আহ শান্তি! মেয়ে মানুষের মুখে গালি খেলেও শান্তি!
আমি লজ্জা লজ্জা মুখে মেয়েটাকে বললাম, “আরেকটা গালি দেবেন? প্লিজ!”
মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর কি না কি ভেবে আরেকটা গালি দিল,
“কুত্তা!”
আবারও শান্তি পেলাম। শান্তিতে চোখ বুজে ছিলাম অনেকক্ষণ। চোখ খুলে দেখি মেয়েটা লাপাত্তা। আমি বাসায় চলে আসলাম। এসে দেখি বাসায় অনেক শোরগোল। অনেক মানুষ। ভয়ে ভয়ে নিজের রুমে এসে বসলাম। মা এসে বললো, “হারামজাদা! মেয়ের বাড়ি থেইকা মেহমান আসছে সেই কখন, তুই কই ছিলি?” আমি পানির বোতলে একটা চুমুক দিয়ে মা-কে সহজ গলায় উত্তর দিলাম, “আমি বিয়া-টিয়া করতেছি নাহ”। মা আমার চুল টেনে ধরে বললেন,
“পিটায়া লম্বা করে ফেলবো পুলা!”
প্রচন্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেহমানদের সামনে যেতে হলো। এক মুরুব্বী মুখ থেকে পানের পিক ফেলে উচ্চস্বরে বললেন,
“মাশাল্লাহ! ছেলে তো রাজপুত্রের মতো!”
সাধারণত সব ছেলেপক্ষ অথবা মেয়েপক্ষের মাঝেই এই টাইপ কিছু আলগা মুরুব্বী থাকেন, যারা উচ্চস্বরে কথা বলেন আর বাপ-দাদার আমলের গল্প খুব ভালো বলতে পারেন। আমাকে নাম জিজ্ঞেস করা হলো। কি আজব ব্যাপার! যেন ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা আমি, স্কুলে যেতে গিয়ে হারিয়ে গেছি, তাই এখন নাম জিজ্ঞেস করছে। এগুলো আলগা মুরুব্বীদের অভ্যাস। যেন তাদের আমেরিকা প্রবাসী একমাত্র ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে এসেছে। নামাজ-কালাম পড়ি কি না, কোরান পড়তে পারি কি না, এইসব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। সবাই বলে উঠলেন,
“মাশাল্লাহ!”
আমি বুঝতে পারলাম, আমার ব্যবহারে সবাই খুশি। একজন তো কানাকানি শুরু করে দিল,
“এইরকম আদব-কায়দা ওয়ালা পুলা আমি জীবনেও দেখিনাই!”
মা-কে দেখলাম, দরজার পর্দায় মুখ লাগিয়ে চোখ চক চক করে হাসছে। একচোট হাসাহাসির পর আবার গপ্পো-গুজব শুরু হলো। একজন মুরুব্বী দাড়ি নাড়তে নাড়তে বললেন,
“আহহা! নামটাই তো জানা হইলোনা!”
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
“অসাধারণ ভিক্ষুক”
সবাই চুপ হয়ে গেল। কয়েকজন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। বললেন,
“কি কইলা?”
বললাম,
“অ মানে অসাধারণ, ভি মানে ভিক্ষুক। সংক্ষিপ্ত নাম অভি”।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর একজন বললো,
“তা বাবা কি করো?”
সহজ গলায় বললাম,
“কি করবো আবার? ভিক্ষা করি”।
সবাই আর কালবিলম্ব না করে হনহন করে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। কেও কোনো কথা বললো না। শুধু আলগা মুরুব্বী লোকটা তাঁর মুখ আমার সামনে এনে একবার বললেন,
“বেদ্দপ পুলা কোথাকার!”
সবাই চলে যাবার পর বাবা আমাকে কিছু বললেন না। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। পাশের রুম থেকে মায়ের গুনগুন কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ব্যাপার নাহ। মায়ের অতিরিক্ত কান্নার অভ্যাস আছে। হিন্দি সিরিয়ালের নায়ককে মার খেতে দেখলেও কাঁদে।
পরদিন সন্ধ্যায় মেয়েটার সাথে আবার দেখা হলো। প্রতিদিনই হয়। শুরুতেই একটা গালি খেলাম। মেয়েদের মুখে গালি খেলে শান্তি শান্তি লাগে। আজকে শান্তি শান্তি লাগছে না। ভয় ভয় লাগছে। মেয়েটার পাশে একজন আলগা মুরুব্বী। যিনি কালকে আমাকে “বেদ্দপ পুলা” বলেছিলেন। অর্পাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইনি কে!” অর্পা সহজ গলায় উত্তর দিল, “আমার নানা”। আমি বললাম, “তো তিনি এখানে ক্যান!” অর্পা আগের মতই সহজ গলায় বললো, “আমাদের বিয়ের জন্য সাক্ষী দরকার। ইনি একজন, আরও দুইজন আসবে কিছুক্ষনের মধ্যেই। ইতরামি অনেক করেছো। বিয়ে নিয়ে ধানাই পানাইও অনেক হয়েছে। সারাজীবন খালি প্রেম করেই যাবো নাকি?” কথা শেষ হতে না হতেই একটা মাইক্রোবাস এসে হাজির হলো আমাদের সামনে। আমাকে ধাক্কাধাক্কি করে গাড়িতে উঠানো হলো। আমি শুধু মুখে বললাম, “আরে আরে আরে!” গাড়ি স্টার্ট দিল। আমার মাথাটা সেই আলগা মুরুব্বীর কোলের ওপর। আমার দিকে তাকিয়ে মজা করে হাসছে। তাঁর সফেদ শাদা লম্বা দাড়ি বাতাসে উড়ে আমার চোখে-মুখে লাগছে।
হাত দুইটা বাঁধা না থাকলে টেনে ছিড়ে ফেলা যেত।