সকালটা বেশ রৌদ্রোজ্জ্বই ছিল। রয়াল হোটেল শিরাজ এর ছয় তলার ডাইনিং রুম থেকে ভিউটা চমৎকার। এক দিকে পাহাড়, আরেক দিকে শহর। সপরিবারে নাস্তার উপর হামলে পড়লাম, বুফে নাস্তা বলে কথা। ইরানিদের সকালের নাস্তার একটা কমন আইটেম হল সাংগাক বা বারবারি খাওয়া বিভিন্ন ধরণের ক্রিম বা চিজ, টমেটো মিশ্রিত ডিম ভাজি দিয়ে। সাংগাক বা বারবারি হল দুই ধরণের রুটি, বানানোর প্রণালীর উপর এদের নামকরণ/স্বাদে ভিন্নতা আসে। ইরানের রাস্তায় সকাল হলে দেখবেন, অনেকেই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে রুটির কেনার জন্য। বড় তাওয়ায় রুটি তৈরী হচ্ছে, পুরো প্রক্রিয়াটি হাত এবং মেশিনের সমন্বয়ে। এরপর লোকজন সেই রুটি হাতে করে অফিসের পথে হাটছে। পাশের দোকান থেকে কিনে নিয়েছে চিজ বা ক্রিম।
যেজন্য এত কথা বলা, রয়াল হোটেলের ডাইনিং এ দেখলাম ক্রিম, মধু আলাদা করে দিয়ে রেখেছে। সবসময় দোকান থেকে কেনা হানি ক্রিম খেয়েছি। কিন্তু ওখানে ফ্রেশ ক্রিম আর খাটি মধু দিয়ে নিজের হাতে হানি ক্রিম বানিয়ে সেটা দিয়ে সাংগাক খেতে দারুণ লাগল। রয়েছে হরেক রকম ফলের রস। সব মিলিয়ে জম্পেশ একটা নাস্তা হল।
এরপরই বেরিয়ে পড়লাম আমাদের প্রথম গন্তব্য “আর্গে করিম খান” বা করিম খানের দুর্গ। করিম খান ছিলেন জান্দ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি শিরাজকে ১১৮০ সালে তার রাজধানী করেন। উন্নত ইরানের স্বপ্নদ্রষ্টা করিম খান শিরাজে অনেক সরকারি ভবন এবং মসজিদ তৈরী করেন। আর্গে করিম খান ছিল জান্দ রাজবংশের তৈরী সবচেয়ে বড় এবং অন্যন্যসাধারণ স্থাপনা যেটা ৪০০০ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে নির্মিত। আর পুরো কমপ্লেক্সেটি দাড়িয়ে আছে ১২৮০০ বর্গ মিটার জায়গার উপর। এর পর্যবেক্ষণ টাওয়ারগুলো ১৪ মিটার উচু। মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে দীর্ঘ পানির পুল।
দুর্গের ভেতরের কক্ষগুলোর দেয়ালে বিভিন্ন রকম টাইলস দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রুপকথা, ফুল, পাখি। দুর্গের ভেতরে এক কোনায় জায়গা করে দেয়া হয়েছে শিরাজের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প বিশারদদের জন্য। তারা সেখানে তাদের তৈরী শিল্পকর্ম প্রদর্শন ও বিক্রি করছেন। ছবিতে দেখুন এবার।
দুর্গের ভেতরে কারুকাজ
শাসন কাজে ব্যস্ত করিম খান জান্দ
রাতে আমরা রুদাকি স্টিটের হোটেলে ছিলাম। সেই আমলে রুদাকি স্ট্রিট !
