শুক্রবারের সকাল, রাস্তাঘাটে লোকজন কম, তবে রোদ বেশ চড়া। এল কাহিরাহতে আমার শেষ দিন কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। ঘোরার তালিকায় আছে স্বপ্নের পিরামিড, স্ফিংস আর গ্রেট ইজিপশিয়ান যাদুঘর যেখানে নাকি ফেরাউনের লাশ সংরক্ষিত আছে! কড়া একটা নাশতা খেয়ে রাস্তার ওপর দাড়ালাম, কিছুক্ষণ পর মোটামুটি ফাকা একটা মাইক্রোবাস এসে দাড়াল। আরবীতো পারি না, শুধু বললাম, গিজা, পিরামিড। প্রসংগত, পিরামিড গিজা (ম্যাপের আরবী দেখে বুঝলাম, আসলে এটার উচ্চারণ হবে জিজা, Giza) এলাকায় অবস্থিত। ড্রাইভার পালটা প্রশ্নসূচক কন্ঠে বলে উঠল, হারাম?? তখনই মনে পড়ল গতকাল গুগল ম্যাপে দেখেছিলাম, পিরামিডের লোকেশনের ওখানে লেখা আছে, “এল হারাম এল কাবির ফিল জিজা”। বুঝলাম পিরামিড আর স্ফিংসকে এরা হারাম বলে। আরবী এই হারাম শব্দের অর্থ “পবিত্র”। যেমনটা মক্কা এবং মদিনার দুই গ্র্যান্ড মসজিদকে “মাসজিদুল হারাম” বলা হয়।
গাড়ি ছুটে চলল দুর্বার গতিতে, রাস্তাঘাট ফাকা, আর আমিও সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছি। কিন্তু ওদিকে সূর্য মামার তেজ এই সকাল নয়টাতেই প্রবল। এক ফ্লাইওভারের নীচে মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড টাইপের এক জায়গায় এসে ঐ মাইক্রোবাসের যাত্রা শেষ হয়ে গেল। ভাড়া নিল মাত্র ৫ পাউন্ড। আমি বলি, পিরামিড কই ভাই? ড্রাইভার আরবীতে এবং ইশারায় যা বোঝাল, সামনে যাও, ওখানে প্রধান সড়কে গিয়ে অন্য কোন গাড়িতে উঠতে হবে। সামনে এগিয়ে দেখি, রাস্তার মাঝে বিশাল সাইন দেয়া, “হারাম ডিস্ট্রিক্ট”। বুঝলাম কাছাকাছিই চলে এসেছি। এক গাড়িতে “পিরামিড”, “হারাম” বলতে গাড়িতে থাকা তরুণ বুঝতে পারল আমি কোথায় যেতে চাইছি।
গাড়ি থেকে পিরামিড দৃশ্যমান হচ্ছে
১.৫ পাউন্ডে পিরামিডের কাছে চলে এলাম, তবে মূল গেইটের একটু আগেই নেমে গেলাম, ভাবলাম আবার কতদূর নিয়ে যায়। নীচে নেমেই পড়ে গেলাম এক দালালের খপ্পরে, সে আমাকে সাহায্য করার জন্য আমার সংগী হয়ে গেল। সে আমাকে বোঝাল, ঘোড়ায় চড়ে ঐখানে ঘুরতে হবে। এই দেখলে এত টাকা, সেই দেখলে এত টাকা। শেষ মেশ ওর সাথে দরদাম করে প্রায় ৪০০ পাউন্ডে দেড়/দুই ঘন্টার একটা প্যাকেজ নিয়ে একটা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলাম। ৮০ পাউন্ড দিয়ে পিরামিডে ঢোকার টিকেট কাটা হল আর তখন দেখলাম, ঘোড়া ছাড়াও এখানে এই গেইট দিয়ে ঢুকে হেটেও ঘোরা যায়। তবে সেটা সমস্যা না, আমার ইজিপশিয়ান সহকর্মীও ঘোড়ার পিঠে করে ঘোরার কথা বলেছিল, তাই সেটার জন্যই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। আমার গাইড আরেকটা ঘোড়া নিয়ে আমার পাশে পাশে চলল, পেছনের এক গেইট দিয়ে ঢুকে পড়লাম। সেখানে এক ধান্দাবাজ অপেক্ষা করছিল, সে আমার মাথায় একটা রুমাল আর বিড়া জড়িয়ে দিল (ঐ যে আরবের লোকজন যেমন পড়ে), আর হাতে ছোট্ট এক বোতল পানি ধরিয়ে দিল। প্রথমে বলে, এটার জন্য কোন টাকা লাগবে না, ফ্রি। দেয়ার পরে বলে, এবার খুশী হয়ে যা মনে চায় দাও। গাইড আবার তাল মেলায়, কেউ দেয় এত, কেউ দেয় অত। তবে সব এমাউন্টই বড় বড়। বুঝলাম, শালারা সবাই মিলে এভাবেই সবাইকে সিল দেয়, পুরোটা একটা চেইন। ২০ পাউন্ড দিয়ে ওর আশাহত মুখ দেখে কোন মতে মুক্তি পেলাম। তবে সত্যি বলতে, ঐ রুমাল আর পানি সত্যিই কাজে দিয়েছিল, নইলে ঐ গরমে অবস্থা আরো খারাপ হত। গাইডকে কড়া করে বলে দিলাম, এর পর আর কোন ধান্দাবাজি চলবে না, একটা টাকাও দেব না।
