সারা দিন অফিস করে ২ নভেম্বর রাত ১০ টায় এয়ারপোর্ট গিয়ে হাজির আমরা দু’বন্ধু। আমি আর বাবু, হালিম এর মধ্যেই ঝরে পড়ে গেছে। ফ্লাইট ৩ নভেম্বর রাত ১ টা ৪০ মিনিট এ। আমাদের রুট হল, ঢাকা ~ – কুয়ালালামপুর, কুয়ালালামপুর –~ ম্যানিলা। আমার সাথে ভিসা প্লাটিনাম কার্ড ছিল। চেক ইন, ইমিগ্রেশন শেষ করে সেটার বদৌলতে দুই বন্ধু বলাকা ভিআইপি লাউঞ্জে ঢুকে সেখানকার খাদ্য এবং পানীয়ের সদ্বব্যবহার করতে লাগলাম ! ভিসা প্লাটিনাম কার্ড হোল্ডাররা নিজে ছাড়া আরো তিনজনকে নিয়ে বলাকা ভিআইপি লাউঞ্জে ঢুকতে পারেন।
৩রা নভেম্বর দুপুর ২ টা’র দিকে আমরা ম্যানিলা পৌছালাম। এয়ারপোর্টে নেমে কোন দিকে যাব চিন্তা করার আগেই এক মহিলার আবির্ভাব ! একটি ট্রাভেল এজেন্সির, আমাদের হোটেল এবং ট্যুর প্যাকেজ দেখাতে চান । কিছুক্ষণ ইতি উতি করে শেষ পর্যন্ত তাদের গাড়ী করে এয়ারপোর্টের পাশেই এক অফিসে গেলাম। আমাদের প্রাথমিক প্ল্যান ছিল আমরা পালাওয়ান এবং বুরাকাই এই দুটি দ্বীপে যাব। শেষের দিকে এক দিন ম্যানিলা এবং এক দিন লস ব্যানস এ ঘুরে ফিলিপিনস ভ্রমন শেষ করব। কিন্তু, দুই দ্বীপের জন্য যে বিমান ভাড়া চাইল আভ্যন্তরীন রুটে, তাতেই আমি প্রথম ধাক্কা খেলাম ! ওদের সাথে কথা বলে শেষ পর্যন্ত শুধু পালাওয়ান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পালাওয়ানের টিকেট কেটে হোটেলের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। ওই মহিলাই তার গাড়ী করে দু’একটা হোটেলে নিয়ে গেল আমাদের। পছন্দ হল না প্রথম দু’টো। শেষে যেটায় উঠলাম, তার ভাড়া এক রাতের জন্য ২৮০০ পেসো ! বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৫২০০ টাকা ! বুঝলাম, মহিলা ভালই সিল দিল। কিন্তু কি আর করা, সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, টায়ার্ড লাগছিল, উঠে পড়লাম, যদিও আহামরি কোন হোটেল ছিল না !
এলাকাটির নাম ছিল পাসাই সিটি, একেবারে এয়ারপোর্টের পাশেই। হোটেলের সামনেই দেখলাম এয়ারপোর্টের টার্মিনাল দেখা যায়। বিকেল বেলাতেই আকাশ মেঘ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল। মনটা তখন একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল, যদি এই রকম মেঘ আর বৃষ্টি থাকে তবে তো ট্যুরই মাটি ! রাতে যখন খাদ্যের সন্ধানে বের হলাম তখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। কপাল ভাল, পাশেই আমাদের দেশের BFC/KFC স্টাইলের কিছু রেস্টুরেন্ট ছিল ! তো সেই রকম এক রেস্টুরেন্ট, নাম তার Jollibee, সেখানেই আমরা রাতের খাওয়া সারলাম। এদের ডিশে ভাত এর পরিমাণ খুব কম থাকে, কিন্তু সেটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকলাম। তখন বুঝিনি, এই Jollibee সারা ফিলিপাইন জুড়েই আমাদের সাথে থাকবে ! এর মানে এই নয় যে আমরা সব সময় Jollibee তেই খেয়েছি, বরং কোন রেস্টুরেন্টের এত শাখা থাকতে পারে, আমি আগে কখনো দেখিনি ! মোড় ঘুরলেই এই ধরণের চেইন রেস্টুরেন্ট এর শাখা ! ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি সবগুলোরই একই অবস্থা এবং এই ধরণের সব রেস্টুরেন্ট ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে !
