ঝুপ করে ঘন জংগল এসে পড়ে, খুব যে প্রশস্ত তা নয়, তবে অনেক খানিই দীর্ঘ। আবার অতটা ঘনও নয়, বরং অনেকটাই কেমন যেন জড়সর, ঘুপচি ধরনের। খুব বেশি বাতাস বয় না, মৃদুমন্দ। মাঝে সাঝে আলোর ঝলকানি দেখা ছাড়া পুরোটাই কেমন যেন এক চাপা চাপা ছায়া। তবে বনে যতক্ষন থাকা ততক্ষন কেমন যেন মুক্তির স্বাদ। যেন পুরো বনটাই নিজের। এই গাছে হেলান দাও তো, ওই ফুলের গন্ধতে মাতোয়ারা হও।
আর বৃষ্টি পড়লে তো কথাই নেই, চাঁপা চাঁপা গাছের ছায়া, ওই ডাল পালা পাতা চুইয়ে চুইয়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি গায়ে মাখা যে কি একটা সুখ। সন্ধেবেলাতে নিয়ম করে ওই অযত্নে হাস্নাহেনার গন্ধে বুঁদ হওয়া চাইই চাই, হারিয়ে যাবার ভয় নেই যে এখানে, কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না, ওই দেখ ওই বনের ঝোপঝাড় এর মদ্ধেই আছে কোথাও। এর ব্যাতিক্রম হয়নি কখনো। কি যে একটা আত্নসুখ আছে অই অযত্নে বেড়ে ওঠা বনে, কেউ বোঝে না। বোঝার দরকারও নেই। অযত্নে বেড়ে ওঠা কোনো কিছুকে কেউ যখন যত্নে কাছে টেনে নেয় তখন যত্ন অযত্ন মাখামাখি করে কি যে একটা সম্পর্ক তৈরী হয় তার নামকরন বোধহয় মানবচিন্তার বাইরেই কিছু হবে। তবে থাক না, কোন নাম ছাড়াই। একান্ত আপন কিছুকে কেন একটা নামই দিতে হবে, আর কেনই বা তাকে বর্ননাই করতে হবে, অসীম কোন কিছু কে সীমিত কিছু দিয়ে কি আর আখ্যায়িত করা যায়? করলে তা সীমিত কি হয়ে যায় না?
তা যাকগে, যে যাই বলুক, এই বনটাই যেন আমি, আমি যেন আমার ভেতরের নিজেকে দেখি এই বনে, যেন নিজের মাঝেই নিজে দৌড়ে বেড়াই। আত্নসুখ যে একবার পায় তাকে কি কখনো অন্য সুখ মায়ায় বেধে রাখতে পারে? পারে না বোধহয়।
সংগিসাথি খুব বেশি নেই, থাকলেও সবাই মাঠে ঘাটে ঘুরতে চায়, বনে কেউ আসতেই চায় না, কেউ বলে ভয় লাগে, কেউ বলে পাগল, কেউ আবার এড়িয়ে যায়। হাসি পায় মাঝে মাঝে, আরে নিজের মাঝে নিজে হারিয়ে যাওয়াতে এত ভয়? এটা পাগলামি? যাক গে, কে আসল কে আসল না, কে থাকল আর কে থাকল না, তাতে কিছু আসে যায় না। এ বন ছেড়ে আমি কখনোই কোত্থাও যাবো না।
এমনই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল হোসেনের।
প্রতিজ্ঞা মানে প্রতিজ্ঞাই, ওই বিকেলে মাঝে মাঝে এমন কিছু দিন আসে যে কিছুই ভালো লাগে না, না মন খারাপ না, কিন্ত মন বসে না কিছুতেই, কেমন যেন উচাটন, কেমন জানি বিশৃঙ্খল, খেলায় বা আড্ডায় শরীর থাকে কিন্ত মন থাকে না। অমন বিকেলে ওই বনে একলা বসে, গাছে হেলান দিয়ে ঝোপঝাড় এ কেটে যাওয়া দাগ গুলোতে হাত বুলাতে বড্ড ভালো লাগে। এক একটা দাগ, এক একটা যেন গল্প, আঘাতের পরে যে স্মৃতি থাকে তা এক সময় একটা গল্প হয়ে যায়। শরীরের দাগের মত মনেও দাগ পড়ে যায়। মনের দাগ তো আর দেখা যায় না, হাতড়ে হাতড়ে খুজে বেড়াতে হয়। মাঝে মাঝে মনকেই একটা গভীর, অসীম বন মনে হয়। মাঝে মাঝে দাদীমা জিজ্ঞেস করত কি করিস তুই একা একা ওই বনে? বলেছিলাম, ভাবি।
-কি ভাবিস
-ওই কত কিছু, কত স্মৃতি
দাদীমা হেসে বলেছিলেন এইটুকু তোর বয়েস, তোর আবার এত স্মৃতি কিসের।
এইযে দিবা রাত্রি প্রতিটা সেকেন্ড, প্রতিটা প্রহর কত শত কত কি ঘটে যায়, হাজার হাজার, লাখ লাখ কত কিছু, এসব কি কম?
দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে, বয়স বাড়ে, শরীর বাড়ে কিন্তু মন বাড়ে না। ওই এতটুকুই থাকে। দিন দিন বরং টান বাড়ে ওই বনের প্রতি, যেন এক অভ্যাস।
বন পেরোলেই কিছুদূর এগিয়ে নদী, বড্ড ব্যস্ত নদী। নদী পেরোলেই ওপারে শহর। দালানকোঠা, পিচঢালা রাস্তা, সাজানো বাগান, খোলা আকাশ। জীবনের বহু বহু সুযোগ সুবিধা ওখানে। একসাথে বেড়ে ওঠা সংগি সাথির অনেকেই চলে গিয়েছে, যাচ্ছে, যাবে। ভালো পড়ালেখা, ভালো জীবন। যেন জীবনের এক লক্ষ্যই ওপারে যাওয়া। দাদীমাও খুব চাপাচাপি, ওপারে গিয়ে যেন থিতু হই। সংগি সাথিদের সংখ্যাও কমে গিয়েছে, প্রায় একলাই। কিন্তু কই একাকী বোধ তো কখনো মনে হয় না। পরিসর ছোট কিন্তু মুক্ত পাখির মত বিচরন, একঘেয়েও তো লাগে না। বেশ তো আছি, আর কত বড় হতে হবে? যে নদী পেরিয়ে শহরেই যেতে হবে?
এক নির্জন দূপুর বেলাতে হাস্নাহেনার গাছ কে জিজ্ঞেস করেছিলো হোসেন।
কোলাহল যে ভালো লাগে না তা নয়, তবে ভীড় দেখতে ভালো লাগে কিন্তু সেই ভীড়ে মিশে যেতে ইচ্ছে হয় না। তাই মেলা বসলে, বা হাট বাজারের দিনে দূর থেকে দেখতেই ভালো লাগে। দাদী মা খুব রাগ করত, বলত, কি ছেলেরে বাবা, কি বদ বাতাস লাগিয়েছে কে জানে। সারাদিন ওই বন জংগলে ঘুরে বেড়ানো তো ভালোর লক্ষন নয় একদমই। হোসেনের কিছু যায় আসে না। এভাবে দিন যায় বছর যায়, একে একে সবাই এ চলে যায়। একদিন দাদীমা এসে বললেন,
- এবার তোকে যেতেই হবে, আমি আর পারছি না তোকে নিয়ে, আমার মাথা ব্যাথা দূর কর তুই। হোসেন বলল,
-আমি কোথাও যাবি না দাদু
- না গিয়ে আর যাবি কোথায়, সারাদিন তো থাকিস বনের ভেতর। তা দূর থেকে কখনো দেখেছিস ওই বন কে?
-কেন? কি হয়েছে?
-মড়ক লেগেছে রে, ও বন আর বেশিদিন নেই, একবার মড়ক লাগলে কি হয় তুই জানিস না?
