অবতরণিকা:
১. এই লেখার পর আমার অনেক ব্লগীয় সুহৃদ ব্লগে হয়তো আমার ছায়াও মাড়াতে চাইবেননা।তাদের কাছে দু:খ প্রকাশ করছি, চিন্তার মেরুকরনে দুই প্রান্তের বাসিন্দা হয়েও বোধ হয় বন্ধু হয়ে থাকা যায়।তর্ক-বিতর্কের প্রেক্ষাপটে চলতে চলতে কোনদিন যদি মুখোমুখি হই, সেদিন ভাবা যাবে কি করতে পারি আমরা।
২. ব্লগে আমার আ-লীগ, বিএনপি ও জামাত বিরোধী পদচারনা থাকলেও এই লেখার পর আমাকে অনেকে ভাদা ট্যাগিং দেবেন, আমি আগে থেকেই তা অস্বীকার করছি।
৩. আমাকে অনেকে নাস্তিক ট্যাগিং দেবেন সেটা আমি মাথা পেতে নেব।
------------------------------------------------------------
তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’, বিতর্ক দিয়ে যার শুরু এবং সে বিতর্ক অশরীরী এক সত্ত্বা হয়ে কালি-কাগজের বই-পুস্তক থেকে স্বামী-স্ত্রীর শোবার ঘর, হোটেল-রেস্তরাঁয় বন্ধুদের আড্ডা, চায়ের দোকান, মসজিদ-মাদ্রাসা সবখানেই জায়গা করে নিয়েছে আজ প্রায় দেড় যুগ হলো।আমার মনে আছে, সময়টা ১৯৯৩ সাল। সে সময় এক একটা মিছিল শুরু হতো বায়তুল মোকাররম উত্তর গেট হতে, পল্টন মোড়, কাকরাইল মোড় হয়ে সেগুলো গন্তব্য করতো শান্তিনগর মোড়ের দিকে; উদ্দেশ্য তসলিমার বাসভবনের সামনে গিয়ে একটা কিছু করা।মিছিলের প্ল্যাকার্ডে লিখা থাকতো, ‘মুরতাদ তাসলিমার ফাঁসি চাই’, নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবর…..ইত্যাদি, তারপর তসলিমার বই এর কপির সাথে তার কুশপত্তলিকার সহমরণ যোগে নিদারুন সেই আস্ফালন গুলো স্তিমিত হতো।১৯৯৩ সালেরই মাঝামাঝি কোন এক সময়ে সরকারী এক তথ্যবিবরনীর মাধ্যমে ‘লজ্জা’ নিষিদ্ধ হয়।সেই তথ্য বিবরণী অনুযায়ী, জনমনে বিভ্রান্তি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অঙ্গনে বিঘ্ন ঘটানো এবং রাষ্ট্র বিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার জন্য ‘লজ্জা’ নামক বইটির সকল সংস্করণ সরকার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে।
এটাকে কি বলবো? সরকারের নিলজ্জতা না নির্বুদ্ধিতা? যারা বইটি পড়েছেন তারা চিন্তার দুয়ারে হুড়কো না লাগিয়ে চিন্তা করে দেখুনতো এটা আসলেই সাম্প্রদায়ীক উসকানী মূলক বই কি না? একই ভূ-খন্ডে বসবাসকারী এক সম্প্রদায়ের উপর আরেক সম্প্রদায়ের এথনিক ক্লিন্জিং এর খড়গ এর বিরোধীতা করা কি করে সাম্প্রদায়ীক উসকানী হয় তা আমার জানা নেই।উপন্যাসটির আলোকে সরকারী তথ্য বিবরনীতে প্রকাশিত একটি শব্দের মধ্যেও কোন সত্যতা আমি খুজেঁ পাইনা।শৈল্পিক বিচারে লজ্জা’ যতনা উপন্যাস তার থেকে বেশী একটি তথ্যসহায়ীকা।