জ্বি ভাই, একেবারে হোচট খাওয়ার দশা। কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ দেখে জনৈক বড় ভাই, যিনি লেখাপড়া করেছেন কম, কিন্তু প্রকৃতী থেকে শিখেছেন বিস্তর, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ফটোগ্রাফার নাকি ক্যামেরাগ্রাফার? হা করে তাকিয়ে রইলাম। বলে কি? তিনি খোলাসা করে বললেন, আসলেই ফটো তোলো নাকি ক্যামেরা দেখাইয়া বেড়াও। যদি দ্বিতীয়টা হও তাইলে তুমি ক্যামেরাগ্রাফার।
চিন্তা করে দেখলাম, তাই তো। ক্যামেরা হাতেই তো নানা পদের লোক দেখা যায় আমাদের শহরে। যে কয়টা মনে হলো, লিখে ফেললাম। আসুন আজ না হয় হালকা চালে বিবেচনা করি আমরা যারা ছবি তুলি তারা কে কোন শ্রেণীর ফটোগ্রাফার। সম্ভব হলে আপনিও যোগ করুন না আরো দুই এক আইটেম...
ক্যামেরাগ্রাফার
এদের কাছে ফটো খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতোটা গুরুত্বপূর্ণ তাদের ক্যামেরাটি। ফলে এ শ্রেণীকে ফটোগ্রাফার বলাটা যুৎসই হয় না। তবে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের ভাবভঙ্গি এরা অনুকরণ করতে ব্যাপক পছন্দ করে। এদের শুরু ফটোগ্রাফির বেসিক কোর্স দিয়ে হয় বটে কিন্তু তা কোথাও গিয়ে শেষ হয় না। কোর্সের কারণে বিখ্যাত কয়েকজন বিদেশি ফটোগ্রাফারের নাম এদের ঠোঁটের ডগায় থাকে এবং চান্স পেলেই (আজিজ, আঁলিয়স, গ্যাটে বা ম্যংগোর) আড্ডায় নামগুলো ঝেড়ে নিজেকে আঁতেল প্রমাণের চেষ্টা করে। অনেক ক্ষেত্রে এরা আত্মবিশ্বাসের চরমে গিয়ে নিজের তোলা বিকৃত ফটোকে পোস্ট মডার্ন আর্ট বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। সেই ছবি দিয়ে পয়লা চান্সেই এরা ওয়েবসাইট খুলে বসে। তরুণী ফটোগ্রাফারদের সবচেয়ে বড় অংশ এ শ্রেণীভুক্ত এবং এরা সিএনএন দেখে নারী ফটোসাংবাদিক হওয়ার স্বপ্নে ডুব দেয়, আর তরুণদের বেলায় তরুণী সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ এদের একমাত্র থ্রিল। কামেরার ব্র্যান্ড যাই হোক না কেন, ক্যামেরার ব্যাগটি এরা পরম যত্নে আগলে রাখে। এ শ্রেণীভুক্ত পুরুষ ফটোগ্রাফারদের কারো কারো চেহারায় দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এদের দেখা বেশি মেলে এলিফেন্ট রোড বাটা মোর, রাসেল স্কোয়ার ও ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে।
অ্যামেচার
যাদের মোট কামাইয়ের অর্ধেকের কম আসে ফটোগ্রাফি থেকে তাদের অ্যামেচার বলা যায়। এদের সাধারণত ভিন্ন একটি পেশা থাকে, পাশাপাশি এরা ফটোগ্রাফি থেকে পকেটমানি কামাই করে। প্রথমে শখ করে কেনা হয়েছিল বলেই এদের ক্যামেরা সাধারণত নিকন না হয়ে একটু দামি ক্যানন হয়ে থাকে। এ শ্রেণীটির সম্ভাবনা থাকে অনেক এবং প্রায় সব খ্যাতিমান ফটোগ্রাফারই শুরুতে এ শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। অ্যামেচার হিসাবে কাজ করতে গিয়ে ক্রমশ আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়ে গেলেই রূপান্তরের ঘটনাটি ঘটে। একজন সফল ফটোগ্রাফারকে যদি প্রজাপতির সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে এরা হচ্ছে দিকভ্রান্ত মথ।
পয়সাওয়ালা অ্যামেচার
