“ রাজনীতির ঘোলা জলে পড়ে তুই একদিন পত্রিকার ফটো হয়ে যাবি;
শুধুই কি ফটো হয়ে যাবো; দেখিস দেয়ালের পোষ্টারও হয়ে যেতে পারি।”
০১.
এক লাফে পাচিল টপকালাম।
শব্দগুলো পিছু পিছু আসছে দুর্দান্তবেগে। একমুহুর্ত দাড়াবার কোন উপায় নেই,ছুটছি উর্ধশ্বাসে, পিছু পিছু ছুটছে শব্দ গুলো নেড়ি কুকুড়ের মতো; ঘামছি দর দর করে কিন্তু থামছি না। হৃদপিন্ডটা লাফাচ্ছে কুমারের হাপরের মতোন। মনে হচ্ছে ছিটকে বেড়িয়ে যাবে যে কোন সময়।
পায়ের গতি ক্রমশই স্থিমিত হয়ে আসছে। হাটুর গিট্টা ব্যাথায় টনটন করছে,কোথায় লেগেছে কে জানে? গতির মাঝেই পাশ পকেটটায় হাতরালাম নাহ্ সেলফোনটাও নেই সে খোয়া গেছে আমারি মতো!!
বোঝা গেল আজ কোন সাহায্য পাওয়া আমার হবেনা। শব্দের গতির কাছে কতক্ষণ টিকতে পারবো জানিনা। পাশ ফিরতে গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খেলাম চকিতে মাথাটা ঘুড়ে গেল। ডানদিকের গলিটায় ঢুকলাম আরংয়ের দোকানটা বন্ধ। বা হাতি মোড়ে আকমলের ঝুপড়িতে তালা ঝুলছে। সব শালা আজ ঘুমপাড়ানীয়া মাসির হাত ধরেছে।
বামদিকের গলিতে এখনও নিস্তব্দতা চোখ ঘুড়িয়ে দেখি মহাথীর রোডে সবে মাত্র জিমন্যাস্টিকের ছেলেগুলো নেমেছে, ভাবলাম একবার ওদের মাঝে মিশে যাইনা। ডানহাতি রিপ কর্ণার পেড়িয়ে বেদীটার পাশে দাড়ালাম। শব্দগুলো আমার অস্তিত্ব না পেয়ে কুকুড়ের মতো দৌড়ে রাস্তা ছাড়লো বটে আমার পিছু যে ছাড়বেনা তা বুঝতে পারছি।
০২.
কোনরকম দেয়াল সেটে দাড়িয়ে আছি এই অন্ধকার গলিটাতে। নিশ্বাসটাও কি আজ বিশ্বাসঘাতকতা করবে আমার সাথে। হাটু থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে মাটিতে ধূলো কিছুটা জমাট বেধে গেছে; রক্তের দাগ দেখলে আর রক্ষে নেই ধরে ফেলতে সুবিধা হবে। পা দিয়ে বালি এনে ঢেকে দিলাম রক্তের দাগটাকে। পিছনে আসা পদ শব্দগুলো খুজে খূজে তোলপাড় করছে সব।
ডানদিকে তাকিয়ে একটু জোড়ে নিশ্বাস টানলাম শীতের সকাল বেশ ঠান্ডা; গলার ভেতরটা ব্যাথায় কাদঁছে কিন্তু কি করবো একটু চোখ বন্ধ করলাম একটা প্রাণভরে নিশ্বাসের আশায় চোখ খোলার আগেই শব্দটা আবার কানে বাজছে; কেউ যেন এগিয়ে আসছে আমার দিকে ।
এ এলাকাটা আমার পরিচিত রাজবাড়ীর পাশেই থাকে শ্যামলী কথাটা মনে হতেই সেই দিকটায় দৌড় লাগালাম।
চায়ের পট উল্টে ফেলে দিয়ে একেবারে সোজা অন্দরে। সকালের চা’টা বোধহয় আর খাওয়া হলোনা ওদের। কিন্তু এ সব ভাববার সময় বড় অল্প রাস্তাটা চেনাই ছিলো সোজা রান্নাঘরে ঢুকলাম।
শ্যামলী বোধহয় পরোটা ভাজছিলো হঠাৎ মুখোমুখো দেখে বলল তুই এখানে? এ রকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলোনা ও। গত সপ্তাহে যে পরিমান কলহ আর বচসা হয়েছে তাতে আজ ওদের বাসায় আমাকে দেখে খানিকটা অবাক হওয়া অন্যরকম কিছু নয়
হাতটা ধরে ঝাকিয়ে বললো কি,রে অনি তুই এখানে? এই সাত সকালে? কি হয়েছে? আমি শুধু বললাম একটু লুকাতে দে আমায়। আর না দাড়িয়ে সোজা গ্যাসের ট্যাংকির পেছনে দাড়ালাম।
শব্দগুলো ততক্ষণে সদর দরজায় এসে গিয়েছে।
শ্যামলী গেলে এগিয়ে সে,দিকে। কাকাবাবু গিয়ে ওদের সামনে দাড়াবার পর অনুসন্ধানী চোখ গুলো বললো এখানে কেউ ঢুকেছে? না বলা সত্বেও ওরা ক্ষান্ত হলোনা তছনছ করলো পুরো ঘর। খিস্তি দিয়ে বললো শালা পালাবি কোথায়? পেলে ছিড়ে খাবো !!!