পিরামিডের এলাকাটা মরুভূমির মত। নীচে বালি, প্রখর সূর্যের তাপে সেই বালি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। একটু পর পর পানি খাচ্ছি একটু একটু করে। আর হাতের চামড়া পুড়ে মনে হল কয়লা হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে এগুচ্ছি আর দূর থেকে পিরামিড নজরে আসল।
ঘোড়ায় চড়িয়া আমি পিরামিডের দিকে অগ্রসর হইতেছি!
ছবি তোলা হল, আমার গাইড আমাকে পিরামিডের সামনে দাড় করিয়ে হরেক রকম ছবি তুলে দিল। পিরামিডের মাথায় হাত দিয়ে (ঐযে কক্সবাজারে মানুষ যেমন সূর্য হাতে নিয়ে ছবি তোলে, ঐসব আর কি)। বউ বলে দিয়েছিল, পিরামিড দেখে যেন পিরামিডসহ একটা সেলফি তুলি। সেলফি তোলাটাকে যদিও একটা মানসিক রোগ মনে হয়, তবুও বউ এর আব্দার রাখতে একটা সেলফি তুলেই ফেললাম পিরামিড পেছনে নিয়ে। ফেইসবুকে ব্যাপক লাইকও পেল সেটা! হঠাৎ দেখি, দূর থেকে উট নিয়ে দৌড়ে আসছে সাদা পোষাক পড়া পুলিশ এর মত এক লোক। কাছে এসে আমার গাইড এর কাছ থেকে নির্ধারিত পরিমাণ চাদা নিয়ে আবার সে চলে গেল।
ঐ দেখা যায় পিরামিড! এখানে তিনটা বড় পিরামিড আছে যেটাতে রাজাদের কবর দেয়া হত আর ছয়টা ছোট ছোট পিরামিড আছে যেগুলোতে রাণীদের কবর দেয়া হয়েছে
রাজাদের জন্য নির্মিত তিনটির মধ্যে সবচেয়ে ছোট পিরামিড - কাছ থেকে
রাজাদের জন্য নির্মিত তিনটির মধ্যে মাঝারি পিরামিড - কাছ থেকে
স্ফিংস
যাহোক, পিরমিডের কাছে দিয়ে ঘুরলাম, স্ফিংস এর কাছে ঘুরে ছবি তুললাম, এরপর ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখি কে আবার ইশারা দেয়। গাইড গিয়ে ওর হাতে কিছু চাদা দিয়ে আসল। দুর্নীতিতে ভালই এগিয়েছে বোঝা গেল। বেরুনোর পর গাইড বলে, এবার আমাকে টাকা দাও, খুশী হয়ে। আমি বলি, বল কি? তোমার সাথেতো পুরো প্যাকেজ এর কন্ট্রাক্ট করে সব টাকা দিয়ে দিলাম, আবার কি? বলে, ঐটা ঘোড়ার জন্য টাকা, গাইড হিসেবে আমাকে তোমার যা খুশী দাও। উদাহরণ দিচ্ছে, কেউ দেয় ১০০ ডলার, কেউ দেয় ২০০! মেজাজ চরম খারাপ হল। বললাম, দেখ, আমাকে এখন যাদুঘরে যেতে হবে, জানি না সেখানে কত চার্জ, দুপুরে খেতে হবে আর রাত্রে নীল নদে রিভার ক্রুজে যেতে হবে। সুতরাং, তুমি যদি এভাবে আমার কাছ থেকে সব টাকা কেড়ে নাও, তাহলে হবে কিভাবে?? বলে, তোমাকে বাসে তুলে দিচ্ছি, ট্যাক্সিতে গেলে ৮০ পাউন্ড লাগবে, বাসে ২.৫ পাউন্ডে মিউজিয়াম চলে যেতে পারবে। শেষ পর্যন্ত ১০০ পাউন্ড দিয়ে ওর সাথে রফা করে বললাম আমাকে বাসে তুলে দাও। বাসে উঠে বসেছি, একটু পর দেখি ও একটা টিকেট আর মিরিন্ডার ক্যান নিয়ে এসেছে আমার জন্য! বেচারা আমার ঝাড়ি খেয়ে আমার মন ভাল করার জন্য মনে হল ওটা করেছে। বললাম, হেলপারকে বলে দাও যাতে জায়গামত নামিয়ে দেয়।
