সকালে চোখ খুলে দেখি বিশাল পাহারের ওপরে আমাদের বাস। ঘুম এ আচ্ছন্ন অবস্থায় মনে হল কি ব্যাপার বান্দরবান চলে আসলাম নাকি। পরে অবশ্য আশেপাশের হিন্দি লেখা দেখে ভুল ভাংগলো। হিমাচল প্রদেশে ঢোকার সময় পাহাড়ি রাস্তা গুলো দেখে বান্দরবানের কথাই মনে হওয়ার কথা, কারন বান্দরবানের সাথে এই রাস্তার যথেষ্ট মিল আমি পেয়েছি। গিন্নীর দিকে তাকিয়ে দেখি সে অতি আগ্রহের পাহাড় দেখে যাচ্ছে। আমিও যোগ দিলাম তার সাথে পাহাড় দর্শনে।
আমাদের পৌছানোর কথা ছিল সকাল ৯ টার ভেতরে। কিন্তু বাসের যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে ঘুম থেকে উঠেও আবিষ্কার করলাম মানালি এখনো প্রায় ২৫০ কিমি, তাও পাহাড়ি রাস্তা। এদিকে বাসের যে অবস্থা তাতে বসে থাকাও প্রচন্ড কষ্টের। কিন্তু কিছুই করার নেই। আশেপাশের যাত্রিদের অবশ্য এ নিয়ে তেমন মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হলনা। তারা এতেই অভ্যস্থ। হিমাচল প্রদেশে ঢোকার পড়েই দেখি ড্রাইভার পরিবর্তন হয়ে গেছে। যে ড্রাইভার আমাদের দিল্লী থেকে নিয়ে এসেছিল সে নেমে গিয়ে আরেকজন উঠেছে। এতো দুরের পথ বলেই এই ব্যাবস্থা সম্ভবত। বাস সে চালাচ্ছেও প্রায় ভালই গতিতে। এই পাহাড়ি রাস্তায় এতো স্পিডে গাড়ি চালানো সবার পক্ষে সম্ভব নয়। এরা দক্ষ চালক বলেই পারছে। বেশ কিছু ছোট শহর সুন্দরনগর, বিলাসপুর, বরমানা ইত্যাদী পার হয়ে বাস এসে থামলো মান্ডিতে একটা ছোট পারিবারিক ঢাবায় সকালের নাস্তার জন্য। ঢাবাটি একজন হাজবেন্ড ও ওয়াইফ মিলে চালায়। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ভাবলাম কিছু খেয়ে নেই। খুব বেশি কিছু নেই, আলুর পরটা সাথে অনুবিক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখা যায় এই পরিমান মাখনের টুকরা। কি আর করা, তাই ২ জনে সাবাড় করে দিলাম। বিল আসলো ৬০ রুপি

দুপুর ২ টা বাজে আমরা কুল্লু পৌছালাম, যেখানে আমাদের মানালী পৌছানোর কথা সকাল ৯ টায়। অসহ্য এই জার্নিতে আমরা ২ জনেই অনেক ক্লান্ত। কুল্লুতে নেমে আমাদের বাস পরিবর্তন করতে হল। আমাদের হিমাচল রোড ট্রান্সপোর্টের একটা লোকাল বাসে উঠিয়ে দিল।
কুল্লু বাস স্ট্যান্ড
কুল্লু পার হয়ে মানালীর পথে আসতেই এর সৌন্দর্য চোখে পড়তে লাগলো। অদ্ভূত সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অপরুপা বিয়াস নদী। পাথুরে এই স্রোতসীনী নদী দেখে আমাদের গত ১৭ ঘন্টার অসহ্য জার্নির কষ্ট ভুলে গেলাম। যদিও এর মধ্যে প্রায় আরো ১ ঘন্টা পাহাড়ি জ্যামে আটকে ছিলাম, তার পরেও আশেপাশের সিনারি চোখ জুড়ানো। প্রায় ২১ ঘন্টার দীর্ঘ জার্নির পর আমরা মানালি মল রোডে এসে পৌছালাম। বাস থেকে নেমে একটা সি এন জি ডাকলাম হোটেলে যাযয়ার জন্য। ভারা শুনে আমি প্রায় অজ্ঞান, অল্প এতোটুকু রাস্তার জন্য ১০০ রুপি ভারা চাইছে। আমি সর্বোচ্চ ৩০ টাকা ধরেছিলাম। মানালি ট্যুরিস্ট এলাকা হওয়ায় এখানে ট্যাক্সি ভারা মারাত্তক রকমের বেশি। এতো দীর্ঘ জার্নি করে এসে আর কথা বারালাম না, উঠে পড়লাম।
মাত্র সাড়ে ৩ মিনিট লাগলো হোটেলে আসতে। আমাদের হোটেল নাম ছিল সুরিয়া ইন্টারন্যাশনাল। এটা বিয়াস নদীর উলটো দিকে নাজ্ঞার রোডে অবস্থিত। হোটেলে ঢুকে বুকিং কাগজ দেখালাম। ম্যানেজার কিছুক্ষন ঘুড়াঘুরি করে এসে আমাকে একটা বিপদজনক সংবাদ দিল আর তা হল তারা নাকি এই বুকিং সম্পর্কে অবগতই নয়

মানালি মল রোড
বিয়াস নদী
