প্রথম পর্ব
সিংগাপুর ডায়েরি -২
চ্যাংগি এয়ারপোর্ট, সিংগাপুর। পৃথিবীর অন্যতম বড় এবং ব্যাস্ত এয়ারপোর্ট। প্রতি ৫ মিনিট অন্তর একটি করে ফ্লাইট ল্যান্ড করছে এখানে। আমাদের ফ্লাইট ল্যান্ড করল লোকাল টাইম ৬.৫০ মিনিটে। সিংগাপুরের সাথে আমাদের সময় ব্যাবধান ২ ঘন্টা। ঘড়ির সময় ঠিক করে নিলাম, নাহলে সমস্যায় পরতে হবে। বোর্ডিং দিয়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে প্রবেশ করলাম। বিশাল এয়ারপোর্ট। একটা আধুনিক দেশের এয়ারপোর্ট যেমন হওয়া উচিত, তার প্রায় সব কিছুই আছে এখানে। শুনেছি সুইমিং পুল ও আছে এখানে। নির্দিষ্ট ফি দিয়ে সুইম করা যায়। প্রায় ১৫ মিনিট মত লাগলো ইমিগ্রেশনে পৌছাতে। আমি জেনে এসেছিলাম যে চ্যাংগিতে ইমিগ্রেশনে অনেক লম্বা লাইন থাকে। তার অবশ্য কোনো ব্যাত্যয় দেখলাম না, বিশাল লাইনে পড়ে গেলাম।
আমি ভেবেছিলাম আমাকে হয়তো অনেক প্রশ্ন করবে কারন আমি একা এসেছি। কিন্তু আমাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করলো না, হাসি দিয়ে ফিংগারফ্রিন্ট নিয়ে সিল দিয়ে দিল। আমার আগে অবশ্য অনেক বাংলাদেশী কে ইমিগ্রেশন অফিসে পাঠিয়ে দিল দেখলাম। অবশ্য তারা সম্ভবত শ্রমিক ভাইরা কারন তাদের বেশভূষা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।
ইমিগ্রেশন শেষ করে বের হয়ে এলাম লাগেজ নিতে। যাওয়ার সাথে সাথেই লাগেজ পেয়ে গেলাম। এখন মেট্রোস্টেশন খুজতে হবে। সিংগাপুর হল মেট্রোরেলের শহর। প্রায় সব যায়গায় মেট্রোস্টেশন রয়েছে সিংগাপুরে। এয়ারপোর্টে ও রয়েছে মেট্রো। আমি সিংগাপুর আসার আগে যে তথ্য গুলো নিয়েছি তার মধ্যে অন্যতম ট্যাক্সি না নেয়া। ট্যাক্সি নিলে সিংগাপুর আর ঘোরা হবেনা, তাই এম আর টি ই ভরসা। তবে আমি নেমেছি টার্মিনাল ১ এ। মেট্রোস্টেশন রয়েছে টার্মিনাল ২ এ। টার্মিনাল ২ এ যাওয়ার জন্য আবার রয়েছে স্কাইট্রেনের ব্যাবস্থা যা সম্পূর্ন ফ্রি। কি দারুন ব্যাবস্থা, একেই বলে আধুনিক এয়ারপোর্ট। উপরের সাইনবোর্ড গুলো দেখে এগোতে লাগলাম। পৌছে গেলাম স্কাইট্রেনে। ২ মিনিট লাগলো টার্মিনাল ২ এ আসতে। এখানেও সাইনবোর্ড দেখে পৌছে গেলাম মেট্রোস্টেশনে।
আমাকে যেতে হবে লিটল ইন্ডিয়ার ফেরার পার্ক স্টেশনে। আমি এম আর টি ম্যাপ ডাউনলোড করে এনেছি মোবাইলে। এই ম্যাপ হাতে থাকলে সিংগাপুরের সব যায়গা সহজেই যাওয়া যাবে। এখন তো টিকেট কাটতে হবে। তবে বার বার টিকেট কাটার থেকে একটা কার্ড নিয়ে নিলে সেটা ব্যাবহার করেই সব যায়গায় যাওয়া যাবে। আমিও তাই স্টেশনে গিয়ে টিকেট বুথ থেকে নিয়ে নিলাম ইজি লিংক কার্ড। এটা দিয়ে সিংগাপুরের সব সাধারন বাস এবং মেট্রোরেলে চড়া যাবে। খরচ পড়ল ১২ সিং ডলার। ৭ ডলার ব্যালেন্স থাকবে আর ৫ ডলার কার্ডের দাম যা অফেরযোগ্য। ব্যালেন্স ফুরিয়ে গেলে রিচার্জ ও করা যাবে। ভালই তো
