সাজিদের সাথে দেখা হয়েছিল তেহরানে গত বছর। ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা পড়াশোনা করেন। প্রতি বছর ইরান সরকার আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য সমাবর্তন এর আয়োজন করে এবং সে উপলক্ষে কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশী ছাত্রদের জন্য প্রদর্শনীর আয়োজন করে। ছাত্ররা স্টল বরাদ্দ পায় আর সেখানে তাদের নিজ দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করে। যেমন, এবছর এই অনুষ্ঠানটি হয়ে গেল শিরাজে। আর গত বছর সেটা হয়েছিল তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা এবং সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক মুমিত আল রশিদ, যিনি এখন এখানে তারবিয়াত মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন, তার আমন্ত্রণে আমরা সেই প্রদর্শনীতে গিয়েছিলাম। সাজিদের সাথে সেখানেই দেখা। বিভিন্ন শহর থেকে বাংলাদেশী ছাত্ররা এসেছে এবং সবাই মিলেই ঐ স্টলটা চালাচ্ছে। আমার স্ত্রী ঐ প্রদর্শনীর জন্য পুডিং তৈরী করে দিয়েছিল গেল বছর।
এ বছরের অনুষ্ঠানটি হয় শিরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে
প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের স্টল
এই খাবারগুলোর মধ্যে ৫ টি আইটেম আমার স্ত্রী তৈরী করে দিয়েছিল
উপরের এই তিনটি ছবি মুমিত আল রশিদ ভাই এর সৌজন্যে।
যাহোক, ফিরে আসি মূল কথায়। সাজিদ আর উমায়ের এর সাথে আমরা দুই বন্ধু হোটেল খুজতে বেরিয়ে পড়লাম। এক হোটেলের রিসেপশনে আমাদের পরিবারবর্গকে রেখে গেলাম। অনেক ঘুরেও খুব কম হোটেলেই ফাকা ঘর পেলাম আর পেলেও ব্যাটে বলে মিলছিল না। শেষ পর্যন্ত আমাদের পরিবার ফোন দিয়ে জানাল, ঐ হোটেলে একটা এপার্টমেন্ট খালি আছে আর সেটা শুধু এক রাতের জন্য দিতে পারবে। আলহামদুলিল্লাহ বলে সেখানেই উঠে পড়লাম।
কাছে হোটেলে খেতে গেলাম, রাত বারটার দিকে। কিন্তু এ কি অবস্থা ! রাস্তা ঘাটে গুলিস্তানের চেয়েও বেশী ভীড় ! ফুটপাতে বসেছে অসংখ্য দোকান, হাটাই দায় ! কি পাওয়া যায় না সেখানে ! আমার গাড়ির কাগজ, মোবাইলের চার্জার সব ছিল ল্যাপটপের ব্যাগে, যেটা আমি শেষ মুহুর্তে ভুলে ফেলে এসেছিলাম। কুবিদে (এক ধরণের কাবাব যেটা ভেড়ার মাংস থেকে তৈরী করা হয়) আর রুটি দিয়ে খাওয়া সেরে হোটেলে ফেরার পথে আমার বন্ধুকে বলছিলাম, ইস যদি একটা চার্জার পাওয়া যেত ফুটপাতে ! কারণ, আমার মোবাইলে চার্জ প্রায় শেষ ! বলতে না বলতেই দেখি সামনে এক লোক হাজার রকমের চার্জার, কার চার্জার নিয়ে বসে আছে ! স্যামসাং মডেলের চার্জার না পেয়ে সনি এরিকসনের একটা নিতে হল, দাম ৫০,০০০ রিয়াল (বাংলাদেশী ১২৫ টাকার মত) ! সে এক চার্জার, সারা রাত লাগিয়ে রেখে ১০০% চার্জ হয়েছিল !
পরদিন সকালে উঠে প্রথমেই আবার হোটেল খোজা শুরু করলাম। রয়াল হোটেল শিরাজ নামে তুলনামূলক নতুন এক হোটেলে ঘর পেয়ে এক দৌড়ে সেখানে গিয়ে উঠে পড়লাম ! কোরান গেইটের কাছে বেশ সুন্দর একটা হোটেল। হোটেলে উঠে আর দেরি না করে মোবাইলে গুগল ম্যাপ সেট করে বেরিয়ে পড়লাম আফিফাবাদ গার্ডেনের উদ্দেশ্যে।
১৮৬৩ সালে সাফাভিদ সময়কালে নির্মিত এই বাগানটি ১২৭,০০০ স্কয়ার মিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। বাগানে একটি প্রাসাদ আছে যেটি মির্জা আলি মোহাম্মাদ খান গাওয়াম (২) নির্মান করেন। ১৯৬২ সাল থেকে এটি আর্মিদের কব্জায় এবং এটি সামরিক জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শিরাজে গিয়ে একটা জিনিস ভাল লাগল, সব ট্যুরিস্ট স্পটের কাছেই অফিসিয়াল পার্কিং এর জায়গা আছে। গাড়ি পার্ক করে বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে ঢুকে পড়লাম আফিফাবাদ বাগানে। ঢোকার মুখেই দু’পাশে দু’টো ট্যাংক জানান দিল এটা সামরিক স্থাপনা। কিছু ছবি দেখুন।
আফিফাবাদ বাগানের মূল প্রাসাদ ভবন
অস্ত্রের প্রদর্শনী
প্রাসাদের ভেতর...