যাদুঘর যাওয়ার পথে একটি সুন্দর স্থাপনা
বাস আমাকে যেখানে নামিয়ে দিল সেটা ছিল এল গালা স্কয়ার। এখান থেকে নীল নদের ওপর দু’টো ব্রিজ পার হলেই বিখ্যাত তাহরীর স্কয়ার, এর এক পাশেই হল মিশরীয় যাদুঘর। এল গালা ব্রিজের ওপর উঠে নদী পারের কায়রোর অপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করছি আর ছবি তুলছি। সূর্য তখন মাথার ওপর, সবটুকু তাপ ঢেলে দিচ্ছিল, কিন্তু এর মধ্যেও ভাল লাগছিল হাটতে, কারণ এভাবে ধীরে সুস্থে দেখা যায়।
এল গালা ব্রিজ থেকে নীল নদ এবং কায়রো শহর
এর মধ্যে ব্রিজের ওপর এক ফেউ গায়ে পড়ে কথা বলে একেবারে আমার নেংটা কালের দোস্ত হয়ে গেল। বলল সে শেরাটন হোটেলের কর্মচারী, কাল তার বিয়ে, এখন বাড়ি যাচ্ছে। শুভেচ্ছা জানিয়ে যেই পা বাড়াচ্ছি, বলে তুমি কি আমার বিয়ে উপলক্ষে কিছু উপহার দিবে?? মনে মনে বলি, মহা যন্ত্রণায় পড়লাম। টেনে টুনে তিন দিনের ট্যুর, তাই ডলার ভাংগিয়েছি মোটে তিনশ। পকেটে যা আছে তা দিয়ে মিউজিয়াম, লাঞ্চ আর রাতের নদী ভ্রমন হয়ে যাবে। মিউজিয়ামে ঢোকার ফি কত সেটাও জানি না, সাধারণতঃ বিদেশীদের জন্য বেশী হয়। বললাম, ভাই, আসলে বিয়েতেতো আমরা একটু ভাল গিফট দেই, সে পরিমাণ টাকা আমার কাছে এখন নাই। আর যদি কম টাকা দেই, তাহলে তুমি আবার মাইন্ড করে বসবে, ভিক্ষা দিলাম ভেবে। তাই আমি তোমার বিয়েতে কোন গিফট দিতে চাচ্ছি না। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা, পেছনে পেছনে আসছেই। শেষ মেশ বলেই বসলাম, ভাই, বিরক্ত করো না, আমাকে যেতে দাও। এই বলে হন হন করে হাটা ধরলাম, পেছনে আর তাকালামই না। মিউজিয়ামে এসে বুঝেছিলাম, ওকে কোন টাকা না দেয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।
কাসর আল নাইল ব্রিজ থেকে নীল নদ, এটা নদের আরেকটা শাখা
ব্রিজ পার হয়ে একটু এগুতেই সুন্দর একটা স্থাপনা, কাছে গিয়ে মনে হল কোন সরকারি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে
মিশরীয় যাদুঘর
কাসর আল নাইল ব্রিজ পার হয়ে তাহরীর স্কয়ার চলে আসলাম। বা পাশে তাকাতেই মিশরীয় যাদুঘর নজরে এল, কত স্বপ্ন ছিল এই যাদুঘর দেখব, মমি দেখব, হায়ারোগ্লিফিক্স দেখব! ৭৫ পাউন্ড দিয়ে টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম। মিশরীয় বা বিদেশী পর্যটক সবার জন্য একই ফি। মনে মনে খুশী হলাম। সিকিউরিটি চেক পয়েন্ট দিয়ে ঢোকার সময় বলে, ছবি তুলতে চাইলে আরো ৫০ পাউন্ড দিয়ে টিকেট কেটে আসতে হবে। ভাবলাম, এত দূর এসেছি, ছবিতো তুলতেই হবে। ফিরে গিয়ে আবার ক্যামেরার জন্য টিকেট কাটলাম। যাদুঘরে এসি নেই, এই একটা দিক গরমে কষ্ট দিল। যাদুঘরটা কিছু ছবিতেই দেখুন।
যাদুঘরের বাইরেও অনেক পূরাকীর্তি রাখা আছে
সময় হল যাদুঘর থেকে বের হবার
তো ফেরাউনের মমি বলে আমরা যেটা ইন্টারনেটে দেখি, সেটা রাখা আছে রাজা বাদশাদের মমির সাথে “রয়াল মাম্মী রুম” এ। আর দেখতে হলে আরো ১০০ পাউন্ড দিয়ে আলাদা টিকেট কাটতে হবে যাদুঘরের ভেতরেই। তাহলে কত হল, সব মিলিয়ে ২২৫ পাউন্ড! ঐ ধান্দাবাজকে মাঝারি অংকের পাউন্ড দিয়ে আসলেও নিশ্চিত সমস্যা পড়তাম!
