ব্যাক্তিজীবনে ধর্মঃ আধ্যাত্বিক প্রশান্তির জন্য যুগ যুগ ধরে মানুষ ধর্মের কাছাকাছি এসেছে এবং ধর্মীয় বিধি-নিষেধ পালনে নিজেদের আত্বার খোরাক খুজে নেয়ার প্রবনতা দিন দিন বাড়ছেই।আজকের এই মেটেরিয়ালিসটিক দুনিয়ায় এর চাইতে কম খরচে আত্বার প্রশান্তি খুজে পাওয়া মুশকিল।পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যেহেতু স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী,তাদের দৈনন্দিন জীবনে তাই ধর্মের ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায়।সেমেটিক ধর্মগুলোতে যারা বিশ্বাসী তারা এও বিশ্বাস করে যে স্রষ্টার বিধান এত ব্যাপক যে সে অনুসারে রাষ্ট্রও পরিচালনা করা সম্ভব।যাই হউক এখানে কোন ধর্ম ভাল-খারাপ এই জাতীয় কেচালে যেতে চাইনা।মুল বিষয় হলো ধর্মীয় রাজনীতি
ধর্মহীন জীবনঃসকল ধর্মের মৌলিক বৈশিষ্টই হচ্ছে পরকালে বিশ্বাস।পরকালে অস্বীকার করার কারনে মানুষ তার আশা-আকাংখা ও চিন্তা-ভাবনার নিন্মস্তরে নেমে যায়।বস্তুগত আরাম-আয়েশের সন্ধান এবং প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করার নেশা এ সকল কথা চিন্তা করারই অবকাশ দেয়না।
রাজনীতিঃ নীতির রাজা হচ্ছে রাজনীতি এটি একেবারে সাদামাটা একটি সংজ্ঞা।এই নীতি তিনিই তৈরি করতে পারেন যার সময়ের জ্ঞান আছে,যে একটা নির্দিষ্ট সময়ে সীমাবদ্ধ নয়।মানুষের সীমাবদ্ধতা ব্যাপক যার কারনে তাদের তৈরি নীতি প্রতি নিয়ত পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশের সংবিধান এই যাবত ১৪ বার পরিবর্তন হয়েছে।এখানেও মানুষ্য তৈরি নীতির সীমাবদ্ধতা রয়েছে,যে কোন মানুষ এককভাবে সবার কল্যাণকামী হতে পারেনা,সে নিজের হিসাবটা ভাল করে হয়ত বুঝে,অন্যরা কি পেল বা হারালো তা তার চিন্তার বাহিরেই থেকে যায় অনেক সময়।
সবার জন্য কল্যানকামী হতে পারে একমাত্র স্রষ্টা কারন তার কোন নির্দিষ্ট দল নাই।আধুনিক বিশ্বের কোন বিবেকবান মানুষ যদি স্রষ্টার ঐ নীতিকে নীতির রাজা ধরে নিয়ে রাজনীতি করে মানুষের সেবা করতে চান তা একমাত্র নাস্তিক ব্যাতীত কারো কাছে অগ্রহনযোগ্য হবার কথা নয়।
ধর্মনিরপেক্ষতা,গনতন্ত্র ও ধর্মীয় রাজনীতিঃ ধর্মনিরপেক্ষতার আভিধানিক অর্থ আমাদের দেশে অচল তাই ঐ দিকে যাওয়ার ইচ্ছা নেই।সহজ কথায় আমাদের দেশের সংজ্ঞা অনুসারে "ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার কে আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বলা হয়"।এই সংজ্ঞায় আমাদের দেশ যুগ যুগ ধরে ধর্মনিরপেক্ষ বলেছেন প্রফেসর এমাজ উদ্দিন আহমেদ।গনতান্ত্রিক দেশে এই সংজ্ঞার ধর্মনিরপেক্ষতা যদি সংবিধানেও প্রতিষ্ঠিত থাকে তবুও ধর্মীয় নীতির রাজনীতি একই সাথে চলতে কোন সমস্যা নেই।
কারন মানুষ যাদেরকে ইচ্ছা ভোট দেয়ার অধিকার রাখে, কেউ যদি মনে করে ধর্মনিরপেক্ষতা দেশের জন্য ভাল অথবা ধর্মীয় রাজনীতি ভাল সেই অনুসারেই মানুষ ভোট দেবে এবং দেশ পরিচালনার জন্য প্রতিনিধী নির্ধারন করবে, এখানে আমি কে কাউকে খবরদারী করার?আমার কাজ হচ্ছে আমি যে আদর্শে বিশ্বাস করি তা মানুষের কাছে যথাযত ভাবে পৌছানো তারপর মানুষকে তার চয়েসে করার সুযোগ দেয়া।
