ইরানের নববর্ষ সম্পর্কে আপনাদের জানা আছে কিনা জানি না। একে “নোরুজ” বলে থাকে ইরানিরা। অনেকে হয়ত বলবেন, এটাকে আমরা “নওরোজ” বলে শুনেছি। কিন্তু, ফারসি শব্দটাকে বাংলায় লিখতে গেলে আসলে “নোরুজ”টাই আমার বেশী কাছাকাছি মনে হল। শাব্দিক অর্থ করলে এর মানে আসলে “নতুন দিন”। ইরানিরা তাদের বছর শুরু করেছে বেশ ভাল একটা সময়ে, বসন্তকালে। চারিদিকে অনেক ফুল ফুটে তখন, আর ইরানিরা বেশ ভালভাবেই চারিদিকে ফুল দিয়ে সাজায়। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে দিনটি ২১ মার্চ !
নোরুজ ইরানিদের কাছে সবচেয়ে বড় ঈদ ! এরা যতটা না মুসলিম, তারচেয়ে বেশী পার্সিয়ান ! ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহা’র সময়ে আপনি বাংলাদেশে যেমন একটা উৎসব মুখর পরিবেশ দেখেন, এখানে তার ছিটেফোটাও পাবেন না। দুই ঈদে একদিন করে ছুটি থাকে। কিন্তু, ঈদের কোন রেশ আপনি কারো মাঝে দেখবেন না। গতানুগতিক একটা ছুটির দিনের মতই।
নোরুজ উপলক্ষে ইরানিরা "হাফত সিন" বা সাত س সাজায়। সাত ধরণের জিনিস থাকে, যেগুলোর নাম س দিয়ে শুরু হয়েছে। এই সংস্কৃতির উৎপত্তি মূলতঃ ইরানের প্রাচীন অগ্নিউপাসক জারতোস্তি ধর্মে থেকে যেটা যুগে যুগে ইরানি উদযাপন করে চলেছে।
নোরুজ উপলক্ষে সরকারিভাবে ছুটি ৩/৪ দিন থাকলেও অফিসগুলো সাধারাণত দুই সপ্তাহের ছুটি দিয়ে দেয়। মানে অতিরিক্ত দিনগুলো ওদের বাৎসরিক ছুটি থেকে কাটা যাবে। আমাদের এই অফিসে প্রায় জনা তিরিশেক বিদেশী কাজ করেন। আমাদের ক্ষেত্রে আবার নিয়মটা ভিন্ন। আমাদের কন্ট্রাক্টে ছুটি বলে কিছু নেই, মাসে ২২ দিন কাজ করতে হবে !
সেভাবে মিলিয়ে ঠিক করলাম, এই ছুটিতে দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে হবেই। ঐ ২২ দিনের হিসেব মেলাতে গিয়ে আসলে খুব বেশী দিন বের করা কঠিন, তাই ৪ দিনের একটা টাইট শিডিউল করে ফেললাম শিরাজ নগরীতে ঘুরতে যাওয়া জন্য। শিরাজ ঐতিহাসিক নগরী, বর্তমানে ফারস প্রদেশের রাজধানী। কবি হাফেয, শেখ সা’দী এই শহরের বাসিন্দা। এছাড়া আরো অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে এই শহর এবং এর আশে পাশে, বেশ কয়েকটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য !
তেহরান থেকে শিরাজ, ৯৫০ কিমি পথ। ইরানের মহাসড়ক বেশ ভাল, এখানকার মহাসড়কগুলো যখন দেখি, তখন বুঝি, আমাদের দেশে কোন মহাসড়কই নেই ! আমরা যখন ঢাকা থেকে দুরপাল্লার বাসে চড়ি, তখন আমরা যে কতটা ঝুকি নিয়ে পুরোটা পথ পাড়ি দেই সেটা খুব ভাল বুঝি এখন। বাংলাদেশে দুই লেনের রাস্তা, এক লেন দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, আরেক লেন দিয়ে গাড়ি আসছে। ইরানের মহাসড়কে এটা চিন্তাও করা যায় না ! এখানে সাধারণ এক পাশেই তিন লেইন থাকে এবং মাঝখানে অবশ্যই ডিভাইডার। খুব কম জায়গায়ই আছে, যেখানে এক পাশে দুই লেইন। ইস্ফাহানের দিকের রাস্তায় সম্ভবত এক পাশে চার লেইন করে। মহাসড়কের সর্বোচ্চ গতি সীমা ১২০ কিমি/ঘন্টা। অনেক মহাসড়কেই অটোমেটিক স্পিড ক্যামেরা আছে। যেখানে নেই, সেখানে দিনের বেলা পুলিশ স্পিড ক্যামেরা নিয়ে বসে থাকে। গতি বেশী হলেই জরিমানা !