ফটোগ্রাফি থেকে এরা কোনো পয়সা কামাই করে না, বরং নিজের মূল পেশা থেকে এরা অঢেল অর্থের মালিক হয়। এরা সাধারণত দামি মডেলের ক্যামেরায় জঘন্য কোয়ালিটির ফটো তোলে। ছুটির দিনে এরা পাজেরো/প্রাডো নিয়ে বের হয় এবং নিজের তোলা ভিক্ষুকের ছবিকে এরা শিল্পোত্তীর্ণ মনে করে। ডিজিটাল ক্যামেরা যুগের আগে এরা সাধারণত নিকন এফ ফাইভ, লাইকা, কনট্যাক্স, হ্যাসলব্লাড দিয়ে ফটো তুলতো। ইদানীং এদের হতে দেখা যায় প্রায় ৫ লাখ টাকা দামি ক্যানন ওয়ান ডিএস মার্ক থ্রি বা প্রায় চার লাখ টাকা দামি নিকন ডি থ্রি মডেলের ক্যামেরা। এরা হচ্ছে সেই স্টুপিড যারা ডিজিটাল এসএলআর বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মেলা টাকা খরচ করে ফটোসাংবাদিকদের জন্য তৈরি ২·৭ মেগাপপিক্সেলের ক্যামেরা বিদেশ থেকে কিনে এনেছিল, আর দরকার হোক বা না হোক প্রথম চান্সেই কিনেছিল লাখ টাকা দামি সিটিসেল মোবাইল। এ শ্রেণীতে সাধারণত কোনো নারী ফটোগ্রাফার দেখা যায় না এবং এদের বয়স হয় ফোর্টি প্লাস।
খদ্দের ধরা ফটোগ্রাফার
এরা কোনো রকম শিল্পের ধার ধারে না। এদের কাছে কাস্টমার হইল গিয়া কাস্টমার। ফলে ক্লায়েন্ট যা চায় এরা তাই তোলে। এদের তোলা ফটোর রেট হলো- যার কাছ থেকে যতো পাওয়া যায়। এদের চেষ্টা থাকে একটি স্টুডিওর মালিক হওয়ার এবং প্রায়ই এরা সম্প্রতি বিক্রি করা ফটোর দাম জাহির করে নিজের দাম বাড়াতে চায়। এরা নিজ শ্রেণীর ফটোগ্রাফারদের সবচেয়ে বেশি হিংসা করে। রেট কমিয়ে দিচ্ছে বলে এরা অন্য ফটোগ্রাফারদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে। পরে আবার নিজেই ক্লায়েন্টকে গিয়ে বলে, কম রেটে করে দেবো, কাজটা আমাকে দিয়েন। ফটোগ্রাফারদের মধ্যে এই শ্রেণীটিই ক্লায়েন্টদের সবচেয়ে বেকুব ভাবে এবং পরিহাস হচ্ছে ক্লায়েন্টরাও তাদের একই রকম মনে করে। এ শ্রেণীতে কোনো নারী ফটোগ্রাফার দেখা যায় না।
স্ন্যাপশুটার
ফ্যামিলির সেজো খালু বা মেজো দুলাভাই এ শ্রেণীতে
অনায়াসে পড়তে পারেন। আপাদমস্তক এরা সংসারী মানুষ, কেবল অমুকের বিয়ে তমুকের জন্মদিনে এরা আলমারি থেকে ক্যামেরাটি বের করেন। সাধারণত নিজের বৌ-বাচ্চা ছাড়া আর কারো ছবি তোলার ব্যাপারে এরা উদাসীন, তবে সামাজিক অনুষ্ঠানে বিশেষ খ্যাতিমান লোকজন এদের হাত থেকে রেহাই পেতে গলদঘর্ম হয়ে ওঠেন। এদের সৃজনশীলতার চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে কক্সবাজারে হাতের তালুতে অস্তগামী সূর্যের ফটো তুলতে পারা। এ ছাড়া এদের তোলা আর সব ছবিতেই লোকজন অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এরা সাধারণত পয়েন্ট অ্যান্ড শুট অটো ক্যামেরায় ফটো তোলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মডেলটি হয় ইয়াশিকা এমএফটু।
মোবাইলোগ্রাফার
ক্যামেরার বদলে এরা ক্যামেরা মোবাইল নিয়ে ঘোরাঘুরি বিশেষ পছন্দ করে। নিউ ইয়র্কের স্ট্যাচু অফ লিবার্টির হাতে মশাল যেমন, এদের হাতে তেমনি ক্যামেরা মোবাইল- এক হাতে উঁচু করে ধরে রাখে। বিয়ে-জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এদের জ্বালায় কন্টাক্ট ফটোগ্রাফার বা ভিডিওগ্রাফারের কাজ চাঙ্গে ওঠে। তরুণী সম্প্রদায়ের কাছে এরা মূর্তিমান আতঙ্কবিশেষ। এরা ফটো প্রিন্ট না করে ইন্টারনেটে চালাচালি করে। এদের বহুল ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে মেগাপিক্সেল, রিংটোন, ইনফ্রা রেড, ব্লু-টুথ, এইট জিবি ইত্যাদি। এরা সপ্তাহে অন্তত একবার বসুন্ধরা সিটি, ইষ্টার্ণ প্লাজার পাচ তলা বা অন্যান্য মোবাইল মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে। এদের অনেকের মোবাইলটি শেষ পর্যন্ত যায় ছিনতাইকারীর হাতে।