খাওয়া দাওয়া শেষে উপায় না দেখে দুই বন্ধু দু’টো ছাতা কিনে ফেললাম। আর সেটা মাথায় নিয়েই বৃষ্টির মধ্যেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। হাটতে হাটতে এক রাস্তায় যখন প্রবেশ করলাম, দেখি এক পাশে শুধুই বার, আর বারের সামনে সাজগোজ করা মেয়েরা সবাইকে বারে প্রবেশের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে ! ওই বারগুলোর আবার বিশেষ নাম আছে, KTV বার, মানে হল Karaoke বার! ওখানে ক্যারাওকেতে আপনি গান গাইবেন আর মদ খাবেন, সুন্দরী রংচং মাখা মেয়েরা আপনার সংগ দেবে, আপনি চাইলে ! যাই হোক, ওই অবস্থা দেখে আমরা আর রাস্তার ওই পাশটায় গেলাম না ! যেই রাস্তা ধরে গেলাম, সেই রাস্তা ধরেই ফিরে এলাম। পরদিন সকাল ১১ টায় আমাদের পালাওয়ানের উদ্দেশ্যে যাত্রা।
পালাওয়ান ম্যানিলা থেকে ১ ঘন্টার ফ্লাইট। টার্মিনাল ৩ আভ্যন্তরীন বিমানের জন্য। গিয়ে দেখি ওদের এই আভ্যন্তরীন টার্মিনাল আন্তর্জাতিক টার্মিনাল থেকে বহুগুন সুন্দর ! আসলে আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অনেক পুরনো (ফেরার আগের দিন টিভিতে দেখছিলাম, ফিলিপিনস এর আন্তর্জাতিক টার্মিনাল নাকি বিশ্বের সবচেয়ে ঘৃণিত টার্মিনাল ! ) ।যাইহোক, দুপুর নাগাদ পালাওয়ান পৌছে দেখি সেখানেও টার্মিনালের ভেতরেই বিভিন্ন হোটেল এবং ট্যুর অপারেটরদের প্রতিনিধিরা আমাদের খেদমতে বসে আছে। পালাওয়ান না বলে বলা উচিত পুয়ের্তো প্রিনসেসা সিটি যেটা কিনা পালাওয়ানের অন্তর্গত। ডে লোরো ট্যুরস এন্ড ইন এর একটা প্যাকেজ আমাদের পছন্দ হয়ে গেল, সেটাই নিয়ে নিলাম।
৩ রাত ৪ দিনের প্যাকেজ,
১ম দিনঃ অর্ধেক দিন পুয়ের্তো প্রিনসেসা সিটি ট্যুর (মানে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত)
২য় দিনঃ হোন্ডা বে ট্যুর (সকাল ৬ টায় বের হতে হবে)
৩য় দিনঃ মাটির নীচের নদী ট্যুর
আমরা বাড়তি কিছু টাকা দিয়ে আরো এক দিনের হোটেল নিয়ে নিলাম, কিন্তু চতুর্থ দিনের কোন প্যাকেজ নেই নি। পরে অবশ্য ডস পালমাস আইল্যান্ড রিসোর্টে ৪র্থ দিন একটা প্যাকেজ নিয়েছিলাম, সেদিন ছিল ঈদের দিন !
হোটেলে উঠে একটু হাত মুখ ধুয়েই বেরিয়ে পড়লাম পুয়ের্তো প্রিন্সেসা শহর দর্শনে। প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেল একটা বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে। সেখানে ঢোকার মুখেই চোখে পড়ল ৬০ বছরের বেশী বয়সের এক কুমিরের বিশাল চামড়া !
ছোট এক শুকরের পা নিয়ে কুমির দলের কাড়াকাড়ি দেখতে ভালই লাগল।
এছাড়া পালাওয়ান এর ভাল্লুক বিড়াল (Palawan Bear Cat) দেখেও ভাল লাগল।
এই বিড়ালটি ব্লগার বড় বিলাইকে উৎসর্গ করা হল!