ফ্রেশ হয়ে, খানিকটা রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ২ জনে। এখন অবশ্য হেটেই মল রোডে গেলাম। পাহাড়ি রাস্তাতেও খুব সুন্দর ভাবে ফুটপাথ নির্মান করা হয়েছে। পাহারের সাথে বিয়াস নদীর ওপরে ঝুলন্ত ফুটপাথ। মল রোডে এসে একটা মনে পড়ল দুপুরের খাওয়া হয়নি। এদিকে খুব বেশি ভারি খাবারও খেতে ইচ্ছে করছেনা। তাই হালকা কিছু খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মল রোডে প্রচুর রেস্টুরেন্ট আছে। বেশিরভাগ ই পাঞ্জাবী ঢাবা টাইপের। এক যায়গায় দেখলাম মমো বিক্রি করছে। ১ প্লেট মমো নিয়ে নিলাম। দাম পড়ল ৮০ রুপি। মল রোডে খাবারের দাম মাশ আল্লাহ। তাই দাম দেখে কিনবেন। খাওয়া দাওয়া শেষে কিছুক্ষন বসে থাকলাম মল রোডে। মল রোডে সব কিছুই রয়েছে। খাওয়ার দোকান, হোটেল, ট্রাভেল এজেন্ট। কিছুক্ষন বসে আমরা মানালী টাউন ভিসিটে বের হলাম।
প্রথমে হাডিম্বা দেবীর টেম্পলে যাব বলে ঠিক করলাম। মহাভারতের রাক্ষসি হিড়িম্বার নামকরনে মন্দীর টি নির্মান করা হয় ১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। মহারাজা বাহাদুর সিংহ এই মন্দীরটি নির্মান করেন। মল রোড থেকে ওল্ড মানালীর দিকে হাটা ধরলাম। ট্যাক্সির যে ভারা তাতে হেটেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মন্দিরটা বেশ উচুতে। পাহাড়ি শহর হওয়ার কারনে রাস্তাও অনেক উচুতে। উঠছি তো উঠছি, রাস্তাই শেষ হয়না। এতো উচুতে একবার ভাবলাম ট্যাক্সি না নিয়ে ভুল ই করলাম নাকি। অবশেষে ৩ বার রেস্ট নেয়ার পর এসে পৌছালাম হাডিম্বা দেবির মন্দীরে।
হাডিম্বা দেবি টেম্পল
প্রচুর মানুষ লাইন দিয়ে রেখেছে মন্দিরের প্রসাদ নেয়ার জন্য। আমাদের তো আর এসবের ইচ্ছা নেই, তাই বাইরে থেকেই দেখতে লাগলাম। পাহাড়ি বনের মধ্যে মন্দিরটি দেখতে বেশ সুন্দর লাগে। বেশ কিছু ছবি নিলাম। প্রায় ২০ মিনিট মত থেকে নিচের দিকে রওনা দিলাম। হাডিম্বা মন্দীরে আসার জন্য অনেক উপরে উঠতে হয়, আর এই কারনে নিচের মানালির অপরুপ সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়।
বেশ কিছু ছবি নিয়ে নিচে নেমে আসলাম। হাটতে হাটতে আমাদের অবস্থা খুব ই খারাপ। তাই মল রোডে বসে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলাম। এদিকে মনে পড়ল আগামীকাল রোহতাং পাস যাবো, এর জন্যে গাড়ি ভারা করতে হবে। রোহতাং পাস মানালীর অন্যতম আকর্ষন। উঠে পড়লাম। মল রোডেই হাটতে হাটতে প্রচুর ড্রাইভার পেলাম যারা রোহতাং পাস যাওয়ার অফার করছে। মূলত মল রোডে অবস্থিত মানালি ট্যাক্সি ইউনিয়ন এর সামনেই এদের পাওয়া যায়। আমিও পেয়ে গেলাম একজন কে। ভারা ঠিক হল ৫৫০০ রুপি। রাত ৩ টায় হোটেল থেকে নিয়ে যাবে আমাদের। এখানে গাড়ি ভেদে দামের তারতম্য হতে পারে। বড় গাড়ি হলে ভারাও বেশি। রোহতাং পাস শেয়ারেও যাওয়া যায়। বহু ট্রাভেল এজেন্ট আছে এখানে যারা শেয়ারড ট্যাক্সি চালায় রোহতাং পাসে। আমরা ২ জনে একটু আরাম করে যাওয়ার জন্য ছোট একটা মারুতি আল্টো গাড়ি ভাড়া করেছিলাম। ড্রাইভার সিলেক্ট করার আগে তার পারমিট চেক করে নেয়া ভাল। রোহতাং পাসে সব গাড়ি যেতে পারেনা। নির্দিষ্ট সংখ্যক গাড়ি যাদের ওইদিনের পারমিট আছে তারাই যেতে পারবে। পারমিট ডেইলি বেসিস এ অনলাইন এ পাওয়া যায় যা নিজেও করা যায়।
রাতের মানালী
সন্ধ্যা হয়ে এলো। কিছুক্ষন মল রোডে বসে থাকলাম। রাতের খাওয়ার জন্য হালকা কিছু কিনে নিলাম। পরে হোটেলে ফিরে যাই। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম এসে গেল।
চলবে
৫ম পর্ব - রোহতাং পাস
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:০২