রয়াল মাম্মী রুমে ছবি তোলা নিষেধ। এই ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া। রাজা রামেসেস ২ এর মমি এটি যেটি ফেরাউনের মমি বলে জনশ্রুতি আছে। ইনি মিশরকে খ্রীস্টপূর্ব ১২৭৯ থেকে ১২১৩ সাল পর্যন্ত শাসন করেছেন।
গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘন্টা দুয়েকে যাদুঘর দেখে বাইরে এসে খোজ করলাম, ভাই খাওয়ার ভাল দোকান কই আছে। একজন বলল, রাস্তার ঐ পাড়ে ফেলফেলা রেস্টুরেন্ট আছে, খুব ভাল। ফেলফেলায় এসে “শিশ তাউক” অর্ডার দিলাম, এটা মুরগী দিয়ে তৈরী করে। এত অসাধারণ লাগল, বলে বোঝাতে পারব না। দুই বোতল পানি আর একটা কোক সাবাড় করে ফেললাম, এত পিপাসা লেগেছিল।
ফেলফেলা রেস্টুরেন্ট এর শিশ তাউক! স্বাদটা এখনো মুখে লেগে আছে!!
এটাই বিখ্যাত তাহরীর স্কয়ার
তাহরীর স্কয়ারে ঢোকার মুখেই মেট্রো স্টেশনের সাইন দেখেছিলাম। নীচে নেমে দেখি, এটাই সা’দাত স্টেশন। কাল রাতে যেখান থেকে ট্রেন চেঞ্জ করেছিলাম। রাস্তাতো আমার চেনাই, মনের আনন্দে মা’য়াদি স্টেশনে চলে আসলাম। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে দেখি,এক ছেলে ফ্রেশ মাল্টার জুস বিক্রি করছে, ২ পাউন্ড দিয়ে এক গ্লাশ খেয়ে কি যে শান্তি লাগল বোঝাতে পারব না। আসার পথে দু’টো ড্রিংকিং ইয়োগার্ট আর বড় এক বোতল পানি কিনে নিলাম। পিপাসার কারণে মনে হচ্ছিল, পুরো নীল নদ খেয়ে ফেলতে পারব!
হোটলে ঢুকে একটা গোসল দিয়ে ঘুম দিলাম। রাত নয়টায় রিভার ক্রুজে যাব, জাহাজ আমাদের হোটেলের সামনেই নোংগর করা থাকে।
নদের তীরে সুন্দর একটি বাড়ি
রাতে আবহাওয়া অনেকটাই আরামদায়ক হয়ে এসেছিল। জাহাজ যখন চলা শুরু করল, বাতাসে শরীরটা জুড়িয়ে যাচ্ছিল। নদীর তীর ঘেষে আলোক সজ্জা, রেস্টুরেন্ট-বার আর মাথার ওপর দিয়ে একটু পর পর উড়োজাহাজ চলে যাচ্ছে, সব মিলিয়ে নীল নদ ভ্রমন ভালই লাগল। আর এভাবেই খুব ছোট কিন্তু মনে রাখার মত এল কাহিরাহ ভ্রমন শেষ হল।
ঝটিকা সফরে কায়রো... (প্রথম পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ২:১৮