কোথায় এই সুসং রাজ্য বা সুসং নগরঃ
24º- 57'' উত্তর আংশ ও 25º- 12'' উত্তর আংশ ও 90º- 28'' এবং উত্তর আংশ ও 90º- 47'' পূর্ব দ্রাঘিমাংশে আজ যেখানে সুসঙ্গ দুর্গাপুর উপজেলার অবস্থান সেখানেই একসময় গড়ে উঠে ছিল সুসং রাজ্য বা সুসং নগর। সুসং রাজ্যে প্রায় ৭০০ বছর ধরে শাসন করেছিলেন রাজা-মহারাজারা। বর্তমানে এই নগরের উত্তরে রয়েছে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে নেত্রকোণা জেলার সদর ও পূর্বধলা উপজেলা, পূর্বে কলমাকান্দা উপজেলা, পশ্চিমে ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলা।
যেভাবে সৃষ্টি হলো সুসং রাজ্যঃ
অনেক অনেক কাল আগে ১২৮০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে মাঘ মাসের শীতকালীন অবসরে ভারতের কান্যকুব্জ থেকে একদল সাধু বেরিয়েছিলেন তীর্থ ভ্রমণে। বিভিন্ন তীর্থস্থান ঘুড়তে ঘুড়তে এক সময় তারা উপস্থিত হন গৌহাটির নিকটস্থ পাহাড়ে অবস্থিত কামাখ্যা মন্দিরের পূন্যপীঠে। কিছুদিন সেখানে অবস্থানের পর নদীর তীরে বিগ্রহ লক্ষ্মী নারায়ণজীর আবাসে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানে মগ্ন হন ঈশ্বর আরাধনায়। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। নিরব পাহাড়ি পরিবেশ তাদেরকে বেশ প্রশান্তি দিচ্ছিল। হঠাৎ একদিন একদল দরিদ্র ধীবর সেখানে উপস্থিত হয়ে সাধুদের জানালেন যে 'পাহাড় মুল্লুকে' বৈশ্য গারো নামে এক দুর্ধর্ষ ও অত্যাচারী রাজা তাদের উপরে ক্রমাগত নির্যাতনের করে চলেছে । এ হেন অবস্থা থেকে তারা পরিত্রাণ চায়।
ধীবরদের মুখে এ নির্যাতনের কাহিনী শুনে এক প্রবীণ সাধুর মনে দয়ার উদ্রেক হয়। তিনি তার কনিষ্ঠ সাধু সোমেশ্বর পাঠককে বলেন, সোমেশ্বর তুমি 'এই অরণ্যভূমি অধিকার করে এখানে একটি রাজ্য স্থাপন কর! তাতে তোমার অভীষ্ট সিদ্ধি ও ধীবরদের মঙ্গল হবে। জ্যোষ্ঠ সাধুর নির্দেশকে শিরোধার্য ভেবে আরও কয়েকজন সন্ন্যাসীকে নিয়ে সোমেশ্বর পাঠক থেকে গেলেন নিবির পাহাড়ি অরণ্য এ জনপদে। আর বাকি সাধুরা চলে গেলেন পূর্বের গন্তব্যে।
তারপর সোমেশ্বর পাঠক অন্যান্য সহচর ও ধীবরদের নিয়ে একটি দল সংঘঠন করেন এবং অত্যাচারী বৈশ্য গারো রাজাকে পরাজিত করে তিনি নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন নতুন এক রাজ্য। যার নাম দেন 'সুসং রাজ্য। রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর রাজ্যের পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলধারায় প্রবাহিত পাহাড়ি নদীটির নাম দেন 'সোমেশ্বরী।' ৩,৩৫৯ বর্গমাইল এলাকা ও প্রায় সাড়ে নয়শত গ্রাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় সুসং রাজ্য। সুসং রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু এক বিরান ভূমিকে করা হয় রাজধানী। রাজধানীর নাম রাখা দুর্গাপুর। বর্তমানে সেই দূর্গাপুর জনপদটিই নেত্রকোনার জেলার সুসঙ্গ দূর্গাপুর উপজেলা নামে পরিচিত।
সুসং রাজবংশের কথাঃ