গনতান্ত্রিক বিশ্বে ঠিক এভাবেই মানুষ নিজেদের আদর্শ দিয়ে রাজনীতি করে যাচ্ছে।
যাই হউক, আমাদের বাংলাদেশীদের ভিতরে উন্নত বিশ্বের অন্ধ অনুকরন করার একটা বৈশিষ্ট দেখা যায়, আসলে এটা শুধু আমাদের না, যুগ যুগ ধরে মানুষ অর্থ, প্রতিপত্তি,ক্ষমতাকে সমীহ করে চলে আসছে,পাশ্চাত্য এখন এই অবস্থানে যাদেরকে আমরা উন্নত বিশ্ব বলে থাকি। নিচে বিভিন্ন উন্নত দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কিছু উদাহরন দেয়া হলো;
কানাডা/ আমেরিকাঃ
১। খ্রিষ্টান হেরিটেজ পার্টি অফ কানাডা
২। খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ কিউবেক
৩। দি ইসলামিক পলিটিকাল পার্টি অফ আমেরিকা
সেকুলার রাষ্ট্রে ধর্মভিত্তিক দল যেখানে কাজ করছে সেখানে আমাদের দেশে গায়ের জোড়ে তা বন্ধ করে দেয়ার দাবী কতটা যুক্তিযুক্ত?
সমাজতান্ত্রিক দক্ষিন আমেরিকাঃ
খ্রিষ্টান ডেমোক্রেট অরগানাইজেশন অফ আমেরিকা এটি একটি আম্বরেলা প্রতিষ্ঠান।এর আন্ডারে দক্ষিন আমেরিকার ২৬টি দেশের ৩৩ টি খ্রিষ্টান পলিটিকাল পার্টি রয়েছে।
সমাজতন্ত্রের সাথে অনেকে ধর্মের সংঙ্গাত খুজে পান,যার ফলে অনেকে সেকুলার ও নাস্তিক হয়েছেন। সেকুলারদের ও প্রকারভেদ রয়েছে যেমন নিরীহ সেকুলার,মডারেট এবং ডাইহার্ড সেকুলার বা নাস্তিকও বলা চলে।প্রথম দুই গ্রুপ অন্যের স্বাধীনতায় কিছুটা বিশ্বাসী হলেও পরের গ্রুপ অনেকটা তালেবান মতই কট্টর।তাদের অন্তর জ্বালার বহিপ্রকাশই হলো বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার জন্য লম্ফ-জম্প,এটার মাধ্যমে যে তারা দেশকে আবারো অস্থিতিশীল করতে চায় তাতে কোন সন্দেহ নাই।
গ্রেট বৃটেন/ যুক্তরাজ্য:
১। খ্রিষ্টান পার্টি
২। দি খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি
৩। খ্রিষ্টান পিপলস এলাইয়েন্স
৪। ইসলামিক পার্টি অফ বৃটেন
এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার রাষ্ট্র সেকুলার হলেও যেকোন মানুষের মত প্রকাশ করার,স্বাধীনভাবে চলার এবং স্বাধীনভাবে সংগঠিত হওয়ার অধিকার রয়েছে।
ইউরোপ:
১।ডেনমার্ক- খ্রিষ্টান ডেমোক্রেট
২। চেক প্রজাতন্ত্র- খ্রিষ্টান এন্ড ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন , ভোট এবং সাপোর্টারের দিক থেকে এই পার্টির অবস্থান অনেকটা বাংলাদেশের জামায়াত ইসলামীর মত।
৩। ফিনলেন্ড- খ্রিষ্টান ডেমোক্রেট, গড়ে ৫% ভোটার রয়েছে এই দলের
৪।ফ্রান্স- খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি
৫। জার্মানী-জার্মানীর ক্ষমতাসীন দল এবং সবচেয়ে বড় দল হচ্ছে খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন ।ই্উরোপের সবচেয়ে বড় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বলা চলে এই দলটাকে।ই্উরোপিয়ান পার্লামেন্টেও রয়েছে এদের শক্ত অবস্থান(৩৪ টি সিট) ।জার্মানীর বর্তমান চ্যানসেলর(প্রেসিডেন্ট)এই দল থেকে নিযুক্ত।মজার ব্যাপার হচ্ছে ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পর পরই এই দলটির জন্ম হয়।
