হাসিনার শাসনামলে গত সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে সীমাহীন লুটপাট হয়েছে। লুটপাটের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে এ খাত। এ খাত ধ্বংসের কারিগর ছিল সাবেক তিন গভর্নর- আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। এরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এদের ধরার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
শেখ হাসিনার পতনের পর দেশ থেকে চলে যায় ড. আতিউর রহমান। বর্তমানে আতিউর দেশের বাইরে আছে। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তার পাসপোর্ট ব্লক করেছে সরকার। ফজলে কবির দেশেই রয়েছে, তবে শেখ হাসিনার পতনের পর তাকে জনসম্মুখে দেখা যায়নি। আর ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে যায় আব্দুর রউফ তালুকদার।
হলমার্কের জালিয়াতি দিয়ে আতিউরের শুরু : ২০০৯ সালের ১ মে গভর্নর পদে নিয়োগ পায় আতিউর রহমান। তার মেয়াদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে দুর্বলতার সুযোগে সোনালী ব্যাংকে হলমার্কের জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। প্রায় দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বের করে নেওয়া হয়। এর আগে এত বড় ঋণ জালিয়াতির নজির ছিল না। তার সময়ই আবার বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। এ ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে দুই হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়।
২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের দরবেশ খ্যাত বেসরকারি উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন সুবিধা পায় বেক্সিমকো, এমআর গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, কেয়া গ্রুপ, যমুনা, থার্মেক্স, শিকদার, আবদুল মোনেম ও এননটেক্স গ্রুপ। এসব ঋণ এখন খেলাপির খাতায়।
আতিউরের সময় সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। রিজার্ভ চুরির ধামাচাপা দেওয়ার ‘মাস্টারমাইন্ড’ছিলেন আতিউর। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুরির ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে। সেই রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়।
এস আলমের হাতে ব্যাংক তুলে দিয়ে কবিরের শুরু : ২০১৬ সালে ২০ মার্চ সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির গভর্নর পদে নিয়োগ পান। ২০১৭ সালের শুরুতে বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক ও পরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) দখল করে এস আলম গ্রুপ। গভীর রাতে ও বাসায় বসে এই দখল অনুমোদন দেন ফজলে কবির। গভর্নরের অফিস ও বাসভবনে এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তাদের অবাধ যাতায়াত শুরু হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও কোনো বিভাগে কারা দায়িত্বে থাকবেন, তাতেও হস্তক্ষেপ শুরু করে গ্রুপটি। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও বিভিন্ন পদের জন্য এস আলম গ্রুপ নির্ভর হয়ে পড়ে।
খেলাপিদের ছাড় ও এস আলমের ব্যাংকে সুবিধা দিয়ে তালুকদারের শুরু : ২০২২ সালের জুলাইয়ে আরেক সাবেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর পদে দায়িত্ব নেন। তিনি এসেই এস আলমের ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে দেওয়া শুরু করে। এসব টাকাও ঋণের নামে তুলে নেয় এস আলম গ্রুপ। আবার রিজার্ভ থেকেও ডলার দেওয়া হয় তৎকালীন সরকারের কাছের ব্যবসায়ীদের। তার সময়ে আর্থিক তথ্য প্রকাশ সীমিত করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের পতন ঘটলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
ব্যাংক খাত ধ্বংসে তিন গভর্নর ছাড়াও ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউ ও অন্যান্য শীর্ষপদে ছিল তাদের অনেকেই অনিয়মে সহযোগিতা করার পাশাপাশি সুবিধাভোগী ছিল। এর মধ্যে রয়েছে সাবেক ডিজি সিতাংশু কুমার (এস কে) সুরকে চৌধুরী ও বিএফআইইউ সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে অধিকাংশ ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর মধ্যে সাবেক ডিজি এস এম মনিরুজ্জামান, তিনি উদ্যোগ নিয়ে ব্যাংকগুলোর পরিদর্শন বন্ধ করে দেন। বিএফআইইউ সাবেক হেড রাজী হাসান, যার সময়ে অর্থপাচার হলেও প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
এ ছাড়া ডিজি কাজী ছাইদুর রহমান ও আবু ফরাহ মো. নাছেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ আছে ডলার বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কাজী ছাইদুর রহমান ও ঋণ নীতিমালা শিথিলের মাধ্যমে পুরো ব্যাংক খাতকে বিপর্যস্ত করে ফেলেন আবু ফরাহ মোহাম্মদ নাছের।