জয়িতার কথা:
ঢাকায় জয়িতার ভাল লাগছে না। একটা শহরকে চার মাসে কতটা অপছন্দ করা যায়? যতটা করা যায়, জয়িতা ঢাকার উপর তার চেয়ে এক ডিগ্রি বেশি বিরক্ত। নাহ, শহরের অস্থিরতা, জ্যাম বা নোংরা (আর নোংরামো) নয়, জয়িতার বিরক্তির মূল কারণ তার নতুন চাকরিটা।
জয়িতা যশোরের মেয়ে, খুলনা ভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে অনার্স করেছে। ফাইনাল পরীক্ষার পর অনেকটা খেয়ালের বশেই ঢাকার একটি পত্রিকায় সিভি সাবমিট করেছিল। তাই দৈনিক পূর্বাভাষ যখন তাকে প্রিলিমিনারি ইন্টারভিউর জন্য ডাকলো, জয়িতা প্রথমবারের মত ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করলো। ক্রাইম রিপোর্টার জয়িতা আহমেদ; আহ, বলতেই তো ভালো লাগে! সত্যি সত্যি চাকরিটা হয়ে যাবার পর তার খুশির সীমা থাকবার কথা নয়, কিন্তু পরিস্থিতিটা দাঁড়ালো সম্পূর্ণ বিপরীত। জয়িতাকে ডেস্ক জব দেওয়া হলো। তার কাজ বিভিন্ন বিদেশী ওয়েবসাইট থেকে শোবিজের খবরগুলো বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া। তাই "কারিনার নতুন লেহেঙ্গা" অথবা "বিবারের পুরানো প্রেম" টাইপ নিউজ লিখে তার দিন কাটছে। ঢাকায় জয়িতার একদমই ভাল লাগছে না।
ঢাকায় থাকি :
কারওয়ান বাজার থেকে নাখালপাড়া। বেশি দূর নয়, আবার খুব একটা কাছেও নয়। এই পথটুকু জয়িতা রোজ হেঁটেই আসা-যাওয়া করে। সকালে সবার ব্যস্ত হয়ে যাওয়া আর সন্ধ্যায় তার চেয়েও ব্যস্ত হয়ে ফেরার দৃশ্য দেখতে জয়িতার ভালোই লাগে। কিন্তু বাকি সময়টুকু যেন কাটতেই চায়না। অবশ্য বাসায় থাকলে মিলি খালার সাথে গল্প করা যায়।
মিলি খালা জয়িতার আপন খালা নয়, এমনকি আত্নীয়ও নয়। জয়িতার নানাজান আর মিলি খালার স্বামী দুজনেই পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে চেনা আর আসা-যাওয়া। ইন্টারভিউয়ের সময় জয়িতা দুদিন মিলি খালার বাসায় ছিল। পরে খালা ফোন করে যখন শুনলেন চাকরিটা হয়ে গিয়েছে, নিজে থেকেই বললেন তার সাথে এসে থাকতে। মিলি খালার দুই ছেলে-মেয়ে, দুজনেই বিদেশে থাকে। বছর তিনেক আগে স্বামী মারা যাবার পর থেকে তিনি একলাই থাকেন। সুতরাং জয়িতার না করার কোন কারণ ছিল না।
মিলি খালার ১০৫০ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাটটা নাখালপাড়ায়। দুটো বেডরুম আর একটা ড্রইং-ডাইনিং। বেডরুমের সাথে একটা বারান্দাও আছে। যে বারান্দায় মিলি খালাকে প্রায়ই বসে ছোট একটা উলের সোয়েটার বুনতে দেখা যায়। তার মেয়ে স্বামীর সাথে কানাডায় থাকে আর বড় ছেলেটা অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানেই এক বিদেশিনীকে বিয়ে থা করেছে, একটা ছেলেও হয়েছে সম্প্রতি। সোয়েটারটা সম্ভবত সেই নাতির জন্যই বোনা হচ্ছে।