প্রাচীন কালে কবি হাফিযের সমাধি
আর্গে করিম খানের ভেতরে
আর্গে করিম খান
আর্গে করিম খান থেকে বের হয়ে আমরা চলে গেলাম “সরাইয়ে মুশীর” এ যেটা ভাকিল বাজারের মধ্যে। এই ভাকিল কমপ্লেক্সে ভাকিল মসজিদ, হাম্মামখানা সহ আরো অনেক কিছু দেখার আছে। পুরো কমপ্লেক্সটাই অনেক পুরনো আর ঐতিহ্যবাহী। আর সরাইয়ে মুশীর মূলতঃ খুব দামী পুরনো ঐতিহ্যের আদলে তৈরী হস্ত শিল্পজাত পণ্যের দোকান পাট। ইরানে এসেছি, এ দেশীয় ঐতিহ্য যদি কিছু দেশে নিয়ে যেতে না পারি, তবে কেমন দেখায় বলেন? মন ভরে কিনতে হলে বাংলাদেশী টাকায় ৫/৭ লাখ টাকা নিয়ে যেতে পারলে ভাল হত। কিন্তু, সেটাতো আর সম্ভব না।
ভাকিল বাজার
ভাকিল মসজিদ
তবে যা কিনেছি তার মধ্যে সবচেয়ে দামী আইটেম ছিল এই নিচের ছবির মত ফিরুজি পাথরের ফুলদানী! মিডিয়াম সাইজ একটা কিনেছিলাম যার দাম পড়েছে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১২ হাজার টাকা।
সামনের বামে যে ফিরুজি পাথর খচিত ফুলদানি আছে সেটা কিনেছি
যাহোক, ভাকিল কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা চলে গেলাম ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এরাম বাগানে।
এরাম বাগান কবে তৈরী হয়েছিল এর সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানা না থাকলে ইতিহাস ঘেটে বোঝা যায় যে এটি সেলজুক সাম্রাজ্যের সময়কালে (১১ ~ ১৪ শতাব্দী) আহমেদ সানজার এর শাসনামলে তৈরী হয়েছিল। পরবর্তীতে এটাকে পুরনির্মান করেন জান্দ রাজবংশের রাজারা (১৭৫০ থেকে ১৭৯৪ সাল পর্যন্ত)। পরবর্তীতে এই বাগানটি গাসগাই উপজাতি প্রধান মোহাম্মদ গোলি খান এর মালিকানায় চলে যায়।
বর্তমানে এটি সিরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানায় আছে এবং এটি সকলের জন্য উন্মুক্ত বোটানিক্যাল গার্ডেন।
বাগানটি আসলেই সুন্দর, ছবিতেই দেখুন। বাগানে প্রচুর রাজহাস ছাড়া ছিল যেগুলো বিকট শব্দে ডাকছিল। এছাড়া কমলা লেবুর গাছও সেখানেই প্রথম দেখি।
এরাম বাগান দেখার পর আমাদের সেদিনের শেষ গন্তব্য ছিল “কুরআন গেইট” বা দারভাজে গোরআন। ফারসিতে এরা কুরআনকে গোরআন বলে থাকে। এটা আসলে ঠিক সিরাজ নগরীতে ঢোকার মুখেই। এই গেইটের পাশ দিয়েই আপনি টিকেট কেটে পাহাড়ের উপরে চলে যেতে পারবেন যেখান থেকে পুরো সিরাজ নগরী এবং আশে পাশের পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। ছবিতেই দেখুন।
দারভাজে গোরআন এ অবস্থিত কৃত্রিম ঝর্ণা
দারভাজে গোরআন এবং সিরাজ নগরী
সিরাজ নগরীর প্রবেশ পথে এই দারভাজে গোরআন
রাতের দারভাজে গোরআন
আমাদের পরের দিন বা শেষ দিনের গন্তব্য হল ইরানের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান “তাখতে জামশিদি” যেটা পেরসপোলিসে অবস্থিত, এরপর “নাগশে রোস্তাম” এবং সবশেষে পাসারগাদেতে অবস্থিত “সাইরাস দ্য গ্রেট” এর সমাধি!
নোরুজ ঘোরাঘুরি - শিরাজ নগরী দর্শন - ১
নোরুজ ঘোরাঘুরি - শিরাজ নগরী দর্শন - ২
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:২০