--- সেন্টার পার্টি
--- খ্রিষ্টান সোসাল ইউনিয়ন বাভারিয়া , জার্মানীর আরেকটি শক্তিশালী আন্ঞলিক দল।
৬।গ্রিস- নিউ ডেমোক্রেসি । গ্রিসের সবচেয়ে বড় দুই দলের একটি। ইউরোপের আরেকটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দল,ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের যাদের ৮ জন মেম্বার রয়েছে।
---- পপুলার অর্থডক্স রেলি ।
আরেকটি ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতিক দল। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে তাদেরও রয়েছে ২ জন মেম্বার
৭। ইটালি- ইউনিয়ন অফ খ্রিষ্টান এন্ড সেন্টার ডেমোক্রেটস
এটি ইটালির অন্যতম বড় দল যারা এই মুহর্তে প্রধান বিরোধী দলে আছে
----[link|http://www.mpa-italia.it/portal/|মোভমেন্ট ফর অটোনমিস
--- খ্রিষ্টান ডেমোক্রেসি , আরেকটি কট্টর রাজনীতিক দল
---- ইউ ডি ইউর পপুলারস ।বাংলাদেশের জাতীয়পার্টির সাইজের শক্তিশালী আন্ঞলিক আরেকটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দল
ইউরোপের ছোট দেশগুলোতেও রয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। ইউরোপে ধর্মীয় রাজনীতির যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান,তাই বলে কি ইউরোপ উন্নতি করেনি?
দক্ষিন আফ্রিকাঃ
১। আফ্রিকান খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি ।পার্লামেন্টে তাদের উপস্থিতি রয়েছে
২। খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি , এটি অনেকটা ঐক্যজোট টাইপের হার্ডকোর খ্রিষ্টান পার্টি।
৩। ইউনাইটেড খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি ।আফ্রিকান পার্লামেন্টে তাদেরও উপস্থিতি রয়েছে।
আফ্রিকার অন্যান্য দেশেও রয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ব্যাপক উপস্থিতি।
অস্ট্রেলিয়া:
১। খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি
এছাড়াও পৃথিবীর আরো বহু উন্নত দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম রয়েছে।
দক্ষিন-পুর্ব এশিয়া
১। ভারত- বিজেপি ভারতের প্রধান বিরোধী দল , যার নাম আমরা মোটামুটি সবাই জানি।ধর্মীয় রাজনীতির দিক দিয়ে বিজেপি লিটারেলি অনেকটা লিবারেল।গুজরাটের কাহিনীর মাধ্যমে আমরা দেখি ওদের লিবারেল অবস্থান।তখন একটাই প্রশ্ন লিবারেলদের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে এক্সটিমিষ্ট হিন্দু দল গুলোর কি অবস্থা? কট্টর হিন্দুবাদী দল ইন্ডিয়াতেকমপক্ষে রয়েছে ২০-২৫টা জাতীয় লেবেলে,লোকালি আরোতো রয়েছেই । সবগুলোর লিষ্ট দিলাম না,লেখার কলেবর বেড়ে যাবে বলে।
২। ইন্দোনেশিয়া-ইন্দোনেশিয়ান ধর্ম এওয়েকেনিং পার্টি
৩।নেপাল- নেপাল শিবসেনা
