ক
এক ম্যাচ হাতে রেখেই ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘ওয়ান ডে’ সিরিজ জয় নিশ্চিতভাবেই অনেক বড় অর্জন: বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক মাইল ফলক। এর আনন্দও বাঁধ ভাঙা, উল্লাসের জয়ধ্বনি প্রকট .......
এমন আনন্দের মুহুর্ত শুকনা মুখে পালন করা কঠিন কিন্তু অন্যকে বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করে মুখ ভেজানোটা কি আনন্দের বহি:প্রকাশ ? এ কোন ধরনের আনন্দ ? আনন্দের সময় আতশবাজি ফোটানো যেতেই পারে কিন্তু সে বাজির আগুন অন্যের চালায় আগুন ধরিয়ে দেবে কি না, এ বিষয়টিও মাথায় রাখা জরুরী । পাকিস্থানের সাথে জয়ের পর যে দৃশ্য দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, ঐতিহাসিক ক্ষোভের কারনেই আনন্দ উদযাপনের এহেন দশা । কিন্তু না, আমার ধারনা ভুল। ঐতিহাসিক কারনে নয়, বরং মস্তিস্ক বিকৃতির কারনেই আমাদের আনন্দ বহি:প্রকাশের এই নিম্নাবস্থা। কারন হিসেবে বলা যায়, কেবল পাকিস্থানের সাথে নয়, যেকোন দেশের সাথে জয় পেলেই আমরা বিশ্রীভাবে জাত ধর্ম সংস্কৃতি তুলে গালাগালি করি এবং একেই মনে করি আনন্দ উদযাপন ।..... এতে আমরা মজাও পাই ! কী আমাদের বিশালতা ! কী আমাদের সাংস্কৃতিক মান ! কেউ অন্যায় করলে প্রতিবাদও করি না, যা করি তাকে প্রতিবাদতো বলা যায়-ই না, প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে তবে ‘বিকৃত’ শব্দটি রাখতেই হবে....... গালাগালিকেই আমরা আনন্দ এবং প্রতিক্রিয়ার একমাত্র ভাষা বা মাধ্যম মানতে শুরু করেছি।
খ.
খেলায় হার জিত আছে এবং এই জন্যই এর নাম ‘খেলা’, এই চিরচেনা প্রবাদ বাক্যটি সবাই জানে কিন্তু অনেকেই মানে না। যদি তারা মানতো, তা হলে খেলার সময় বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দিয়ে স্টেডিয়ামে যাওয়াকে কেউ ‘দেশপ্রেম’ বলে চালানোর চেষ্টা করতো না। কী আমাদের চেতনাবোধ ! কী আমাদের দেশপ্রেম ! কী আমাদের সামাজিকতা ! ক্রিকেট খেলায় জিতে ফেসবুকে জঙ্গি টাইপ একখান স্ট্যাটাস দেয়াটাই এর একমাত্র বহি:প্রকাশ ! নিজে আনন্দ পাওয়ার জন্য নয়, অন্যকে গালি দেওয়ার জন্যই কি জয় ? তা-ই যদি না হয়, তবে আমাদের জয় উদযাপনের ধরন এমন বাজে কেনো ? কেনো এত বিশ্রী ? কেনো আমরা শত্রুর মৃত শরীরের উপর দাঁড়িয়ে উদ্বাহু হয়ে নাচবো ? কেনো আমরা পরাজিতদের সম্মান করতে পারবো না ? যদি এতটুকুই না পারি তবে ‘অসভ্য, বর্বর’ শব্দগুচ্ছ মাথায় তুলে নিতে আমার আপত্তি নেই .............................
গ.
অনেক ক্যাচক্যাচ করলাম এবার লঙ্কাকাণ্ডে আসা যাক । আনন্দ বাজার পত্রিকার বরাতে দেখলাম, সুধীর গৌতম (ভারতীয় ক্রিকেট টিমের বড় ফ্যান, বাংলাদেশের টাইগারদের মত) স্টেডিয়াম থেকে হোটেল/বাসায় ফিরছিলেন, পথে তাঁকে ইটপাটকেল ছুড়ে মারা হয়েছে । কেনো এই ইটপাটকেল ? মোস্তাফিজতো বল ভালই করেছে, ইটপাটকেল মারলো কারা ? তারা যারাই হোক এই ভূ-খণ্ডেরই মানুষ । এ দায়ভার আমাদের । আমাদের সকলের । যদি আমরা মোস্তাফিজকে নিয়ে গর্ব করতে চাই তবে ঐ ববর্রগুলিকে নিয়ে লজ্জা আমাদেরই পেতে হবে। ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে আমাদেরই ক্ষমা চাইতে হবে ..............
ঘ.
আমি জানি, নিকট অতীতে ‘ভারতীয় ক্রিকেট টিম’ আমাদের টিম নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছে । কেমন ছিলো সেই বাজে মন্তব্যের ধরন ! নিশ্চয়ই কাউকে পেটানো হয়নি, ইটপাটকেল মারা হয়নি । গালাগালিও করা হয়নি । বলা হয়েছিলো ‘অর্ডিনারি’ টিম, বানানো হয়েছিলো ‘টিভিসি:ব্যাঙ্গ ভিডিও’ । আমাদের কি স্বীকার করা উচিৎ হবে না যে, বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম তখন আপেক্ষিকভাবে (র্যাঙ্কিং ৯ ছিলো সম্ভবত) আসলেই অর্ডিনারি ছিলো ! হ্যাঁ, অতি সাম্প্রতিক সময় আমাদের টিম যে পারফর্ম দেখাচ্ছে তা ধরে রাখতে পারলে (আমাদের প্রত্যাশাও তা-ই) ‘অর্ডিনারি’ টিম শব্দটি আর এমনিতেই কেউ বলার সাহস পাবে না । তবে ‘অর্ডিনারি’ শব্দটি অবশ্যই অবজ্ঞাসুলভ এবং অপমানজনক কিন্তু সে ‘অর্ডিনারি’ এবং ‘টিভিসি’র মোকাবেলা মোস্তাফিজ করেছে, সাকিব, তাসকিনরা করেছে............. মাঠেই করেছে, খুব ভদ্রভাবেই করেছে, দেখেছে সারা ক্রিকেট বিশ্ব । ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীরাও দেখেছে.....
কিন্তু মাঠের বাইরে আমরা বিশ্বকে কী দেখালাম ! কী দেখাচ্ছি ! যা দেখালাম তা কী আমরা ! যেসব মন্তব্য লিখছি ফেসবুকের ওয়ালে তা-ই কী আমাদের পরিচয় ! যদি কর্মই মানুষের পরিচয় হয়, তবে হয়তো আমাদের আনন্দ উদযাপনের ধরন পাল্টাতে হবে নইলে এই পরিচয়কেই স্বীকার করতে হবে। নিশ্চয়ই দ্বিতীয় অপশনটি আমার পছন্দ নয় ........................................... মিঠুন চক্রবর্তীর গলায় শুনেছিলাম,‘মদ খাবি ? খা। নেশা যেন হাঁটুর উপরে না উঠে।’ মিঠুন দা ! আবার এবার একটু ঘুরিয়ে বলেনতো,‘ দেশের দল অবশ্যই সাপোর্ট করবি, তয়, এই দলাদলি যেন গালাগালিতে না গড়ায় ।’
বি.দ্র: তথ্যসূত্র নিয়ে কারো সন্দেহ থাকলে ‘অনুচ্ছেদ গ’ বাদ দিয়ে দেন ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৫ বিকাল ৪:০৭