এমআর টি ম্যাপ, সিঙ্গাপুর
ফেরার পার্ক স্টেশন
উঠে পড়লাম সিংগাপুরের মেট্রো ট্রেনে। আমি পরের স্টেশন এক্সপোতে নেমে গেলাম ডাউন্টাউন লাইন ধরার জন্য। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি লিটল ইন্ডিয়া যাওয়া যায় না। ২ বার ট্রেন চেঞ্জ করতে হয়। ডাউন্টাউন লাইন (ব্লু লাইন) এ ওঠার পর ট্রেন চলল গুলির বেগে। সিংগাপুরের মেট্রোরেল দেখে কেউ বলবে না যে এটা এশিয়ান কোনো দেশের মেট্রোরেল। এখানে প্রতিটি অপরাধের জন্য ফাইনের পরিমান উল্লেখ করা আছে। যেমন ট্রেনে খাবার খেলে ৫০০ ডলার ফাইন। বাপরে । তবে একটা জিনিস আমার খুব ভাল লেগেছে, বয়সে প্রবীন কেও দেখলেই নবিন একজন উঠে দারাচ্ছে এবং প্রবীনকে বসার সুযোগ করে দিচ্ছে। যেনো তারা মুখিয়েই আছে প্রবীন কেও আসলে উঠে দাড়ানোর জন্য। শুধু তাই নয়, ছোট বাচ্চা সহ মহিলা, পঙ্গু কেউ এলেও একই আচার পালন করছে তারা। রেলের ভেতরেও লেখা আছে ব্যাপারটা যে যার সিট টা দরকার বেশি, তাকে আপনার সিট অফার করুন। ব্যাপারটা সুন্দর। তারা বাধ্যও করছেনা, কিন্তু দারুন ভাবে অনুরোধ করছে।
ম্যাপ অনুযায়ী আমাকে আরেকবার ট্রেন পরিবর্তন করতে হবে। তাই আমি চায়নাটাউন নেমে গেলাম। এটা একটা ইন্টারচেঞ্জ স্টেশন। এখান থেকে নর্থ ইস্ট লাইন ধরে সরাসরি আমার গন্তব্য ফেরার পার্ক চলে এলাম। স্টেশনের সাইনবোর্ড এর দিক নির্দেশক দেখে যেদিকে মুস্তফা সেন্টার সেদিক দিয়ে বের হলাম।
এখানে প্রতিটা স্টেশনের অনেকগুল গেট রয়েছে। যেদিক যাওয়া দরকার, সেদিক দিয়ে বের হওয়া যায়। বের হয়ে এখন মুস্তফা সেন্টার খুজতে হবে। আমার হোটেল টা তার সামনেই। একজন কে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাটা হাসি মুখে উত্তর দিল যে সে চায়না থেকে এসেছে, সে বলতে পারছে না। এদিকে সিম কেনা হয়নি বিধায় ইন্টারনেট এ গুগল ম্যাপ্স ও দেখতে পারছি না। হাটা ধরলাম। রাস্তা পার হয়েই সিটি স্কয়ার মল থেকে এগিয়ে গিয়েই পেলাম মুস্তফা সেন্টার। যাক, দেখা পাওয়া গেছে। রাস্তা পার হতে গিয়ে হঠাত করে থেমে গেলাম। ফাকা রাস্তা, সবাই দাঁড়িয়ে আছে কেন? ইতি উতি তাকালাম ব্যাপার কি? ব্যাপারটা হল, সিগ্ন্যাল না পড়লে রাস্তা পার হওয়া যাবেনা। পথচারি সিগ্ন্যাল পড়ল, তার পর সবাই রাস্তা পার হল, সাথে আমিও। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমি তো বাংলাদেশে নেই ।