প্রফেশনাল
কামাই রোজগারের পুরোটাই এদের আসে ফটোগ্রাফি থেকে। ফটোগ্রাফি বিষয়ে এরা কম কথার মানুষ। আর্ট ফটোগ্রাফি এদের ধাতে সয় না। যে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের বাজার ভালো, আপনি তাকে সাধারণত ল্যান্ডস্কেপ ফটো তুলতে দেখবেন না। এদের কাছে সাকসেসফুল ফটোগ্রাফ মানে হচ্ছে যে ফটো বিক্রি করা যায় আর সবচেয়ে বড় কলেমা হচ্ছে কপিরাইট ল' (বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করে দেখুন ড. শহিদুল আলমকে)। এদের অনেকেই আর্টিস্টিক ফটো তুলতে পারে, তবে তা সাধারণত অবসরে আপন মনে ফটো তুললে তবেই। ফটোগ্রাফির আয় থেকে চলতে হয় বলে এরা ইকুইপমেন্টের পেছনে সিরিয়াস অ্যামেচারদের মতো খরচ করে না। সাধারণত এরা আগে নিকন ফিল্ম এসএলআর ব্যবহার করতো, এখন ব্যবহার করে ক্যানন ডিজিটাল এসএলআর। ক্যামেরা নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এরা সার্ভিসিং-এর চিন্তা করে না।
আর্টিস্ট
এরা বনেদি শ্রেণীর ফটোগ্রাফার। এদের যাবতীয় চিন্তা-চেতনা ফটোর শিল্পরূপ নিয়ে। এরা ছবি বিক্রি করেন, তবে তা শিল্প হিসেবে। একজন ফটো আর্টিস্ট তার কল্পনাকে প্রকাশ করতে পারেন ফটোর ভাষায়। এরা নিজেদের কাজে মাস্টার পর্যায়ের। নিজের ক্যামেরার সকল বিষয় এদের একেবারে নখের ডগায় থাকে। নানা বিষয় নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট এদের মজ্জাগত। সাধারণ লোকজন এদের বেশ শ্রদ্ধাভরেই দেখে, কেবল হোচট খায় যখন এক্সপেরিমেন্টের বিষয় হিসেবে চলে আসে জন্মদিনের পোশাকে নারী। শিল্পজনিত প্রণোদনার উছিলায় শুষ্ক, বায়বীয় ও তরল পদার্থে এদের ব্যাপক আগ্রহ। এদের কারো কারো বিরুদ্ধে পটেটো ডিজিজের অভিযোগ রয়েছে।
এ লেখার শুরুতে যেমনটা বলেছিলাম, বলুন তো আপনি কোন শ্রেণীর ফটোগ্রাফার?

আলোচিত ব্লগ
“বিবেকহীনদের জন্য কিছু প্রশ্ন”
ফেসবুকে দেখি কিছু মানুষ “আপা আপা” বলে চাটুকারিতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। মনে হয় তাদের আত্মা পর্যন্ত বেরিয়ে যাবে, তবু তারা অন্ধভক্তি ছাড়বে না! প্রশ্ন হলো—আপনারা কি সত্যিই অন্ধ, নাকি... ...বাকিটুকু পড়ুন
সারজিস আলম : শূন্য থেকে কোটিপতি বনে যাওয়া একজন স্বপ্নবাজ তরুণ
জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের তরুণদের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশের অগণিত তরুণ তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নামলে সৃষ্টি হয় নতুন উপাখ্যান। বিগত সরকারের আমলের ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির বলি... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ: সেনাবাহিনী ও এনসিপির পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের প্রেক্ষাপট
ড. ইউনুসের বক্তব্যের ব্যাবচ্ছেদ
আজ সন্ধ্যায় অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ শুনলাম। প্রায় ৩৫ মিনিটের এই বক্তৃতা অনেকের কাছে হয়তো ঘ্যানঘ্যানানি আর প্যানপ্যানানির মতো মনে হতে পারে, কিন্তু আমি একজন রাজনৈতিক... ...বাকিটুকু পড়ুন
আগে বিচার , সংস্কার তারপরেই নির্বাচন
জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন এক ঝাক তরুনদের রক্তের উপড় দাঁড়িয়ে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এ জ্বালাময়ী কর্মসুচী দিচ্ছিল , তখন বিএনপির... ...বাকিটুকু পড়ুন