পায়ের শব্দটা মিলিয়ে যেতেই আমি স্থান পরিবর্তন করলাম। শ্যামলী পথ আগলে দাড়ালো; অনি বলতো ওরা তোকে খুজছে কেন? কেন আবার জানিস না তুই জাল ভোট ঠেকিয়েছি যে? রক্ত চুষে খেতে খেতে রক্ত চোষা হয়ে যাচ্ছে যে; ঠেকাতে হবেনা। প্রতিবাদ করেছি পিছু নিয়েছে।
শ্যামলী মাথা ঝাকিয়ে বলে দেশপ্রেম করতে গিয়ে নেতা হয়েছিস ; তোর মা’র তো একটাই ছেলে আধার রাতের সলতে ; মারা পড়লে শোক সইতে পারবে তো। আর তোর একার প্রচেষ্টায় নিশ্চই দেশটা রসাতল থেকে উঠে আসবে না।
আমি বললাম বাজে বকিস না তো!!
সবাই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হলে দেশ শাষণ করবে কে? নামধারী যে কটা আছে সব’কটাতো নিজেদের আখের গোছাতে ব্যাস্ত। আমি দেশকে ভালবাসি তাই নেমেছি । জানিনা এ ক্রান্তিকাল টিকে যেতে পারবো কি,না।
০৩.
আমি প্রাণপন ছুটছি। পায়ে খিল ধরে গেছে । এই বুঝি ভেতরটা গুড়িয়ে যাবে। শব্দটা ছুটছে আমার পিছনে ঘোড়ার মতো। ঝোপের পাশ কাটিয়ে রেল লাইনটা পাড় হলাম। এর পর আর রাস্তা নেই।
ওহ !!!!!
আর পিছু ফেরা হলোনা আমার শব্দটা ঝাপিয়ে পড়েছে আমার গায়ে..............
ধারালো ছুড়ির ফলাটা পুরো ঢুকে গেছে পেটের মাঝখানে। গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণা। মৃত্যুর স্বাদটা ভয়ংকর মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে সব ঝাপসা হচ্ছে। ঝাপসা থেকে আরো ঝাপসা। ঝাপসা থেকে ধোয়াটে; ধোয়াটে থেকে ক্রমশই কুন্ডলী পাকাচ্ছে। ঘুড়ছে বিশ্বলয় আমার চারপাশে। চারপাশ থেকে চারপাশের স্মৃতিকে টেনে এনে মিশিয়ে ফেলছে সব কিছুতেই ভজঘট।
মনে পড়ছে ছোটবেলায় একবার হাত কেটে রক্ত দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আজ হাত ভরতি রক্ত; জমাট বাধছে। পৃথিবীটা দুলছে। চোখে ভাসছে আম বাগানের ভাষণ একদিন দেশ গড়বো নেতাদের তুমুল করতালি। পুলিশ বলছে ঘুষ খাবো দেখি ঠেকায় কি করে।
সব ক’টা জোচ্চোর মিলেছে একসাথে। সব মিলিয়ে ভজঘট আর ভজঘট। রাজনীতি ,রাজারনীতি স্বার্থনীতি সব নিয়ে পেটনীতি। আমি বাচঁতে চাইবো কি? আজ লাশটা ওরা পাবে কি আমার? কিছু আর ভাবতে পারলাম না
আমি মরে যাচ্ছি মা ডাকছে অনি আজ ইলিশ রেধেছি শর্ষে দিয়ে খাবিনা ? মা, আমি যাচ্ছি তোর অনি আর রাত করে ঘরে ফিরবে না।
এবার চোখ বন্ধ করতে যাবো শ্যামলী বলছে অনি তোকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে আমি কি ভুল করলাম নাকি, আমি চুপ অন্ধকার আমায় ডাকছে................আমি মরে যাচ্ছি
০৪.
আমার লাশটা রেললাইনের ড্রেনে পড়ে আছে।
উৎসুক জনতার মুখ আমাকে দেখছে চেয়ে চেয়ে। আমার ফটো তুলছে সাংবাদিক পত্রিকায় ছাপা হবে। ছাত্র নেতার লাশ ড্রেনে পড়ে আছে। আজ শুধু ফটো নয় দেয়ালের পোষ্টারও হয়ে যাবো আমি। আমাকে ঘিরে স্লোগান উঠবে আজ। তারপর একসময় সব স্থিমিত হবে। আমি শুধু পোষ্টার হয়ে ঝুলে রইবো দেয়ালে দেয়ালে।
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০১২ রাত ১১:২৪