পিকনিকস্পটগুলোতে আরও বিচিত্র কিছু ব্যাপার লক্ষণীয়। যেমন: মানুষজন ওখানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের খেলায় মেতে ওঠে। খেলাধূলা ভাল জিনিস, সেটাতে আপত্তি নেই। কিন্তু যখন উচ্চস্বরে মাইকে বলা হয়, 'আপনাদের সবার প্রিয় রিনু ভাবী তার কোকিল কণ্ঠে এখন কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার একটা গান গাইবেন' এবং তারপর শুরু হয়ে যায় হেড়ে গলার বেসুরো গান। কিংবা 'পিলো পাসিং' খেলার ধারা বিবরণী যখন চিৎকার করে চলে পুরুষ কণ্ঠে, তখ দীর্ঘ একটা নি:শ্বাস ফেলে বলি: 'কি বিচিত্র সেলুকাস এ দেশ'!
বাংলাদেশে পর্যটনের যে ক'টি এলাকা আমি এ পর্যন্ত দেখেছি, অসাধারণ শান্ত সব জায়গা। কিন্তু এসব জায়গায় অশান্তি ডেকে নিয়ে আসছে এইসব অশান্তিকারী উচ্চস্বরে মাইক বাজানো পার্টিরা। তারা যে শান্তিপ্রিয় ট্যুরিস্টদের চরম বিরক্তির কারণ হয়, এটা তারা কখনও বুঝতে চায়না। তারা ভাবতে চায়না যে, উচ্চস্বরে মাইক বাজানোতে অন্য ট্যুরিস্টদের অসুবিধা হতে পারে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের যে ক'টি পর্যটনের স্থান আমি দেখেছি, কোথাও এই মাইক বাজানোর 'কালচার' নেই। ওসব জায়গার মানুষজন জানে যে, এই 'ট্যুরিজম' তাদের রুটি-রুজি। তাই দেশী-বিদেশী পর্যটকদের তারা কোন ভাবেই উত্যক্ত করেনা, উচ্চ স্বরে মাইক বাজানোতো দূরের কথা। এমনকি ওসব জায়গার নিরাপত্তাও যথেষ্ট ভাল প্রতীয়মান হয়েছে আমার কাছে। যেখানে বাংলাদেশী হয়েও নিজের দেশের কোন পর্যটন স্থানে গিয়েও আমি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি।
এতো গেল উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে শব্দদূষণের কাহিনী। আরও বেশ কিছু বিচিত্র্য ব্যাপার আছে। বিদেশী টুরিস্ট দেখলেই লোকজন তাদের আশেপাশে ভীড় করে, যেন চিড়িয়াখানার 'জলহস্তি' দেখার মতো অবস্থা। আর ভিক্ষুকের যন্ত্রণায় দেশী-বিদেশী সকল পর্যটকরাই বিরক্ত। সাথে রয়েছে হকারদের যন্ত্রণা। পর্যটন এলাকাগুলোতে ঘুরে অল্প কিছু জায়গা ছাড়া চারিদিকে ছড়িয়ে থাকতে দেখেছি ময়লা-আবর্জনা, চিপস আর চানাচুরের খালি প্যাকেট, বাদামের খোসা এমনকি কনডমের প্যাকেট।
আরও যে ব্যাপারটি না বললেই নয়, তা হলো, দর্শনীয় স্থানগুলোতে মানুষ তার স্মৃতিচিহ্ন রেখে আসার ব্যাপারে উদগ্রীব। তাই কোন মন্যুমেন্ট বা দেয়ালে আপনি যদি দেখেন: 'মিলা+সুজন' কিংবা, 'মলি, তোমাকে ভালবাসি' অথবা, কোন মেয়ের নামে কুৎসিত কোন গালি বা মোবাইল নম্বর, তাহলে দয়া করে অবাক হবেন না।
উপরের কথাগুলো 'নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো'। আপনারা যারা পর্যটন স্থানগুলোতে গিয়েছেন বা যাচ্ছেন, তারা সবাই কম-বেশি উপরিউক্ত সমস্যাগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেখেছেন। কিন্তু একজন বাংলাদেশী হিসেবে মনে-প্রাণে আমি বিশ্বাস করি, পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু দরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়ন। দেশের হর্তা-কর্তা পলিসিমেকাররা পর্যটনের জায়গা গুলোতে নিজেরাই ব্যবসা করে নিজেদের পকেট ভারী করুন, তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু অপার সম্ভাবনার এই পর্যটন শিল্পকে বাঁচান, দেশের অর্থনীতিকে একটু হলেও চাঙ্গা করুন। দেশপ্রেম আপনাদের মধ্যে না থাকুক বা থাকুক, সেটা বড় কথা না, বড় কথা হলো আপনাদের নিজেদের লাভের কথা বিবেচনা করে হলেও বাংলাদেশের পর্যটন এলাকাসমূহে সুস্থ-সুন্দর নিরাপদ একটি পরিবেশ ফিরিয়ে আনুন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সকাল ১০:৪৪