


প্রথমেই ভুটান সম্পর্কে দু’একটি তথ্য জানিয়ে নেই। ভুটানিদের কাছে তাদের দেশের নাম ড্রুকইউল যার অর্থ “"বজ্র ড্রাগনের দেশ” ! ড্রুক বা বজ্র ড্রাগন তাদের জাতীয় প্রতীক। এটা আসলে ভুটানের পৌরানিক কাহিনীর একটি অংশ এবং ভুটানের রাজাদের বলা হয় “ড্রুক গিয়ালপো” বা ড্রাগন রাজা।
আর ভুটান হল এখন বিশ্বের দ্বিতীয় দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ২২.৪ শতাংশ ! আর এর মূল চালিকাশক্তি হল তাদের “"তালা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র” যার বিদ্যুৎ তারা ভারতের কাছে বিক্রি করে থাকে। ভুটানে ভারতীয় এবং বাংলাদেশীদের জন্য প্রবেশ করতে কোন পয়সা লাগে না, এছাড়া অন্য যে কোন দেশের নাগরিককে ভুটানে প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই কোন ট্রাভেল এজেন্টের সাহায্য নিতে হবে এবং দেশটিতে শুধু অবস্থান করার জন্যই প্রতিদিন সরকারকে ২০০ ইউএস ডলার ফি দিতে হয় !!



সড়ক পথেই গিয়েছিলাম। ভারতীয় ভিসা অফিস থেকে দ্বৈত প্রবেশাধিকার সম্বলিত ট্রানজিট ভিসা নিয়ে নিলাম। ভুটানের ভিসা সীমান্ত চেক পোস্টেই দেয়। রুট হল বুড়িমারী/চ্যাংড়াবান্ধা -– জয়গা(ভারত)/ফুন্টসলিং(ভুটান)। বুড়িমারী স্থল বন্দরের কার্যকলাপ শেষ করে জয়গা যেতে আমাদের প্রায় বিকেল হয়ে গেল। ভুটানে ওরা শুধু পারো এবং থিম্পু – এই দুই শহরের জন্য ভিসা দেয়, ১৫ দিনের জন্য। দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি এবং পাসপোর্টের ফটোকপি লাগে। ভুটান একটা সংরক্ষিত দেশ। রাজধানী থিম্পু গিয়ে অভিবাসন অফিস থেকে আপনি আরো কিছু শহরে যাবার অনুমতি নিতে পারবেন। ভুটানের সব নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় পত্র আছে এবং পথে বিভিন্ন জায়গায় চেক হয়, তখন আপনার বিশেষ পাস এ সিল দিয়ে দেবে এবং সেই তথ্য কম্পিউটারে সংরক্ষিত হয়।

রাজকীয় গেইট পার হয়ে ভুটানে ঢুকলাম। যেহেতু সেদিন আর পারো যাবার কোন গাড়ী নেই, তাই ফুন্টসলিংএ এক রাতের জন্য একটা হোটেলে উঠে পড়লাম। হোটেলগুলোর রুমে কেমন যেন একটা অদ্ভুত গন্ধ, এই জিনিসটা তেমন ভাল লাগল না। পরের দিন সকালে পারো যাওয়ার গাড়ীর টিকেট কেটে নিয়ে আসলাম বাস স্ট্যান্ড থেকে।
সন্ধ্যায় ফুন্টসলিং এর দোকান পাটগুলো একটু ঘুরে দেখতে লাগলাম। কাপড়ের দোকানে বাংলাদেশী কাপড় চোপড়। সীমান্তেও দেখা পেয়ে যেতে পারেন দু’'এক জন ভুটানী নারী পুরুষের, এরা ঢাকার বংগবাজার বা এই জাতীয় পাইকারী বাজার থেকে কাপড় চোপড় কিনে নিয়ে যায়। অবাক হলাম ফলের দেশ ভুটানে বাংলাদেশী ফলের জুস এর ক্যান দেখে !


ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই বাস স্ট্যান্ডের দিকে রওনা হলাম। প্রায় ছয় ঘন্টার পাহাড়ী পথ পার হয়ে পারো, যেখানে ভুটানের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর অবস্থিত। পাহাড়ী পথে যাত্রা আমার বরাবরই ভাল লাগে, কানে এমপিথ্রি প্লেয়ার লাগিয়ে আশ পাশ দেখতে লাগলাম।

পারোর পথে...

দুপুর নাগাদ পারো পৌছে গেলাম। ছোট্ট একটা উপত্যকায় এই শহর গড়ে উঠেছে। একটা প্রধান সড়কের আশে পাশেই সব কিছু। হোটেল খুজতে গিয়ে প্রথম ধাক্কা খেলাম, অতি নিম্নমানের রুম, সাথে মুফত একটা বোটকা গন্ধ, তাও ভাড়া ৫/৬ ‘শ রুপী !! মেজাজ চরম খারাপ হল।



খেতে গিয়ে বুঝলাম, এইসব আইটেমে আমাদের চলবে না ! কোনটা কি দিয়ে কিভাবে রেধেছে, আইটেমের নাম দেখে বোঝাও মুশকিল !