সুসং রাজ্যের প্রথম রাজা হন সোমেশ্বর পাঠক তিনি প্রায় ৬০ বৎসরের মতো রাজত্ব করেন ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে রাজা হন তার বংশধররা। তার বংশধরদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য রাজা ছিলেন রাজা রঘুনাথ সিংহ সুসঙ্গ রাজবংশের রাজাগণের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাধিক পরাক্রমশালী। তার জীবন অত্যন্ত ঘটনা বহুল। তিনি তার পিতার মৃত্যুর পূর্বেই রাজ্যভার গ্রহণ করেছিলেন। সে সময় বাংলার বার ভূঁঞাদের নেতা ঈশা খাঁ-র সাথে রাজ্যের সীমা নিয়ে বিরোধ সৃস্টি হয়েছিল। তাই ঈশা খাঁ সুযোগ মত রাজা রঘুনাথকে কৌশলে বন্দী করেন। রঘুনাথ সিংহ তার গারো ও হাজং বাহিনীর প্রচেষ্টায় রাতের আধারে পলায়ন করে সুসঙ্গ রাজ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মোগল সেনাপতি মানসিংহের সহায়তায় দিল্লীতে মোগল সম্রাটের দরবারে হাজির হন। রঘুনাথের সুঠাম ও বলিষ্ঠ দেহ অবলোকন করে সম্রাট আকবর তার প্রাসাদের দ্বার রক্ষী নিয়োগ করেন। এরপর সম্রাট আকবর রঘুনাথ সিংহকে চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের বিরদ্ধে যুদ্ধাভিযানে প্রেরণের করেন সেসব যুদ্ধে জয়লাভের জন্য পুরস্কার স্বরূপ সম্রাট আকবর সুসঙ্গ রাজ্যকে -মুলকে সুসঙ্গ- নামকরণ করে তাকে শাসনভার পুনঃ প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদান করেন।
সুসং রাজ্যের রাজাদের মধ্যে রাজা রঘুনাথের পর উল্লেখযোগ্য রাজা হলেন রাজা রাজ সিংহ : তিনি বাংলা ও সংস্কৃতি ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। রাজা রাজসিংহ রাজশাসনের সাথে সাথে সাহিত্য চর্চায় অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। সাহিত্য সমাজে তিনি প্রাচীন সুসঙ্গের উচ্চ শ্রেণীর কবি হিসেবে পরিচিত লাভ করেছিলেন। ভারতী মঙ্গঁল, রাগমালা, মানস পাঁচালী, ঢাকা বর্ণনা ইত্যাদি গ্রন্থাবলী প্রণয়ন করে সাহিত্য জগতে রাজা রাজ সিংহ অমর হয়ে আছেন। রাজা রাজসিংহের আমলেই সুসং রাজ্যে সর্ব প্রথম আর্যপ্রভা” নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। এবং সেটি নিয়মিত ছিল। সর্বশেষ সুসং রাজ্য থেকে ১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দে “আর্য প্রদীপ” ও “কৌমুদী” নামক দু’টি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
যেভাবে সুসং রাজ্যের পতন ঘটলোঃ
সোমেশ্বর পাঠকের প্রতিষ্ঠিত সুসং রাজ্যটি রাজ্য নিয়ন্ত্রণ হারায় রাজা রাজকৃষ্ণের শাসনামল থেকে। গোটা রাজ্যটাকে তার শাসনামালে চার ভাগে ভাগ করা হয় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় চারটি রাজবাড়ী বা প্রাসাদ। বাড়িগুলো 'বড় বাড়ি', 'মধ্যম বাড়ি', 'আবু বাড়ি' ও 'দু'আনি বাড়ি' নামে পরিচিত লাভ করে। আর ভাগ হয়ে যাওয়া রাজ্য ক্রমশই তার জৌলুশ হারায়। ৪৭-এর দেশ বিভাগ এবং '৫৪ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আইন পাস হবার পর রাজবংশের সদস্যরা ভারতে চলে যান। ফেলে রেখে যান শাসন বিহীন সুসং রাজ্য। ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সুসং রাজ্যের অনেক অংশ মাটির অভ্যন্তরে বিলীন হয়ে যায়। আর এভাবেই অবসান ঘটে শৌর্য-বীর্যখ্যাত সুসং রাজ্যের। সোমেশ্বর পাঠক ও তার বংশধরেরা প্রায় ৬৬৭ বছর ধরে শাসন করেছিলেন সুসং রাজ্য।