২৫ মার্চ ২০১৫। আমি, আমার স্ত্রী আর দুই পুত্র। আমরা আমাদের গাড়িতে। সাথে যাবে ইরানেই কর্মরত এক বন্ধু, তার স্ত্রী আর একমাত্র কন্যা। ও যাচ্ছে ওর গাড়ি করে। ভোর ছয়টায় রওনা দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্রায় পৌনে সাতটা বেজে গেল গাড়ি ছাড়তে। অনেকেই আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল, প্লেন বা ট্রেনে যাও, এত পথ ড্রাইভ করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়বে, দেখবে যে একসময় বোর লাগছে। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই সড়ক পথে যাওয়ার নিয়্যত করলাম, কারণ, আমার সোনার বাংলাদেশে চাইলেও কি এমন একটা ভ্রমন আমি করতে পারব আমার নিজের গাড়ি নিয়ে? রাস্তা কোথায়?
ট্যুরটা ছিল গুগল ম্যাপ নির্ভর, মানে তেহরান থেকে শিরাজের ম্যাপ বের করে নিলাম আর জিপিস/জিপিআরএস অন করে সেই ম্যাপ দেখে পথ চলা। কোর্দেস্তান হাইওয়ে বেয়ে হাকিম, তারপর চামরান যেটা একটু পর গিয়ে নাভভাব হাইওয়ে হয়ে গেল। সেখান থেকে কাজেমিতে গিয়ে ওঠা আর ইমাম খোমেনি বিমানবন্দরের দিকে যেতে যেতে সেটার নাম হয়ে গেল তেহরান – গোম হাইওয়ে বা পার্সিয়ান গালফ হাইওয়ে ! এই হাইওয়ে ধরে এগুতে থাকলেই গোম, কাসান, ইস্ফাহান, শাহরেজা, অবাদেহ, মারভদাশত শহর হয়ে শিরাজ। তেহরানের হাইওয়েগুলোর নাম প্রায় সবই শহীদদের নামে, ইরান ইরাক যুদ্ধের শহীদ। আর সমস্যা হল, শহীদের সংখ্যা বেশী, সেই তুলনায় হাইওয়ে কম (যদিও বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশী)। তাই একই হাইওয়ের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিভিন্ন শহীদের নাম ধারণ করে। এছাড়া শিয়াদের বিভিন্ন ইমামের নামেও বেশ কিছু হাইওয়ে আছে।
গোম পৌছে কোন একটা হাইওয়ে হোটেলে প্রাতরাশ সেরে নিলাম। এর পড়ে আমাদের গাড়ি ছুটল আবার। ১২০ কিমি/ঘন্টা গতিসীমা থাকলেও আমি মাঝে মধ্যেই ১৪০ কিমি/ঘন্টাতে চালাচ্ছিলাম। দূর থেকে পুলিশ দেখলেই গতি কমিয়ে দিচ্ছিলাম। আমার বন্ধু আমাকে অনুসরণ করছিল। এর মধ্যে একবার ও আমার পেছনে পড়ে গেল। আমাকে ধরতে গিয়ে গতি তুলে ফেলল ১৫০ কিমি/ঘন্টা ! আর পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে, যেখানে পুলিশ স্পিড ক্যামেরা নিয়ে বসে ছিল, সেরকম জায়গাতেই ঘটনাটা ঘটাল। ব্যস পুলিশ ওকে থামিয়ে জরিমানা করে দিল ৭০০,০০০ রিয়াল ! রিয়ার ভিউ মিররে ওকে পুলিশের কাছে থামতে দেখে আমিও পথে এক পাশে গাড়ি থামালাম। আর তখনই মনে পড়ল, হায়, শেষ মুহুর্তের ব্যস্ততায় আমিতো আমার গাড়ির কাগজ পত্র কিছুই আনি নি! পকেটে মানি ব্যাগে শুধু ড্রাইভিং লাইসেন্সটা আছে !