ইউটার্ন:
বৃহস্পতিবার একটু রাত করেই ফিরছিল জয়িতা। সময় তখন প্রায় নয়টা। বাসায় যাবার পথে একটা বাজার পড়ে। সে বাজারের বাম পাশ দিয়ে একটা গলি চলে গিয়েছে। গলির মুখের কাছে বেশ কিছু মানুষের একটা জটলা। জয়িতার অনুসন্ধিৎসু "ডেস্ক" সাংবাদিক মন ঠেলে তাকে সেই জটলায় নিয়ে গেল। জানা গেল, গলির তিন নম্বর বাসায় নাকি এক লোককে খুন করা হয়েছে। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে, পাঁচ মিনিটের ভেতর চলে আসবে। জয়িতাকে আর পায় কে! খুব গম্ভীর মুখে "দেখি সরুন, আমি পত্রিকার লোক" বলে ভীড় ভেদ করে বিল্ডিংটায় ঢুকে পড়লো।
দোতালায় উঠে রক্তের দাগ দেখেই বুঝে ফেললো কোন ঘরে যেতে হবে। ঘরের মুখেই পড়ে ছিল লাশটা। পুরুষ, বয়স ত্রিশের একটু নীচে। খালি গা, নীচে লুঙ্গি পড়া। লাশের সারা গায়ে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। গাল আর পেটের বাড়তি মাংস মৃতের খাদ্যপ্রীতির কথা জানান দিচ্ছে। রুমটা একদমই ছোট, বড়জোর বারো ফিট বাই আঠারো ফিট হবে। তবে ঘরটা বেশ গোছানো। রুমের এক কোনায় একটা সিঙ্গেল খাট আছে আর অপর পাশে একটা আলনায় বেশ কিছু ফর্মাল শার্ট, প্যান্ট, টি-শার্ট, লুঙ্গি ঝোলানো। আলনার নীচে একজোড়া ফর্মাল শু আর স্নিকার রাখা। খাটের পাশে একটা টেবিল। টেবিলে একটা ল্যাম্প, একটা ল্যাপটপ, দুটো পুরানো স্পিকার, দুটো চায়ের দাগ লাগা চামচ, একটা পিরিচ (পিরিচে একটা ভেজা টি ব্যাগ), একটা কফি মগ (তাতে চায়ের তলানি পড়ে আছে), একটা লেখার প্যাড আর কলম, মোবাইলের চার্জার, এক প্যাকেট সিগারেট, একটা লাইটার, একটা সিগারেট ভরা অ্যাশট্রে, একটা বড় দাঁতের চিরুনি, তিনটে বডি স্প্রে একটা ঘড়ি আর অনেক বই রাখা। বইগুলো বিভিন্ন বিষয়ের। সেখানে শেক্সপীয়ার থেকে শিবরাম, মীর মশাররফ থেকে আরজ আলী সবার বই আছে। জয়িতা বিসিএসের দুটো গাইড বইও দেখলো। আর সেই টেবিল আর খাটের পাশে অনেকটা ৪৫ ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি করে লাশটা পড়ে আছে। হঠাৎ করে দেখলে যেন মনে হবে যেন ঘুমিয়ে আছে লোকটা। নষ্ট করার মত সময় হাতে নেই। জয়িতা ঝটপট মোবাইলে অনেকগুলো ছবি তুলে ফেললো। কি মনে করে লাগোয়া বাথরুম আর রান্নাঘরের সবকিছুরও ছবি তুললো। হঠাৎ করেই যেন চারপাশটা অনেক নীরব লাগলো জয়িতার কাছে। পরক্ষণেই বুঝতে পারলো কি হয়েছে। এতক্ষণ বাইরের সবার কথা শোনা যাচ্ছিল। জনতার সেই পিনপিন শব্দটা আর নেই। সম্ভবত পুলিশ এসে পড়েছে। জয়িতা নীচে নেমে এলো।