প্রাসাদের সামনে পানির পুল
বাগানে গাছে কমলা ধরে আছে, শিরাজ এর কমলা আবার বিখ্যাত !
এরপর চলে গেলাম বিখ্যাত কবি সা’দির সমাধি সৌধে। লোকে লোকারণ্য ! ছবিতেই দেখুন।
সা'দির কবর
সা’দি থেকে ফেরার পথে এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। ক্লান্তি বা ক্ষুধার কারণেই কি না কে জানে, খাবার খেলাম সেইরকম মজা করে। আমি নিয়েছিলাম জেরেশক পোলো ব মোরগ (পোলাও এর সাথে এক পিছ মুরগী, সাথে জেরেশক নামক ছোট ছোট টক একটা ফল, এই জেরেশক না থাকলে আসলে খেতে একটুও ভাল লাগত না)। এছাড়া জুজে কাবাব (মুরগির কাবাব), কুবিদেও ছিল।
খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা চলে গেলাম আরেক মহাকবি হাফেজ এর সমাধি সৌধে। কাছেই ছিল জায়গাটা, যদিও ম্যাপে অনেক ঘোরা পথ দেখাচ্ছিল। এই কমপ্লেক্সটা বেশ বড়, ভিড়ও বেশী। এই কবি কোরানে হাফেয ছিলেন, মূলতঃ সেজন্যই তার নাম হাফেয। কবরের কাছে গিয়ে দেখি, লোকজন কবরে ধরে প্রার্থনা করছে!
বেশ বড় কমপ্লেক্স
সমাধি সৌধ
কবি হাফেয এর কবর
সৌধের ছাদের কারুকাজ
হাফেযের কবিতা
সন্ধ্যার পর হোটেলে ফিরে আসলাম। আমাদের হোটেলের পাশেই অভিজাত এক রেস্টুরেন্ট, হাফত খান রেস্টুরেন্ট! আমাদের আগে যারা শিরাজ ঘুরে গেছে, তারা নাকি এখানে খেয়েছে, খাবার নাকি খুব মজার, তাই আমাদেরও খেতে হবে !
আমাদের হোটেল রুমের জানালা থেকে দেখা হাফত খান রেস্টুরেন্ট
হাফত খান রেস্টুরেন্ট কমপ্লেক্সের দেয়ালের কারুকাজ
যাহোক, কালে এই হাফত খান রেস্টুরেন্টাও একটা দেখার বস্তু হবে, হোটেলের স্থাপত্য সেইরকম। মনে হবে আপনি কোন জাহাজের ইঞ্জিন রুমের মধ্যে আছে। বাহ্যিক দেয়ালে ইঞ্জিন, কলকব্জার উপস্থিতি। আমার বন্ধু পাশের টেবিলের এক খাবার দেখে দূর থেকে মনে করেছে ওটা বোধহয় বিরানী ! দিয়ে দিল অর্ডার। মুখে দিয়ে বুঝলাম, জীবনে এর চেয়ে জঘন্য স্বাদের খাবার আর মনে হয় খাই নি! দোষ হোটেলের নয়, দোষ আমাদেরই !
ফারসিতে “হাফত” শব্দের মানে সাত। এই হোটলে সাতটি তলা আছে।মহাকবি ফেরদৌসীর শাহানামে কাব্যগ্রন্থ থেকে রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ তাদের সাতটি তলার নাম নিয়েছে। ফারসিতে “খান” শব্দের অর্থ টেবিল ক্লথ বা খাবারে ভর্তি টেবিল। এই হোটেলের সাতটি তলাতে সাত ধরণের খাবার পাওয়া যায়। আমরা “নোফেল আন্তর্জাতিক রেস্টুরেন্ট” ফ্লোরে গিয়ে আন্তর্জাতিক খাবার অর্ডার দিয়ে ধরা খেয়েছিলাম ! খাবারের বিল ছিল ২,০০০,০০০ রিয়াল যদিও আমরা খুব কম আইটেমেরই অর্ডার দিয়েছিলাম !
হাফত খান কমপ্লেক্সের ফোরুদ রেস্টুরেন্টের ইন্টেরিওর ! এই ফ্লোরে যাওয়া হয় নি দেখে এখন আফসোস হচ্ছে ...
শিরাজে আমাদের প্রথম দিনের ঘোরাঘুরি শেষ করে আমরা রয়াল হোটেলে রাজকীয় ঘুম দিলাম। পরের দিনের প্রথম গন্তব্য আর্গে করিম খান বা করিম খানের দুর্গ…
নোরুজ ঘোরাঘুরি - শিরাজ নগরী দর্শন - ১
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৫ সকাল ১১:২৩