-কি যে বলো না তুমি দাদীমা
-যা, নিজে দেখে আয়, ওই উচু টিবি টা আছে না, তোর চাচার বাড়ীর পাশে, ওর ওপর উঠে গিয়ে দেখ গে, যা…
খুব প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলবার যে একটা ভয় মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়, আটকে রাখবার সামর্থ নেই জেনেও মানুষ যেভাবে আর্তি করে বেড়ায় ঠিক তেমনি হোসেন ছুটে গিয়ে টিবিটার উপর উঠে দাড়ালো। স্থির হোলো। দৌড়ে আসাতে ঝাপসা দেখায় সব। স্থির হয়ে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো বনটার দিকে। বনটার শেষ প্রান্তটা হলদেটে। অল্প করে শুরু হয়ে যেন আস্তে আস্তে পুরোপুরি গ্রাস করবার প্রস্তুতি নিয়েছে। এ আর বাঁচবে না। গ্রামের লোকেরা এ বন উজাড় করবে এবার। নইলে ফসলি জমি নস্ট হবে। তাদের কারো কাছে এ বনের কোন মূল্য নেই। তাদের কাছে এ এক আগাছার বস্তু, ঝোপঝাড় মাত্র। বিকেলে খুব শান্ত পায়ে, ধীরে ধীরে হোসেন বনে ঢুকল, গাছ গায়ে স্পর্শ করতে করতে। বুনো গন্ধে একবুক বাতাস টেনে নিল বুকে। মানুষের জীবনে কোন কিছুর মায়া বাড়লে তা যেন কেবল নানাবিধ পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। যেন মায়া জিনিসটা তৈরী হয়ই তা কাটানোর জন্য। যেন মায়া ছুয়ে দিতে আছে, আকড়ে ধরতে নেই।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হোসেন, দীর্ঘশ্বাস গাছের পাতা ছুয়ে গেল। ছুয়ে গিয়ে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যেন আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে লাগল। এ পৃথিবী শূন্যস্থান পছন্দ করে না। হোসেন তা মনে করে না। কিছু শুন্যস্থান, শুন্যই থাকে, গোজামিল দিয়ে হয় না আসলে।
সন্ধ্যা ঘনিয়েছে আগেই, দিগন্তের আভা মিলিয়ে গিয়ে এখন অন্ধকারই। তাতে হোসেনের ভয় হয় না, যাকে ধারন করেছে তার মাঝে থাকতে আবার ভয় কিসের। বাড়ির দিকে ফিরে চলল।
- আমি তোমার মাঝেই থাকব।
চমকে উঠল হোসেন, কে বলল এ কথা? কেউ তো নেই আশেপাশে। তবে কে?
- তোমার মাঝেই আমাকে তুমি খুজো, কখনো ফাকা রাস্তায়, কখনো ল্যাম্পপোস্টের আলোতে, কখনো বড্ড কোলাহলে, কখনো ব্যস্ততম দিনে, আমায় তুমি ডেকো। আমি থাকব তোমার সাথেই।
হোসেন হাসল।
খুব ধীর শব্দে বলল
- আচ্ছা থেকো।
এরপর বহুবছর পেড়িয়ে গেছে। কৈশোর পেড়িয়ে যৌবন, যৌবন পেড়িয়ে মাঝ বয়স। রাত হলেই, হোসেনের কাছে ধরা দেয়, যা সে ধারন করেছে। এ শহর টানে না তাকে। এ শহরে সোদা মাটির গন্ধ নেই, ঘাসে পা রেখে হাটার সেই মোলায়েম অনূভুতি নেই। বাতাস বইলে গাছের পাতা ছুয়ে দিয়ে যায় না গাল।
এ শহরে বৃষ্টি হয়, বৃষ্টি গা ছুয়ে যায়, মন ছোয় না, জাগায় না শিহরণ। রাতে ঘুম হয় না, বহুকাল ধরেই। ওই রাত হলেই হোসেনের এক বন্ধ দুয়ার খুলে যায়, হোসেন প্রবেশ করে একটা একটা জানালা খুলে দেয়, সেই জানালা দিয়ে কত কিছু দেখে।
ফিরে যাবার পথ নেই। ওই যে শুন্যস্থান পূরণ এর ব্যাপারটা। বেশ ক বছর আগে ফিরে গিয়ে দেখে দালান কোঠায় জমজমাট সেই বনের জায়গাটা। এই প্রকৃতি মানুষকে কেবল দিয়েই গেল, কিছু চাইল না বিনিময়ে। হয়ত চেয়েছিল কেউ তাকে খুব করে মনে করুক, মনে রাখুক। ব্যাস, হয়ত শুধু এটুকুই চেয়েছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:০৪