসেট রেকর্ডার’ দেখিনি। তাই নতুন আনা ‘ক্যাসেট রেকর্ডার’ নিয়ে বাসায় শুরু হল নানা গবেষণা। তো গবেষণার এক পর্যায়ে একজনের হাতে লেগে Eject Button এ চাপ পড়তেই ভেতরের ক্যাসেটটি বাইরে বের হয়ে এলো। সাথে সাথে আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম নতুন আনা যন্ত্রটি বোধহয় ভেংগে গেছে।
কিন্তু আমাদের বড়মামা (যিনি তখন কলেজের ছাত্র) আমাদের আশ্বস্ত করলেন। রেকর্ডার-এর সাথে আনা ম্যানুয়াল পড়ে তিনি বের করলেন -যন্ত্রটি আসলে ভাঙ্গে নাই। যেটি বাইরে বেরিয়ে এসেছে সেটার নাম ‘ক্যাসেট’। পরে তুরস্ক থেকে আনা আব্বার স্যুটকেসে এরকম আরো কয়েকটি নতুন Blank ‘ক্যাসেট’ পাওয়া গেল।
এরপর শুরু হল Blank ক্যাসেট- এ কীভাবে গান বা কথা রেকর্ড করা যায় সে গবেষণা। আবারও আমার বড়মামা ম্যানুয়াল পড়ে রেকর্ড করার সব পদ্ধতি বের করলেন। রেকর্ড করার জন্য একটি মাইক্রোফোনও পাওয়া গেল সেটের বক্সের ভেতর।
কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের ভাই বোনদের সবার গান- কবিতা ইত্যাদি রেকর্ড করলেন আমার বড়মামা ( আমার কণ্ঠে তৎকালীন চতুর্থ শ্রেণীর বাংলা বইয়ের অন্তর্ভুক্ত বন্দে আলী মিয়ার ‘ময়নামতীর চর’ কবিতাটি রেকর্ড করা হয়, যা এখনো আমার কাছে সংরক্ষিত আছে )। কন্ঠস্বর রেকর্ড করার যাবতীয় গবেষণা শেষ হওয়ার পর শুরু হল কীভাবে রেডিও থেকে গান রেকর্ড করা যায় সে গবেষণা। কয়েকদিনের মধ্যেই রেডিও থেকে প্রচুর গান রেকর্ড করা হল এবং অতঃপর একদিন রেডিও পাকিস্তান থেকে রেকর্ড করা হল সেই গান -
পূবের ঐ আকাশে সূর্য উঠেছে, আলোকে আলোকময়...
জয় জয় জয়, জয় জয় জয়, জয় জয় জয়.... জয় বাংলা..।
আমরা বারবার ক্যাসেট-রেকর্ডার থেকে Play করে করে শুনি সেই অসাধারণ সুন্দর এক গান। অবশ্য বলা বাহুল্য আমি শুধু গানের সুরের সৌন্দর্য্যটুকুই বুঝতাম, গানের কথার অর্থ আমি তেমন কিছুই বুঝতামনা। তবে আমার বড়বোন, মেঝোবোন ও আমার মামারা তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়ে অনেককিছু আলোচনা করতেন কিন্তু আমি তেমন কিছুই বুঝতামনা...। আমি শুধু বুঝতাম একটি ‘ভয়ের সময়’ আসছে সামনে। সবার কথায়, সবার ফিসফাস আলোচনায় সেই ভয়ের আভাস....।
দুই-আড়াই মাস পরের কথা লিখছি। সম্ভবতঃ মে বা জুন মাস। আমরা সবাই ময়মনসিংহের শহর থেকে পালিয়ে ফুলপুরের ‘বাইটকান্দি’ নামক এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছি। সেখানেও শান্তি নেই। প্রতিদিন ভয়ের খবর আসে, আগামীকালই পাকিস্তান আর্মি আসছে এ গ্রামে! কারোর আর রক্ষা নেই। আমরা ভয়ে হিম হয়ে যাই। আমাদের ভয়ের নানা কারণের মধ্যে আরেকটি বড় কারণ হলো ক্যাসেটে রেকর্ড করা সেই গান-
পূবের ঐ আকাশে সূর্য উঠেছে, আলোকে আলোকময়...