দুই বন্ধু পার্কে আর বেশী ঘোরাঘুরির ধৈর্য পেলাম না। এর পর একটা সাফারি পার্কে নিয়ে গেল, সেখানে জিপ লাইনিং করা যায়। জিপ লাইনিং হল, পাহাড়ের উচু থেকে কেবল বেয়ে দ্রুত নীচে নেমে আসা। সব শেষে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে নিহত হওয়া আমেরিকান সৈন্যদের এক স্মৃতিসৌধে নিয়ে গেল, তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বলা বাহুল্য, ফিলিপিনস আমেরিকার খুব ভক্ত কারণ ওদের স্বাধীনতার পেছনে আমেরিকার ভূমিকা রয়েছে।
৫ নভেম্বর সকাল ৬ টায় আমরা হোন্ডা বে ট্যুর এর উদ্দেশ্য রওনা হলাম। পথে এক দোকান থেকে স্নরকেলিং ইকুইপমেন্ট আর কোরাল এ লেগে পায়ে যাতে ব্যাথা না লাগে সেজন্য রবারের জুতা ভাড়া নিতে হল। এদের নৌকাগুলোর ডিজাইন দেখে মজা পেলাম, নৌকার দুই দিকে বাশ দিয়ে নৌকা ব্যালেন্স করা আছে।
যাইহোক, প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেল একটা স্নরকেলিং সাইটে। স্নরকেলিং হল, চোখে বায়ু এবং পানি রোধী চশমা আর মুখে পাইপ লাগিয়ে (শ্বাস প্রশ্বাস নেয়ার জন্য) পানির উপর ভেসে ভেসে পানির নীচের জগৎ দেখা ! এই অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছিল থাইল্যান্ডের ফুকেটে, কিন্তু এই জিনিসটা আমার সব সময়ই খুব ভাল লাগে, একেবারে অপার্থিব লাগে ! পানির নীচের ওই জগৎটাকে একেবারেই অন্যরকম লাগে, এত সুন্দর বলে বোঝাতে পারব না। রঙ বেরং এর প্রবাল আর মাছের মেলা, আর প্রবালের উপর আরো কত সামুদ্রিক জীব! আমার ক্যামেরা পানিরোধী না হওয়াতে ছবি তুলতে পারিনি।
সবাই পানির নীচের জগৎটাকে দেখতে ব্যস্ত !
পানির উপর থেকেও সুন্দর মাছ দেখা যায় !!
এরপর আরো এক দ্বীপে স্নরকেলিং এর জন্য নিয়ে গেল। সেখানে প্রচুর মাছ, আমাদের সাথে রুটি ছিল। রুটি ছড়িয়ে দিলেই ঝাকে ঝাকে মাছ কাছে এসে খায়, সে এক দেখার মত দৃশ্য। কিছু ছোট ছোট মাছ ছিল, যেগুলোর ঠোট ছিল ছুরির মত লম্বা ! হঠাৎ দেখলাম তাদেরই বিশাল সাইজের এক বড় ভাই আমার দিকে চোখ বড় বড় তাকিয়ে আছে ! দেখে খুব ভাল লাগল, আবার চিন্তা করছিলাম যদি এক ঠোকর দেয়, খবরই আছে ! স্নরকেলিং শেষ করে স্নেক আইল্যান্ডে গেলাম। দুপুরের খাবারের আয়োজন সেখানেই ছিল। সাথে বিশাল সাইজের ডাব এর পানি এবং শ্বাস ! স্নেইক আইল্যান্ডেও স্নরকেলিং এর আয়োজন ছিল, কিন্তু মাথার ওপর কড়া রোদ থাকায় আমি আর নামলাম না !
স্নেক আইল্যান্ডের আশপাশ...
আমাদের পরদিন এর গন্তব্য Underground River, এটা একটা World Heritage সাইট। সেই গল্প আরেক দিন।
বি.দ্র. : ইদানিং ব্লগ লিখতে বা পড়তে কেন জানি আগ্রহ পাচ্ছি না, তবুও জোর করেই লিখে ফেললাম, তাই লেখাটা হয়ত একটু দায়সারা গোছের হয়ে গেল...