রাস্তা পার হওয়ার সিগ্ন্যাল এর অপেক্ষায়
মুস্তফা সেন্টারের সামনে এসে একটা সীমের দোকানে বাংলায় লেখা দেখে থামলাম থামলাম। চারিদিকে তাকাই শুধু বাংলায় লেখা। ব্যাপার কি? আসলে এখানে প্রায় বেশিরভাগ দোকানপাট বাংলাদেশী, ভারতীয় দের। আশেপাশে সবাই বাংলায় কথা বলছে তাদের পরিবারের সাথে দেশে। মনটা ভাল হয়ে গেল। বিদেশ বিভূইয়ে এসে নিজের দেশের মানুষ পেলে কার না ভাল লাগে। সীমের দোকানিও বাংলাদেশী। সীম চাইলাম একটা। দোকানী ভাই সিংটেল এর একটা সীম দিল, দাম পড়ল ১৫ সিং ডলার। ১৫ ডলার টক টাইম আর ৩ জিবি ডাটা। আমার ৩ রাতের জন্য যথেষ্ট। দোকানী ভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে চললাম হোটেলের দিকে। খুজে পেলাম আমার হোটেল Marrison @ Desker। ভেতরে ঢুকে Agoda এর বুকিং পেপার দেখালাম। রিসেপশনে বসা ব্যাক্তি আমার রুম বুঝিয়ে দিল, সাথে হাসি মুখে কিছু উপদেশ যেন ধুমপান না করি। এটা নন স্মোকিং হোটেল। ভাল, আমি তো ধুমপায়ী না। ও আচ্ছা, ধুমপানের জরিমানাটা কিন্তু আবার ২০০ ডলার রুমে চলে গেলাম। ছোট রুম, কিন্তু পরিষ্কার ও গোছানো। ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নেয়া দরকার। ধকল গেছে ভাল।
আমার হোটেলে পৌছাতে লেগেছে প্রায় দেড় ঘন্টা। তাই রাত হয়ে গেছে। সিঙ্গাপুর হল রাতের শহর। রাত যত, সিঙ্গাপুরের সৌন্দর্য তত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আমার আপাতত পেটের দিকে নজর দিতে হবে। খুদা লেগেছে, সেই প্লেনে খেয়েছি আর খাওয়া হয়নি। বের হলাম। মুস্তফা সেন্টার এর পাশে লেম্বু রোডে ঢুকলাম। এই রোডে ঢোকার পর আমার মনে হল আমি বোধহয় ফার্মগেটের কথাও আছি।, সব দোকান বাংলাদেশিদের। খাওয়ার দোকান তো প্রায় শতভাগ ই বলা চলে। বাহ, দারুন। বিদেশে এসেও আমি দেশে। মনটাই ভাল হয়ে গেল। রাস্তার ওইপারে ঢাকা রেস্টুরেন্ট নামে এক্তা দোকানে ঢুকলাম। মেনু দেখে অর্ডার দিলাম বোয়াল মাছ, ভাজি, ভর্তা, ভাত। বুফে সিস্টেম। খেয়ে বিল আসলো ৭ ডলার। আরো কম আসতো যদি আইটেম কম নিতাম।
এদিকে আগামীকাল প্ল্যান করেছি সেন্টোসা দ্বিপে অবস্থিত বিখ্যাত ইউনিভার্সাল স্টুডিওস এবং সি এক্যুরিয়াম এ যাব। এজন্য এগুলার টিকেট আগে থেকে কাটতে হবে। ট্রাভেল এজেন্ট থেকে টিকেট কাটলে ডিস্কাউন্ট পাওয়া যায়। বেশি খুজতে হলো না, রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েই একটা বাংলাদেশি ট্রাভেল এজেন্ট পেয়ে গেলাম। ভেতরে ঢুকলাম। একজন ভদ্রমহিলা বসে ছিলেন। তিনি টিকেট কেটে দিলেন, খরচ পড়ল ২ টা মিলে ১০০ ডলার। যদি কাউন্টারে গিয়ে কাটতাম তাহলে আরো ১০ ডলার মত বেশি লাগতো। অনেক এক্সপেন্সিভ। সিঙ্গাপুর পৃথিবীর ব্যয়বহুল দেশগুলোর একটি। ১ নাম্বার ব্যায়বহুল দেশ থেকে সম্প্রতি ৬ নাম্বারে নেমেছে।