৪। বাংলাদেশ- আমাদের দেশেও বঙ্গসেনা ,বীর বঙ্গসেনা, বীর বঙ্গ হিন্দু প্রজাতন্ত্র, স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলন , উদ্ভাস্তু উন্নয়ন পরিষদ নামে কুয়েকটি হিন্দু দল কাজ করছে।তবে কয়েকটা বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত থাকার সরকারী অভিযোগ।এদের কয়েকটার বেইস হচ্ছে ইন্ডিয়া।সাধারন জনগনের সাথে এদের যোগাযোগ কম থাকায় এদের নাম ওভাবে লাইম-লাইটে আসেনা।
আমি এখানে অমুসলিম ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখানোর চেষ্টা করেছি, কারন মুসলিম দেশে ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, সংগঠন থাকাটা স্বাভাবিক।এদের নিয়ে আরেকটা পোষ্ট দেয়ার ইচ্ছা রাখি।
প্রেক্ষাপট বাংলাদেশঃ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বয়স বাংলাদেশে সেকুলার রাজনীতির বয়সের চেয়েও বেশি।কিন্তু আবহমান কাল থেকে বাংলাদেশের মানুষ হার্ডকোর ধার্মিক না হওয়ার ঐ জাতীয় রাজনীতি তেমন একটা সফলতার মুখ দেখেনি।কিন্তু দুই প্রধান দল কতৃক প্রতারিত হতে হতে এবং তাদের পরিবারতান্ত্রিক, দূর্ণীতির রাজনীতি দেখতে দেখতে মানুষ বিরক্ত।যার ফলে ধর্মভিত্তিক দল ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করছে এবং দেশের রাজনীতিতে তৃতীয় চয়েস হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।এখানেই শুরু হয়েছে সেকুলার দল সমুহের অন্তর জ্বালা।
উদাহরন হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের কথা বলি, স্বাধীনতার পর পর নির্বাচনে ১৯৭৩ সালে যেখানে ভোটের সমর্থন ছিল ৭৩.৬৬%,২০০১ সালে তা নেমে দাড়ায় ৪০.০২% এ, এই অবস্থায় ২০০৮ সালে তেনারা এককভাবে নির্বাচনে যাওয়ার সাহস না করে সমমনা ১৪ গোষ্ঠি মিলে নির্বাচন করে ভোট তুলতে পেরেছেন ৪৯%। এই যে বিশাল ধস তার জন্য নিজেদের ভূলত্রুটিকে স্বীকার না করে ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধের উদ্ভট আওয়াজ তুলছেন।কৌশল হিসেবে ৭২এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার আওয়াজও তোলা হচ্ছে,তাদের মনে রাখা উচিত ৭২ আর ২০১০ এক নয় মানুষ আপনাকে ৭২-৭৫ এ দেখেছে,৯৬ এ দেখেছে, এখনো দেখছে...দেশের ৫০% মানুষ এখনো ঐ জাতীয় যেকোন সীদ্ধান্তের বাহিরে অবস্থান করছে।গায়ের জোরে কোন কিছু আপনারা আগেও চাপাতে চেয়েছেন, ফলাফল বড়ই মর্মান্তিক!
বরং দেশ গঠনে সবাইকেই সাথে নিতে হবে।সবচেয়ে বড় কথা হলো আদর্শ কে আদর্শ দিয়ে মোকাবেলা করে বাকীটা মানুষের উপর ছেড়ে দেয়ার গনতান্ত্রিক পদ্ধতি থাকতে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবী কতটা গনতান্ত্রিক সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন? অবশ্য কারোর যদি মানুষেরর উপর আস্থা না থাকে সেটা ভিন্ন কথা।
নোটঃ এই পোষ্টে ধর্ম ও নাস্তিকতার হাইপোথেটিকাল কেচাল না করার অনুরোধ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১০ রাত ৯:৩৩