এক.
একদিন অজস্র ডাহুক এসেছিলো আমার ঝুল বারান্দায়, হাত ভর্তি শূণ্যতা গুলো ছড়িয়ে দিয়েছিলাম ওরা ঠুকরে ঠুকরে খেয়েছিল। তারপর কানে কানে বলে গেল হিজল বনের গল্প, সেখানে ওরা আমাকে নিমন্ত্রন করেছিল ওদের ঘুম ঘুম নীড়ে, কানে কানে ওরা উড়ন্ত স্বপ্ন ঢেলে দিয়েছিল অনেক, ওরা পরিতৃপ্ত হয়েছিল সেদিন! কারন চুপটি করে শূণ্যতার মাঝে ভালোবাসা জড়িয়ে দিয়েছিলাম।
শূণ্য শূণ্য শিমুল ভালোবাসা।
দুই.
সেদিন অনেক বৃষ্টি হয়েছিল, আমি বুকের পাঁজর ভেঙে নৌকা হয়েছিলাম, বর্ষার কাদা-জলে চিত হয়ে ভেসে ছিলাম,চোখে সেদিন অনেকগুলো তীর গেঁথেছিল,প্রতিবাদ করতে পারিনি, তীর বিঁধেছিল ঠিকই, প্রমান আমার হাতে ছিল না,সেটা ছিল বর্ষা-তীর। একাকী অপমানে আগুন জ্বলেছিল, আমি পুড়ে শেষ হয়ে গেলাম ঝিরিঝিরি বর্ষায়। ভালোবাসাকে তোমরা জীবন বলো, আমি বলি অক্সিজেন, যা আগুনকে লেলিহান করেছিল। তোমরা জানতেও পারোনি, তোমরা কিচ্ছু জানো না!

তিন.
চুপচাপ বসেছিলাম ঘাসফুলের বনে, লেকের পানিতে পা ডুবিয়ে মাছেদের সাথে বনিবনা করেছি, মাঝখানে যাত্রী-বিহীন যে নৌকাটি আঁচল পেতে একা একাই ঘুরছিল ওটায় আমি উঠতে পারি নি, আমি কখনোই সাতার দিতে শিখিনি, কেউ ছিল না ওটাতে, কেউ না! নৌকাটি আহ্লাদ করে বলেছিল "পূর্ণিমা রাতে ভালোবাসার হাত ধরে এসো, তোমাদের আমি তুলে নেবো আমার আঁচলে" বলেছিলাম, "আমার কোনো ভালবাসা নেই, শূন্যতাগুলোও হিজলবনে!" নৌকাটি করুনা নিয়ে তাকিয়ে রইল আর ঘুরতে লাগলো জলস্রোতে। আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম "একদিন ঠিক প্রজাপতির ডানার রঙ মাখিয়ে প্রিয়তার হাতে হাত রেখে তোমার কাছে হাজির হবো!"
চার.
নিরিবিলি পিচ ঢালা একটি পথ ধরে হেটে চলেছি হিজলবনের খোঁজে, এই পথের পরিচ্ছন্ন বাঁকে নিরালা সকাল রোদের সাথে লুকোচুরি খেলে, হিম হিম রোদ। শালবনের মাঝে পথটি নিয়ে গেল আমাকে, সেখানে একটি পরী, কানামাছি হয়েছিল চারপাশে প্রজাপতি আর জোনাকিদের নিয়ে। অবশেষে সে আমাকে ছুঁয়ে দিল আর অবাক হয়ে সরিয়ে ফেলল চোখ থেকে পালকের রুমাল। আমি তখন কানামাছি হলাম! তারপর আমি জীবন হলাম। প্রজাপতিদের 'কানামাছি' বানিয়ে চুপি চুপি পরীটির খোপায় সোনালুফুল গুঁজে দিলাম। তার অবাক চোখে জোছনা দেখেছি! পরীর কোলে থাকা আদুরে খড়গোশটা হঠাৎ ঝাপ দিলো আর ছুটে গেলো, তার পিছু নিতে নিতে আহত হলাম, কেটে গেল আমার বা'হাতের কনুই, আরো সাথে জখম হলো আগাছা হতাশা, ব্যর্থ ক্রোধ, জীর্ণ দুঃখ আর ক্ষমার অযোগ্য গ্লানি, পরিশেষে খড়গোশটা যখন কব্জাগত, তখন আমি জীবিত হলাম।
শিউলীর মালায় আমায় জড়িয়ে নিয়ে এক প্রহরের পলক বিনিময়ে, সপ্তপ্রহরের আমার হলো পরীটি, আমি হলাম তার!
পাঁচ.
হিজল বনে পৌছুতে পৌছুতে ঘুমন্ত দুপুর। পায়ের নিচে পাতাগুলো আমাদের স্বাগতম জানালো মর্মর শব্দে, একটি টিয়ার দল,অজস্র ঘুঘু আরো কিছু হলদে পাখি আমাদের চারপাশটাতে উৎসবে মাতিয়ে দিলো! "তোমরা এসো আমাদের সাথে সুর মেলাও" চমৎকার ঐকতানে আমন্ত্রন জানালো ওরা। আমাদের রিনিঝিনি হাসিকে ওরা ধরে নিল তাল-লয় আর অজানা সব সুর হিসেবে। অবশেষে বিকেলে ওরা আমাদের বিদায় জানালো বুকের পালক উপহার দিয়ে।
ডাহুকের সেই দলটিকে খুঁজতে লাগলাম আমরা দু'জন, অবশেষে খুঁজে পেলাম। আমাদেরকে নিয়ে গেল ওরা ওদের খড়-কুটোয় বানানো আর ফুল দিয়ে সাজানো ঘুম ঘুম নীড়ে, সেখান থেকে শূণ্যতা আর ভালোবাসাগুলো খুটে খুটে, মালায় গেঁথে পরীর গলায় পড়িয়ে দিলাম।
বসে আছি আমি,বুকে মাথা রেখে ক্লান্ত পরীটি ঘুমিয়ে গেল দ্বিপ্রহরের আবেশে, ডাহুকের ঘুম ঘুম নীড়ে।

ছয়
এখন সন্ধ্যাবেলা। "আজ পূর্ণিমা!" জোনাকিগুলো আমার কানে কানে জানিয়ে গেলো, পরীর কপালে টিপ চুমু দিয়ে ওকে জাগিয়ে দিলাম, আলতো পলকে সে প্রথমে আমাকে দেখে সূর্য্যটাকে দেখল আর গোধূলীক্ষনে এই ঘুম ঘুম নীড়ে ছড়িয়ে দিল অজস্র মুক্তোহাসি, সেগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে চোখের গহীণে লুকিয়ে রাখলাম।
ঘুম ঘুম নীড় থেকে ডাহুকদের বিদায় জানালাম। নেমে এলাম হিজল বনে।জোনাকিগুলো এর মাঝেই সবাই মিলে একটি পথ একে ফেলল, যে পথ দিয়ে কখনো আমি হাঁটি নি। সেই শত সহস্র জোনাকের- জ্বলা নেভা পথ ধরে জোনাকিদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে পূর্ণিমাকে বরণ করতে আমরা এগিয়ে গেলাম, জোনাকিরা আমাদের নিয়ে এল আঁচল ছড়ানো নৌকার, সেই লেকের পাড়ে!
আমরা হাতে হাত ধরে নৌকার আঁচলে পূর্ণিমাতে অজস্রকাল ধরে ভেসে চললাম......
উৎসর্গ, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি একটি ঝিলমিল গল্পের বায়না ধরেছিল।

সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১০ দুপুর ১২:৪৪