জয় জয় জয়, জয় জয় জয়, জয় জয় জয়.... জয় বাংলা..।
আমার বড়পা বার বার বলতে লাগলেন, এই গান আর রাখা যাবেনা। এটা ক্যাসেট থেকে মুছে ফেলতে হবে। যদি পাকিস্তান আর্মি এসে জিনিষপত্র চেক করতে গিয়ে এই ক্যাসেট খুঁজে পায় এবং By chance যদি কৌতুহলবশতঃ এ ক্যাসেট শুনতে গিয়ে এর ভেতরে এরকম মুক্তিসংগ্রাম সংক্রান্ত একটি গান খুঁজে পায়-তাহলে আমাদের কাউকে আর আস্ত রাখবে না- সবাইকেই মেরে ফেলবে।
আমি তখন অতশত ভয়ের ব্যাপার বুঝি না। আমি বার বার গানটিকে রাখতে চাইলাম। মেঝপাও আমাকে সমর্থন দিয়ে গানটি রাখতে চাইলো। কিন্তু এরপর একদিন যখন চূড়ান্ত খবর এলো যে পাকিস্তান আর্মি আগামীকাল এ গ্রামে আসছে, তখন বড়পা আর সাহস রাখতে পারলোনা। সে সেই রাত্রিতেই গানটি মুছে ফেললো ক্যাসেট থেকে।
ব্যস, সেই শেষ। গানটি হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে চিরতরে।
এরপর স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর পেরিয়ে গেলো দীর্ঘ আটত্রিশ বছর ! এখনো কোথাও মুক্তিযুদ্ধের গানের ক্যাসেট দেখলে, সিডি দেখলে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি তা সংগ্রহের জন্য। একুশের বইমেলা, বাংলা একাডেমী, বৈশাখী মেলা, গীতালি, গানের ডালি- কতো শত দোকানে আমি বারবার খুঁজেছি সেই হারিয়ে ফেলা স্মৃতিময় গান। কিন্তু নেই ! কী আশ্চর্য্য ! কোথাও এ গানটি নেই !
অনেকের সাথে কথা বলে দেখেছি, অনেকেই এ গান সম্পর্কে জানেন বা গানটির কথা সম্পর্কে অবহিত আছেন, কিন্তু ৭১ এর ফেব্রুয়ারী-মার্চের উত্তাল দিনগুলোর সাথে ঘনিষ্টভাবে জড়িত এ গানটি কেন কোথাও আজ আর নেই, তা জানেন না কেউই। এমনকি স্বাধীনতার পর এতোবার মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো রেডিও টেলিভিষণে রিমেক হয়েছে, সেখানেও আমি কখনো এ গানটি রিমেক হতে বা অন্য কারো গলায়ও রেকর্ড হতে শুনিনি।
মুক্তিযুদ্ধের গান বিষয়ে এই স্মৃতি আর বেদনার একান্ত অনুভব শুধু আমিই একা একা বয়ে বেড়াই। ১৯৭১-এ চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া একজন মানুষের স্মৃতিতে কেন আটত্রিশ বছর ধরে একটি হারিয়ে ফেলা গানের লাইন মনে রয়ে গেল সেটিও হয়তো এক গবেষণারই বিষয়....। কেননা কিছুদিন আগে সেই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখি আমার বড়পা গান রেকর্ড ও মুছে ফেলা সংক্রান্ত সেইসব ঘটনাগুলো আর মনে করতে পারছে না...। এমনকি ঐ গানটা যে বড়পাই শেষপযর্ন্ত ক্যাসেট থেকে মুছে ফেলেছিল, সেটাও এখন আর তার মনে নেই....।
কী আশ্চর্য্য ! একই সময়ের একই ঘটনা একজন কতো সহজেই ভুলে গেছে, আর একজন মনে রেখে দিনের পর দিন পথে প্রান্তরে খুঁজে ফিরছে সেই গান।
এখনো স্বপ্ন দেখি, হয়তো হঠাৎ একদিন আলোকে আলোকময় হয়ে এ পৃথিবীতে নতুন এক সূর্য্য উঠেছে ! হয়তো সেদিন আমি অজানা এক আত্ম-অভিমানে ভুগে এই যন্ত্রনার শহর ছেড়ে দূরের এক গ্রামে গিয়ে হাজির হয়েছি। হয়তো হাঁটছি গ্রামের এক মেঠোপথ দিয়ে। গ্রামের এক চা-দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে হঠাৎ কানে ভেসে এলো কয়েকটা লাইন......
বুলিবুলিকে ধান দেবো আদর সোহাগ করে
সেইতো আমার খাজনা দেওয়া ভালবাসায় ভরে...
দস্যুগুলো পালিয়ে গেছে আজ আর কোন কথা নয়
জয় জয় জয়, জয় জয় জয়, জয় জয় জয়.... জয় বাংলা..।
পূবের ঐ আকাশে সূর্য উঠেছে, আলোকে আলোকময়...
জয় জয় জয়, জয় জয় জয়, জয় জয় জয়.... জয় বাংলা..।
আমি ছুটছি। দৌড়াচ্ছি। কিসের সাথে যেন ধাক্কা খেয়ে বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছি। কিন্তু তারপরেও পরমুহূর্তেই আবার উঠে দৌড়াচ্ছি। আবার ছুটছি! আবার দৌড়াচ্ছি!
আমাকে পৌঁছাতেই হবে ! আমাকে পৌঁছাতেই হবে এই ফিরে পাওয়া সুরের কাছে ! এই গানের কাছে!
এইতো সেই গান! এইতো সেই গান!!
.....................................................................................
( চলবেঃ লেখাটি তিন পর্বে সমাপ্য)