এই টিকেট যে কেউ অনলাইনে কেটে নিতে পারবে ডুয়াল কারেন্সি কার্ড দিয়ে। তবে সেই ডিস্কাউন্ট টা পাওয়া যাবেনা। হাফ লিটার পানি কিনলাম ১ ডলার মানে ৬৩ টাকা, ভাবা যায় ! । বের হয়ে এলাম। চিন্তা করলাম মুস্তফা সেন্টার টা একবার ঘুরে নেই। যেহেতু শপিং করতে হবে তাই কি কি আছে এখানে সেটা আগে থেকে দেখে নিলে পরে কাজ সহজ হবে। এই সেই মুস্তফা সামসুদ্দিন এর মুস্তফা সেন্টার যেটার একটা শাখা আমাদের ঢাকার বসুন্ধরা সিটিতে আছে। তবে, ঢাকায় যেটা আছে, সেটা এইটার একটা ছোট পার্ট বলা যাবে। আমি জেনে এসেছি, এই মুস্তফা সেন্টার ২ দিনে ঘুড়ে শেষ করা যাবেনা এত বড়। আসলেই তাই।
সব বাংলাদেশী দোকান
মুস্তফা সেন্টার। এটা ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। তাই যেকোনো সময় ই শপিং করা যায়। যেহতু আমার আজকে রাতে আর কিছু করার নেই, তাই ঢুকে পড়লাম। বিশাল এলাকা জুরে রয়েছে এই মুস্তফা সেন্টার। ৪ তালা এই মেগা স্টোরে ২ তালা রয়েছে মাটইর নিচে আর ২ তালা রয়েছে উপরে। আমি ঢুকে কোন দিকে যাব তা ঠাহর করতে পারছিলাম না। এতো বড় মেগাস্টোর জীবনে দেখিনি তো। কি নেই এখানে? কাচা, পাকা, ইলেক্ট্রনিক্স, কাপর চোপর, ব্যাগ, গহনা, খাদ্য দ্রব্য, ঔষধ, খেলনা, কসমেটিক্স, চকলেট, জুতা, ঘড়ি, শো পিস, থাক, আর মনে পড়ছে না। আমি শুনেছি বাংলাদেশীরা নাকি এই মুস্তফা সেন্টার থেকে ব্যাগ ব্যাগ শপিং করে নিয়ে যায়। করবেই বা না কেনো, এতো জিনিস একসাথে দেখলে কে লোভ সামলাতে পারে । প্রচুর বাংলাদেশী দেখলাম শপিং করছে। এমনকি এখানকার কর্মচারি গুলাও অনেকে বাংলাদেশী। আমি অবশ্য আপাতত লোভ সংবরন করলাম, কারন এখন শপিং করলে সিঙ্গাপুর আর ঘোরা হবেনা।
মতিঝিলের হিরাঝিল রেস্টুরেন্ট ও আছে একটা
প্রায় ২ ঘন্টা মুস্তফা সেন্টার ঘুরে হোটেলে ফিরে এলাম। রাত সাড়ে ১১ টা বাজে, কিন্তু এখানে দেখে তা অবশ্য মনে হচ্ছেনা। রাতেই সিঙ্গাপুর জেগে থাকে। আমার অবশ্য আর জেগে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। আগামি কাল সকালে সেন্টোসা তে যেতে হবে, তাই ঘুম দরকার।
আমার হোটেল
টিভি চালু করলাম। রিমোট ঘেটে মাত্র ১৩ টা চ্যানেল পেলাম, যার ৩ টা তামিল, ২ টা সিঙ্গাপুরের আর বাকি বিদেশি। ব্যাপার কি? মাত্র ১৩ টা চ্যানেল? ধুর । সারাদিনের ধকলে চোখ বুজে এলো
চলবে
৩য় পর্ব