বাড়ির মালিক (দোতালার দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে তিনি থাকেন) পুলিশের ওসি'র সাথে কথা বলছেন। বাড়িওয়ালা হাজি আসমত আলী কথা বলতে ভালোবাসেন। তার দেওয়া অনেক তথ্যর মাঝে প্রয়োজনীয় যে কথাগুলো জানা গেল : যে ছেলেটা মারা গিয়েছে তার নাম রুলিন রহমান, একাই থাকতো। বাড়ি চাঁদপুরে, ঢাকায় বনানীর একটা গার্মেন্টসে চাকরি করতো। আসমত আলী মাগরিব আর এশার নামাজ একসাথে পড়ে বাসায় ফিরছিলেন। তখন আধখোলা দরজা আর রক্তের দাগ দেখে রুলিনের রুমের ভেতরে ঢুকেন। পুলিশকে খবরটা তিনিই দিয়েছেন। রুলিন দুই বছর ধরে এই বাসায় আছে। খুব চুপচাপ ছেলে। বন্ধু-বান্ধব আসলেও তারা বেশিক্ষণ থাকতো না। এমনিতে ভাড়া নিয়ে কখনো সমস্যা হয়নি। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহের মাঝে রুলিন ভাড়া দিয়ে দিত (শুধু একবার রোজার ঈদের পরে ভাড়া দিতে দেরী করেছিল)। সবমিলায় রুলিন অনেক "কিলিয়ার" একটা পোলা।
ইউটার্ন টু:
ব্লগার "লীন" মারা গিয়েছে দুই সপ্তাহ হলো। পুলিশ আর কাউকে ছবি তুলতে দেওয়া তো দূরে থাক, ভেতরেও ঢুকতে দেয়নি। আমজনতা খুন-খারাবি থেকে দূরে থাকলেও, এই জাতীয় নিউজ খুব "খায়"। তাই জয়িতার তোলা ছবিগুলো পত্রিকায় ছাপা হওয়ার সাথে সাথেই হটকেকে পরিণত হল। ফেসবুকে শেয়ার্ড হলো অসংখ্যবার। ফেসবুক ফলোয়ারের সংখ্যাও রাতারাতি অযুতে গিয়ে ঠেকলো। জয়িতার ক্রাইম রিপোর্টার হবার স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হয়েছে। সেইরাতেই একটা ফিচার লিখে ছবিগুলো অ্যাটাচ করে সম্পাদক সৌমিত্রদাকে মেইল করেছিল জয়িতা। পাঁচ মিনিট পেরোবার আগেই সৌমিত্রদার ফোন এলো : "নিউজটা তুমিই কাভার করো। ক্রাইমের আবীর তোমাকে অ্যাসিস্ট করবে। আর হ্যাঁ, গুড রাইট-আপ, জয়ী"। জয়িতা আর কিছু বলার আগেই ওপাশের লাইন কেটে গেল। সেই থেকে এই ঘটনাটা নিয়ে জয়িতা প্রতিদিন লিখছে। তাকে এই কাজে হেল্প করছে সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার আবীর চৌধুরী। এই প্রথম জয়িতার নাম সহ প্রথম পাতায় নিউজ যাচ্ছে, নিয়মিত!
শুক্রবার সকাল। জয়িতা বাসায় বসে ল্যাপটপে রুলিন রহমান হত্যাকান্ডের ফলো-আপ লিখছে। মিলি খালা রান্নাঘরে একটা বই পড়ছেন আর রান্না করছেন। সেই সাথে মাঝে মাঝে গুনগুন করে গানও গাইছেন। জয়িতা কিছুটা অবাক হলো। মিলি খালার বয়স পঞ্চাশের বেশি। এই বয়েসি কেউ সাধারণত বই দেখে রান্না করে না।
-"এই ছুটির দিনেও বসে কি লিখছিস রে, জয়ী?" রান্নাঘর থেকে বলে উঠলেন মিলি খালা।
-ক্রাইম রিপোর্টারের আবার ছুটি কিসের, খালা? যে সময় ক্রাইম হবে তখনি আমার ডাক পড়বে। সেদিন বাসার কাছে একটা খুন হলো না, ওটা নিয়ে লিখছি।
-"ও আচ্ছা।" বলে একটু থেমে মিলি খালা আবার বললেন "পুলিশ কাউকে ধরেছে নাকি রে? ইশ্, এতোটুকুন একটা ছেলেকে কে যে মেরে রেখে গেল!"