পর দিন সকালে আমাদের ভাড়া করা ট্যাক্সি নিয়ে পারো দর্শনে বেরিয়ে পড়লাম। চমৎকার আবহাওয়া ছিল, রৌদ্রোজ্জ্বল, ঘোরাঘুরির জন্য একেবারে যথার্থ ! প্রথমেই ড্রাইভার কাম গাইড আমদের নিয়ে গেল ড্রুকগিয়াল জং (Dzong) এ। এটা ওদের একটা প্রাচীন জং।


ড্রুকগিয়াল জং

ড্রুকগিয়াল জং থেকে আশে পাশের দৃশ্য...
এ পর্যায়ে জং এর ব্যাপারে দুটো কথা বলছি। জং হল এমন একটি স্থাপনা যেটা একাধারে প্রশাসনিক কেন্দ্র, দূর্গ, উপাসনালয় ! প্রাচীনকালে এগুলো মূলত দূর্গ ছিল। বর্তমানে জংগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার হচ্ছে, ধরুণ থিম্পু জং কে আমাদের দেশের সেক্রেটারিয়েটের সাথে তুলনা করা চলে !
পথে দূর থেকে টাক্তসাং বৌদ্ধ বিহার চোখে পড়ল। এটা একটা বিখ্যাত বিহার যা কিনা বাঘের আস্তানা (Tiger’s Nest) নামেও পরিচিত।

ড্রুকগিয়াল জং দেখে ফেরার পথে চোখে পড়ল এক সুরম্য এবং সুন্দর ভবনের কমপ্লেক্স। ড্রাইভারকে বললাম ভেতরে গিয়ে দেখে আসি। ভেতরে ঢুকে বুঝলাম এটা একটা পাচ তারকা হোটেল, ঝিয়া লিং হোটেল ! হোটেলের ভেতরের কারুকার্য দেখে সত্যিই বিমোহিত হলাম। রুম ভাড়া শুনে ঢোক গিললাম, পিক সিজনে প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট এর ভাড়া ১২০০ USD এর উপরে প্রতি রাত্রি !!




হোটেলের প্রধান ফটক

রিসেপশন থেকে ছোট ছোট গাড়ী করে রুমে নিয়ে যাওয়া হয় অতিথিদের...
সেখান থেকে ফিরে এলাম শহরে, সেদিন ছিল সাপ্তাহিক হাট। হাট থেকে একেবারে তাজা আপেল এবং সবুজ নাশপাতি কিনলাম।




সাপ্তাহিক হাট, মিলবে তাজা ফল মূল...
আপেল খেতে খেতে চললাম পরবর্তী গন্তব্যে, পারো জাদুঘর। কিন্তু গিয়ে দেখি সেদিন সাপ্তাহিক বন্ধ। কি আর করা, সেখান থেকে পুরো পারো উপত্যকার কিছু ছবি তুলেই চলে গেলাম পারো বিমানবন্দরে...

পাখির চোখে পারো শহর...
পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ! এটা পৃথিবীর বিপজ্জনক বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে একটি, উপত্যকার মাঝখানে পারো নদীর তীর ঘেষে তৈরী। প্রথমেই আমরা মূল টার্মিনালে ঢুকলাম, আমাদের ড্রাইভার আবার এই এয়ারপোর্টে আগে কাজ করত, তাই সবাই ওর পরিচিত, তাই প্রবেশে কোন বাধা ছিল না।




জনশুন্য টার্মিনাল, সামনে ইমিগ্রেশন !!
এয়ারপোর্টের ভেতরে এবং আশে পাশের কম্পাউন্ড দেখে রানওয়ের পাশের রাস্তা ঘুরে উপরে একটা ভিউ পয়েন্টে উঠলাম, যেখান থেকে পুরো এয়ারপোর্টের একটা Birds Eye View পাওয়া যায়। কিছু ছবি শেয়ার করছি আপনাদের সাথে... খেয়াল করে দেখুন দূরে পারো জং দেখা যাচ্ছে...


পারো ভ্রমন মোটামুটি শেষ। শহরে ফিরে আশে পাশের দোকানগুলোতে ঘোরাঘুরি করলাম। বলা বাহুল্য ভুটান কিন্তু ব্যায়বহুল দেশ। ওদের দেশের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন জিনিসপত্র, কিন্তু দাম দেখে কেনার ইচ্ছে চলে যায়।
আমাদের পরের দিনের গন্তব্য ভুটানের রাজধানী থিম্পু, পারো থেকে মাত্র ৫৫ কি.মি. দূরে... আজ এ পর্যন্তই, বাকীটুকু আগামী পর্বে বলব...

