
তালাক হচ্ছে সবচেয়ে ঘৃণিত হালাল কাজগুলোর একটি। পারিবারিক জীবনে বিশেষ অবস্থায় কখনও কখনও তালাকের প্রয়োজনীয়তা এড়ানো যায় না বিধায়ই এই বিধান রেখেছে ইসলামী শরীয়া। ইসলামী শরীয়া মোতাবেক তালাক দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি সম্মন্ধে অনেকেরই জানার আগ্রহ। অন্যদিকে তালাক সম্মন্ধে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে পারিবারিক জীবনে অনাকাঙ্খিত ঘটনার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এক কথা দু'কথায় তালাক দিয়ে পরে আফসোস করার ঘটনা অহরহই চোখে পড়ে। কেউ কেউ একইসাথে ৩ তালাকও দিয়ে বসেন। যদিও তাতে তালাক হয়ে যাবে কিন্তু এটা উত্তম পদ্ধতি নয়। যা হোক, তালাকের মত অতি স্পর্শকাতর এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রত্যেকেরই প্রাথমিক ধারণা রাখা ভালো। চলুন, বিষয়টি সংক্ষেপে দেখে নিই:
১. তালাকের প্রকারভেদ
ইসলামে তালাক প্রধানত দুই প্রকার:
- (ক) তালাকে সুন্নত (নবী করিম ﷺ-এর দেখানো পদ্ধতি)
- (খ) তালাকে বিদআত (নব-সৃষ্ট পদ্ধতি, যা শরীয়তসম্মত নয় কিন্তু কার্যত গ্রহণযোগ্য)
২. তালাকে সুন্নতের পদ্ধতি
(ক) আহসান পদ্ধতি (সর্বোত্তম):
- স্বামী স্ত্রীকে ১টি তালাক দেয়, তবে তা এমন সময়ে যখন স্ত্রী হায়েয বা ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র থাকে এবং ঐ পবিত্র অবস্থায় সহবাস করেনি।
- এরপর ইদ্দত (প্রতীক্ষা কাল) শুরু হয় (৩ মাসিক চক্র বা গর্ভাবস্থা পর্যন্ত)।
- ইদ্দতের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী রুজু (পুনর্মিলন) করতে পারবে (কোনো নতুন আক্দ বা মোহরানা ছাড়াই)।
- ইদ্দত শেষে তালাক চূড়ান্ত হয়।
(খ) হাসান পদ্ধতি (উত্তম):
- স্বামী স্ত্রীকে ৩টি তালাক পৃথক তিনটি পবিত্র সময়ে দেয় (প্রতি পবিত্র সময়ে ১টি করে তালাক, যেকোনো একটির মাধ্যমেই তালাক সম্পন্ন হয়)।
- প্রতিবার তালাক দেওয়ার পর ইদ্দত শুরু হয়।
- তিন তালাক দেওয়ার পর চূড়ান্তভাবে বিবাহবন্ধন ছিন্ন হয়।
৩. তালাকে বিদআত (অপছন্দনীয় পদ্ধতি):
- একই বৈঠকে বা একই বাক্যে ৩ তালাক দেওয়া (যেমন: "তোমাকে তিন তালাক")।
- এ পদ্ধতিটি গুনাহের কাজ তবে অধিকাংশ ফিকহি মাজহাব মোতাবেক কার্যকর হয় (যদিও এটি শরীয়তের উদ্দেশ্যবিরোধী)।
- অনেক আধুনিক মুসলিম দেশে (যেমন: ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান) এ পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে।
৪. অন্যান্য পদ্ধতি:
- খুলা: স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ চাইলে মোহরানা বা সম্পত্তি ফেরত দিয়ে সম্মতির ভিত্তিতে তালাক নেওয়া।
- তাফবীজে তালাক: স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার অধিকার অর্পণ করে, তবে স্ত্রী নিজেই তা প্রয়োগ করতে পারে।
- কোর্টের মাধ্যমে তালাক: ইসলামিক আইনে বৈধ কারণ (যেমন: নির্যাতন, অবহেলা) থাকলে আদালত হুকুমনামা জারি করে।
৫. ইদ্দত (প্রতীক্ষা কাল):
- মাসিক ঋতুবতী নারী: ৩টি পূর্ণ মাসিক চক্র।
- যে নারীর মাসিক বন্ধ: ৩ মাস।
- গর্ভবতী নারী: প্রসব পর্যন্ত।
- এই সময়ে স্ত্রীকে স্বামীর ঘরে থাকতে হবে এবং তাঁর ভরণপোষণ দেওয়া বাধ্যতামূলক।
৬. পুনর্মিলন (রুজু):
- প্রথম বা দ্বিতীয় তালাকের পর ইদ্দতের মধ্যে স্বামী মুখে বা কাজে (যেমন: সহবাস) রুজু করতে পারেন।
- তৃতীয় তালাকের পর পুনরায় বিবাহ শুধুমাত্র হালালা-র মাধ্যমে সম্ভব (স্ত্রী অন্য স্বামী বিবাহ করে তালাকপ্রাপ্ত হলে)।
৭. গুরুত্বপূর্ণ শরয়ি শর্তাবলি:
- স্বামী প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কের, এবং ইচ্ছাকৃতভাবে তালাক দিচ্ছেন (জবরদস্তি নয়)।
- তালাকের সময় সাক্ষীর উপস্থিতি শাফিঈ মাযহাবে এবং শিয়াদের মতে আবশ্যক, হানাফি মাযহাবে ঐচ্ছিক।
- ঋতুকালে বা সহবাসের পর তালাক দেওয়া নিষেধ (সুন্নতের লঙ্ঘন)।
৮. আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা:
- তিন তালাক সমস্যা: অনেক দেশে একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে (যেমন: ভারত, ২০১৯)।
- ইসলামিক স্কলারদের পরামর্শ: সুন্নত পদ্ধতি অনুসরণ করে ধৈর্য ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে তালাক দেওয়া।
৯. নৈতিক দিক:
- তালাক ইসলামে নিকৃষ্ট হালাল কাজ। নবীজি ﷺ বলেছেন, "আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত হালাল কাজ হলো তালাক" (আবু দাউদ)।
- পারিবারিক সমস্যায় মধ্যস্থতাকে (পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ বা ইসলামিক কাউন্সিলিং) সবসময় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
প্রত্যেক ক্ষেত্রে স্থানীয় ইসলামিক স্কলার বা কাযির সাথে পরামর্শ করে শরীয়তের বিস্তারিত জানা জরুরি।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