-হু, পুলিশ জামান হায়দার সামিরী নামে একটা ছেলেকে ধরেছে। রুলিনকে অনেকদিন থেকেই ফেসবুকে, টেক্সট করে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। রুলিন বেশ ভয়ও পেয়েছিল, কাজ না থাকলে বাইরে বের হতো না। সামিরীর বাসা থেকে পুলিশ ল্যাপটপ আর কিছু সিম পেয়েছে। রুলিনকে হুমকি দেওয়া আইডি আর সিম সবই সামিরীর। এছাড়া রুলিন খুন হবার আগে তার বাসার কাছে সামিরীকে নাকি বেশ কয়েকবার ঘোরাঘুরি করতেও দেখা গিয়েছে।
-"আর ওগুলো বুঝি রুলিন ছেলেটার বাসার ছবি?" জয়িতা রুলিনের বাসায় তোলা অনেকগুলো ছবি প্রিন্ট করেছে। খালা সেই ছবিগুলো দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলেন। জয়িতার মামা ইউ.এস.এ থেকে জয়িতার জন্য বেশ দামী একটা ফোন পাঠিয়েছেন। সেই মোবাইলে বেশ ভালো ছবি উঠেছে। "ওর বাসার আর ছবি আছে?"
-হু আছে। বলে জয়িতা মোবাইলটা খালার দিকে বাড়িয়ে দিল। খালা নিবিষ্ট মনে ছবিগুলো দেখতে থাকলেন। জয়িতা রিপোর্ট লেখায় এত মনযোগী ছিল যে, খালার মতো পুরদস্তুর গৃহিণীর রুলিন রহমানের বাসার ছবি দেখতে চাওয়ার মাঝে যে অস্বাভাবিকতাটুকু আছে, সেটা তার নজরে পড়লো হলো না।
রিপোর্ট লেখা শেষ। গ্রেপ্তার হওয়া সামিরীর ছবি আর তার নীচে ডিবি পুলিশকে প্রশংসা করে দুটো লাইন লিখে, একটা আবেগী ফিনিশিং টানছিল জয়িতা। খালার একটা কথা শুনে তার আঙুল থেমে গেল।
-পুলিশ ভুল লোককে ধরেছে রে, জয়ী।
-মানে?!?
-এই ছেলে খুন করেনি।
-এ কথা কেন মনে হলো তোমার?
-দুটো চামচ দেখে।
-চামচে কি হয়েছে?
-ছবিতে দেখ কফি মগ একটা কিন্তু দুটো চামচ। দুটো চামচেই আবার চা শুকিয়ে যাবার দাগ রয়েছে।
-তাতে কি বোঝা গেল?
-তুই-ই না বললি রুলিন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় কি কেউ সামিরীর মতো অজানা একজনকে ঘরে এনে চা করে খাওয়াবে।
-"দুটো চামচে চা লেগে থাকার একশো একটা কারণ থাকতে পারে।" জয়িতার ভঙ্গিটা দেখে মনে হলো, মিলি খালা বুঝি সামিরী'র হয়ে ওকালতি করছেন।
-সেটা পারে। এছাড়া আরেকটা ব্যাপার আছে?
-কি?
-বলছি...এহহে কৈ মাছটা মনে হয় এসেছে। তুই একটু বস।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:০২