সুসং রাজ্য থেকে সুসঙ্গ দূর্গাপুরঃ
সুসং রাজ্যেটি তৎকালীন সময়ের উল্লেখ যোগ্য দৃষ্টিনন্দন একটি রাজ্য ছিল। মোহনীয় পরিখাবেষ্টিত রাজবাড়ির অভ্যন্তরে ছিল সৈন্য আবাস, বিচারালয়, কারাগৃহ, অস্ত্রাগার, চিড়িয়াখানা, হাতিশালা, রাজপরিবারের সদস্যদের প্রাসাদ, শয়নকক্ষ, কাছারি, বৈঠকখানা ইত্যাদি। সুসং রাজাদের নির্মিত বড় বাড়ি'র সামনে তিনতলা একটি বড় ঘর ছিল যেটিকে 'রংমহল' বলা হতো। দেশ বিভাগের পরও সেই ঘরটি ছিল। ১৯৭০ সালে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় সুসং ডিগ্রী কলেজ । বর্তমানে সেখানে একটি পানির ইঁদারা ও সীমানা প্রাচীর ছাড়া বড় বাড়ির আর কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই। 'মধ্যম বাড়ি'র বাইরের পূর্ব দিকের একটি ঘর এখন দুর্গাপুর সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এবং একটি কাছারি ঘর ব্যবহৃত হচ্ছে দুর্গাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে। ১৯৬৯ সালে মধ্যম বাড়ির অভ্যন্তরের কয়েকটি ঘর নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় দুর্গাপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
সুসং রাজ্যে সর্বশেষ বসবাস করেছিলেন সুসং রাজ বংশের রাজসদস্য অমরেন্দ্র সিংহ শর্মা। 'আবু বাড়ি'তে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের সময় তিনি বসবাস করতেন। সুসং দূর্গাপুর তিনি 'মিনি বাহাদুর' নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর দেশত্যাগের পর ওই বাড়ির কয়েকটি ঘর বিভিন্ন সময় সরকারী কর্মকর্তাদের বাসাবাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে সেটি ম্যাজিস্ট্রেট বাস ভবন হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
দু'আনি বাড়ির কিছু স্মৃতিচিহ্ন এখনও অক্ষত আছে। বর্তমানে ওই বাড়িতে বসবাস করছেন গোপাল দাস নামে এক ব্যক্তি। তিনি রাজবাড়ির সাবেক কর্মচারী সাধুচরণ দাসের পৌত্র।
তৎকালীন সময়ে কাঠের তৈরি এ ঘরগুলোর নির্মাণশৈলীও বেশ নান্দনিক। এছাড়াও দুর্গাপুরের সুসঙ্গ রাজাদের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে আছে ১৯১৮ সালে স্থাপিত মহারাজা কুমুদচন্দ্র মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়। এটিই সুসং দূর্গাপুরের প্রথম বিদ্যাপীঠ। এছাড়া সোমেশ্বর পাঠক এর প্রথম স্থাপনাকৃত ধর্মীয় উপসনালয়টি বর্তমানে দশভূজা মন্দির নামে পরিচিত। সুসঙ্গ রাজ্যের আরেক রাজা জানকীনাথ, রানী: কমলা রানীর অনুরোধে নির্মাণ করেছিলেন এক মস্ত দীঘি যার নাম ছিল সাগর দীঘি। কিংবদন্তী ইতিহাস নিয়ে এ দীঘিটি পরিচিত হয় 'কমলা রানীর দীঘি' নামে। কয়েক বছর আগে ঐতিহাসিক দীঘিটি সোমেশ্বরী নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
এভাবেই প্রতিনিয়ত একটু একটু করে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সুসং রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ। হয়তো একসময় সুসং রাজ্য শুধু লোকের মুখে আর কাগজে-কলমেই থাকবে তার আর কোন উপাদান রবে না সুসং জনপদে।
সূত্র-
নেত্রকোণার আলো-আলী আহাম্মদ খান আইয়োব
সুসং রাজ্যের কথা-সঞ্জয় সরকার