বাবরী মসজিদ ধবংস হওয়ার আফটার ম্যাথ হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু নির্যাতনের চিত্র নিয়ে বিভিন্ন তথ্যে ঠাসা বইটি তাই শেষ পর্যন্ত একটি গল্প আঁকড়ে ধরলেও ওর আর নান্দনিক একটি উপন্যাস হয়ে ওঠা হয়নি।বরং গল্পের ফরমেটে তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করে সাম্প্রদায়ীকতার বিরুদ্ধে লেখিকার নিজের অবস্থানটাকে বোঝানোরই একটা প্রয়াস বলে মনেহয়।সাম্প্রদায়ীকতার দোষে দুষ্ট (!!) বইটির একখানে লেখিকা বলেছেন,
“করসেবকরা সাড়ে চারশ’ বছরের পুরোনো একটি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে।বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ঘোষিত করসেবা শুরুর পঁচিশ মিনিট আগে ঘটনাটি ঘটে।করসেবকরা প্রায় পাঁচ ঘন্টার চেষ্টায় তিনটি গম্বুজ সহ সম্পূর্ণ সৌধটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়।পুরো ঘটনাই ঘটে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস, বজরং দলের সর্বচ্চ নেতৃত্বের উপস্থিতিতে।কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, পিএসি ও উত্তর প্রদেশ পুলিশ নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে করসেবকদের অবিশ্বাস্য অপকান্ড দেখে।দুপুর দুইটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে প্রথম গম্বুজ ভাঙা হয়, সাড়ে চারটায় দ্বিতীয় গম্বুজ, চারটা পঁয়তাল্লিশে তৃতীয় গম্বুজটিও ভেঙে ফেলে উন্মত্ত করসেবকরা।”
এখানে মসজিদ ভাঙার বিরুদ্ধে লেখিকার অবস্থানটা টের পাওয়া যায় খুব সুস্পষ্টভাবে।ঠিক তেমনি সমগ্র বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর যে নির্যাতনটা ঐ সময় চলেছিলো, সে বিষয়েও তার অবস্থান খুব পরিষ্কার ভাবে টের পাওয়া যায় তার বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ব্যবহার এর মাধ্যমে, যেটিকে সরকারী তথ্য বিবরণীতে ‘সাম্প্রদায়ীক উসকানী’ আখ্যা দেয়া হয়েছে।আবার আরেক জায়গায় দেখুন তার বক্তব্য,
“বাবরি মসজিদ দেখেনি সুরঞ্জন।দেখবে কি সুরঞ্জন অযোধ্যায় যায়নি কোনদিন, দেশের বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি তার।সুরঞ্জন এটা মানে, ষোড়শ শতাব্দীর এই স্থাপত্য কাজে আঘাত করা মানে এ কেবল ভারতীয় মুসলমানকে আঘাত করা নয়, সমগ্র হিন্দুর ওপরও আঘাত, আসলে এ পুরো ভারতের উপরেই আঘাত, সমগ্র কল্যাণবোধ উপর, সমবেত বিবেকের ওপর আঘাত।”
এখানে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব কিছুর বাইরে দাঁড়িয়ে লেখিকা মানুষ হয়ে মানবতার অপমানকারীদের বিবেকের যে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন, ক’জন ধর্ম ব্যবসায়ীর চোখে এটা পড়েছে?না কি ধর্মে বিবেকের কথা বলেনা?
‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম…’ (শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি বাউল সম্রাটকে)।এই ভূ-খন্ডে সাম্প্রদায়ীক সম্প্রীতিরতো কখনও অভাব ছিলোনা, বাঙালী শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতেই এর প্রমান বিদ্যমান।মাইনরিটি, মেজিরটি, সবাইকে নিয়েই আমাদের এই ছোট্ট ভূ-খন্ড।রাষ্ট্রের মাধ্যমে সবার স্বীকৃতির মাঝেই আমাদের নিরবিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব।কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেই যখন জঙ ধরা যন্ত্র হয়ে ধর্মান্ধতার ঠুলি পড়িয়ে আমাদের অন্ধ করে দেয়, তার পরবর্তী ফল আমাদের জন্য কখনোই শুভ হতে পারেনা।লজ্জা’র অশৈল্পিক পট বিন্যাসে এই গুরুত্বপূর্ণ মেসেজটিই আমরা অতি নিরুপণ ভাবে পাই।আর তাই লজ্জা’ বাংলাদেশী হিন্দুর ঘরে জন্ম নেয়া সুরঞ্জনের ধীরে ধীরে অবাংলাদেশী হয়ে যাওয়া আর মুসলমান ঘরে জন্ম নেয়া অসাম্প্রদায়ীক হায়দারের ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়ীক হয়ে যাওয়ার গল্প বলে।সাম্প্রদায়ীক উসকানী দেয়না।
লজ্জা’র এক অংশে ধর্মকে তসলিমা কতটা উপরে তুলেছেন (হয়তো তার অজান্তেই), আমাদের ধার্মিক সরকারের বিধর্মী কলাকুশলীদের চোখে সেটা পড়েছে কি না আমার জানা নেই,
“জল খাবার ভেঙেছে।মরণচাঁদও নাকি ভেঙে চুরমার করেছে।সব মিষ্টির দোকান ভাঙা হচ্ছে।কারণ কি ধর্মীয় দ্বন্দ্ব?নাকি মিষ্টি খাওয়া, লুটপাট?সুরঞ্জনের মনে হয় ধর্মের চেয়ে হাতের থাবাটিই এখানে বড়।ধার্মিকেরা কখনও পারে বিধর্মীর সম্পদ লুট করে নিজের ধর্ম রক্ষা করতে?এতে আসলে ধার্মিকের কাজ নয়, এ হচ্ছে গুন্ডা বদমাশের কাজ।গুন্ডাবদমাশেরা সুযোগ পেলেই থাবা দেয়।”
লেখিকার এখানে ধর্মের নামে অধর্মকারীদের আলাদা করে চিহ্নিত করে ধর্মকে নিজের একটা নিষ্কলঙ্ক জায়গা করে দেয়াটা বোধ হয় আমাদের রাষ্ট্র যন্ত্রের চোখে পড়েনি।অথচ অত্যাচারে জর্জরিত, দেয়ালে পিঠ ঠেকা একজন সুরঞ্জন যখন ধীরে ধীরে কমুন্যাল হয়ে উঠলো, সেদিকে নজর পড়তে রাষ্ট্রের বিন্দুমাত্র দেরী হয়না।সত্যিই বিচিত্র দেশের বিচিত্র সরকার।
তসলিমা শ্লীল না অশ্লীল, আস্তিক না নাস্তিক, তিনি কতটুকু নারীবাদী আর কতটুকু পুরুষ বিদ্বেষী এই বিষয় গুলি এই লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়।অথবা তসলিমার পক্ষে কলম ধরতেও আমি বসিনি।আমি রাষ্ট্রের অসারতার দিকে দিক আঙুল ওঠাতে চাই।রাষ্ট্রের এই ধরনের অসারতা যেমন লজ্জা’র অসাম্প্রদায়ীক হায়দারকে কম্যুনাল করে তোলে, বা সুরঞ্জনের মনে তার স্ব-দেশ নিয়ে ঘৃণার জন্ম দেয়, তেমনি সমাজের অনেক স্তরে ঘৃণার বীজ বুনে দেয়।আজকের তসলিমার ‘তসলিমা’ হয়ে ওঠার পেছনে রাষ্ট্র যন্ত্রের অসাড়তার প্রভাব কতটুকু, পাঠক ভেবে দেখবেন।তসলিমার ঘাড়ে লজ্জা’র সাম্প্রদায়ীকতার জোয়াল চাপিয়ে রাষ্ট্র নিজেই সাম্প্রদায়ীকতার যে নিষিদ্ধ ইশতেহার আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে তার পরিণতি কি হতে পারে ভেবে দেখবেন।ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ৩:২০