সতর্ক হয়ে যেতে হল, পথে আর কোন রিস্ক নেয়া যাবে না ! কারণ, পুলিশ ধরলে সমুহ বিপদ। ব্যাটারা বহুত বজ্জাত। এর আগে চলুস রোডে ওভারটেকিং নিষিদ্ধ এক জায়গায় পচা শামুকে পা কেটেছিলাম। মাত্র গাড়ি কিনেছি, মনের সুখে ২০০ কিমি দূরে কাস্পিয়ান সাগর দেখতে যাচ্ছি বউ বাচ্চা নিয়ে। পাহাড়ী আকা বাকা রাস্তা, অধিকাংশ জায়গাতেই ওভারটেকিং নিষিদ্ধ। সামনে একটা পিক আপ জাতীয় গাড়ি যাচ্ছিল। আমি গাড়ির জানালা খুলে দিয়ে মিষ্টি বাতাস গায়ে মাখিয়ে যাচ্ছি আর ওই ব্যাটা বাজে গন্ধযুক্ত কালো ধোয়া ছেড়ে যাচ্ছিল। এক জায়গায় রাস্তা একটু চওড়া দেখে যেই না ওভার টেক করলাম, অমনি দেখি কোথা থেকে এক পুলিশ বের হয়ে আমাকে থামিয়ে ফেলল ! শালারা চিপার মধ্যে স্পিড ক্যামারে নিয়ে শিকারের অপেক্ষায় ছিল ! আমাকে কি ছিলাটা দিছিল জানেন?
১. ১,০০০,০০০ রিয়াল জরিমানা ওভার স্পিড এর জন্য (অথচ সাধারণতঃ এই জরিমানা ৪০০,০০০ রিয়াল)
২. ৩০০,০০০ রিয়াল জরিমানা কারণ আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই (অথচ আমার ইন্টার ন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল, বাংলাদেশীটাও দেখিয়েছিলাম, দু’টোই আসল)
৩. ৩০০,০০০ রিয়াল জরিমানা, আমি নাকি সিট বেল্ট পড়ি নাই (অথচ সিট বেল্ট ছাড়া তেহরানের গলিতেও গাড়ি চালাই না !)
ঐ ব্যাটা যখন বুঝতে পেরেছে, আমি ভিনদেশী, ফারসিতে ও কি জরিমানা লিখবে আমি কিছুই বুঝব না, তখন যত ধরণের জরিমানা দেয়া যায় সব দিয়ে দিয়েছে !
পথে অবাদেহ শহরে দুপুরের খাবার সেরে নিয়ে আবার পথ চলা শিরাজের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যা ৭ টা নাগাদ শিরাজ নগরীর প্রবেশ পথ “দারভাযে গোরআনে” (কোরান গেইট) এ পৌছে বিশাল ট্রাফিক জ্যামে পড়লাম। নোরুজে শিরাজ পর্যটকে গিজগিজ করে। ইরানিরা ঘুরতে খুব পছন্দ করে, তাই ছুটি পেলেই ওরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রুদাকি রোডে হোটেল বুকিং ছিল, সেই ৫/৬ কিমি পাড়ি দিয়ে পৌছুতে প্রায় রাত নয়টা বেজে গেল ! কিন্তু সেই হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে শুনি ওরা আমাদের বুকিং রাখেনি ! মাথায় হাত ! ৩ টা বাচ্চা আছে আমাদের সাথে, ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। আমি আর আমার বন্ধু হাটছি অন্যান্য হোটেলে খোজ নেব বলে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন পরিস্কার বাংলায় ডাক দিল, “ইঞ্জিনিয়ার সাহেব” ! পেছন ফিরে দেখি সিরাজ মেডিকেলে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী ছাত্র উমায়ের আর ইস্ফাহান মেডিকেলে অধ্যয়নরত সাজিদ এক সাথে এগিয়ে আসছে। হালে পানি পেলাম, অজানা শহরে নিজ দেশি লোকের দেখা পেলে যে কতটা আনন্দ লাগে সেটা বোঝানো যাবে না…
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫৬