শহীদ বরকতের মা
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে ১৯৪৭ সালের ১৮ মে মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের উদ্দ্যেগে হায়দারাবাদে উর্দূ সন্মেলনে যুক্ত প্রদেশ মুসলিম লীগ নেতারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দূ হবে বলে ঘোষনা দেন। এ ঘোষনা বাঙালী শিক্ষিত সম্প্রদায় কে প্রতিবাদ মূখর করে তোলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ এবং রসায়নের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ও অধ্যপক নুরুল ইসলাম ভূইয়া এই ধুমায়িত অসন্তোষকে সাংগঠনিক রূপ দেবার নিমিত্তে ১৯৪৭ সালের ১ লা সেপ্টেম্ভর পাকিস্তান তমুদ্দিন মজলিস গঠন করেন। এই তমুদ্দিন মজলিসই মহান ভাষা আন্দোলনের গোড়া পত্তন করে।
অক্টোবর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান তমুদ্দিন মজলিসের উদ্দ্যেগে ও পূর্ববঙ্গ সরকারের মন্ত্রী সাহিত্যিক হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী সভাপতিত্বে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সন্মেলনে বাংলা কে রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতদানের প্রথম প্রকাশ্য দাবি উত্থাপিত হয়।
১৯৪৭ সালে জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন। এ সুপারিশ এর প্রতিবাদে জ্ঞান্ তাপস ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন যদি ইংরেজীকে বিদেশী ভাষা বলিয়া পরিত্যাজ্য হয় তবে বাংলা কে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা রূপে গ্রহন না করার কোন কারন নাই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত দ্বিতীয় ভাষা কোন ভাষা গ্রহন করিতে হয় তবে উর্দূ বিবেচনা করা যেতে পারে।
১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী গনপরিষদে বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানালে প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী তাকে অত্যান্ত কটু ভাষায় অপমান করে, একি সময় পূনঃ পূনঃ দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে পূর্ব পাকিস্তানের উজিরে আলা খাজা নাজিমুদ্দিন গন পরিষদে উর্দূকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য ওকলাতি করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৬শে ফেব্রুয়ারী তরুন ছাত্র সমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে সমাবেত হয়ে বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কে অভিনন্দন জানান আর খাজা নাজিমুদ্দিনের নিন্দা জ্ঞাপ্ন করে সারা বাংলায় প্রতিরোধের ডাক দেয়।
২৭শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪৮ সালে তমুদ্দিন মজলিশের সভায় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন করা হয়, ১১ মার্চ হরতাল, বিক্ষোভ ও সভা আহ্বান করা হয়। উক্ত সভায় যোগদানের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ১০ই মার্চ অলি আহাদ এবং আরো কিছু নেতৃবৃন্দ সহ ঢাকায় আসেন। সেখানে সেক্রেটারিয়েটে্র গেটে শান্তিপূর্ন বিক্ষোভ করার সময় প্রথমে শামসুল হক পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। সন্ধ্যা নাগাদ ৬৯ জন কে গ্রেফতার করে সরকার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিক্ষেপ করে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা নগরী হয়ে ওঠে মিছিলের নগরী। ১৫ ই মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সাথে আলোচনায় বসার জন্য অধ্যাপক আবুল কাশেম ও কমরুদ্দিন আহমেদের সহায়তা চায়। কারাগারে আলোচনা চলে এই জনরোষ শান্ত করার জন্য। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও অলি আহাদ কে দায়িত্ব দেয়া হয় সরকারের সাথে আলোচনা করার। এ আলোচনায় একটি চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হয়, যাতে প্রকারন্তে নাজিমুদ্দিন পরাজয় মেনে নেয়।
পাকিস্তানের স্বাধীনতার বছর জিন্নাহ ঢাকা আসলে তার সন্মানে ঢাকা ভার্সিটিতে এক বিশেষ সমাবর্তনের আয়োজন করা হয় সেখানে সে ঘোষনা দেয় “Urdu & urdu shall be the state language”। এই ঘোষনার সাথে সাথে সমাবর্তনে উপস্থিত ছাত্রদের একাংশ No No ব লে প্রতিবাদ জানাল।
১৯৫২ সালের ২৭ শে জানুয়ারী বিকালে পল্টন ময়দানে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাল উর্দূই হবে এক মাত্র রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪৮ সালের ১৫ ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন বেঈমান নাজিম উদ্দিন তা পুরোপুরি অস্বীকার করলেন।
৩০শে জানুয়ারী ঢাকা জেলা বার কাউন্সিলে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাষানীর সভাপতিত্বে সর্ব দলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই সভায় ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ছাত্র বিক্ষোভ, ধর্মঘট ও সভার প্রস্তাব গৃহীত হয়। ওই সভায়ই ২১ শে ফেব্রুয়ারী পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের অধিবেষন তারিখ বিধায় ২১ শে ফেব্রুয়ারী সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারন হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৬ ই ফেব্রুয়ারী পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের অফিসে মাওলানা ভাষানীর সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে অর্থ সংগ্রহের নিমিত্তে ১১ ও ১৩ ই ফেব্রুয়ারী পতাকা দিবস পালন করে জনগনকে অর্থ সাহায্যের আবেদন জানানো হয়। সভায় ১৪৪ ধারা হলে আইন ভঙ্গ হবে কিনা সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
২০ শে ফেব্রুয়ারী বিকালে খুনী নূরুল আমিন সরকার সারা দেশে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে সমস্ত সভা সমিতি নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ওই ঘোষনার সাথে সাথে ঢাকা ভার্সিটির সমস্ত হলের ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একই সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররাও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের শপথ নেয় ওই সন্ধ্যায়।
২১শে ফেব্রুয়ারী সকাল নয়টার মধ্যে বিভিন্ন হলের গেট থেকে ৬ জন / ৯ জনের এক একটি গ্রুপ বের হয়ে আসে স্বেচ্ছায় রাস্তায় অপেক্ষামান পুলিশের হাতে গ্রেফতার হবার জন্য। পুলিশ হতচকিত হয়ে যায়। এই শান্তিপূর্ন গ্রেফতারকে অন্য পথে ধাবিত করার জন্য সরকার নিয়োজিত নৈরাজ্যবাদীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ করা শুরু করে। পুলিশ ও এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ঢাকা জেলা প্রশাসক কোরাইশীর নির্দেশে পুলিশ গুলি বর্ষন শূরু করে। প্রথম শহীদ হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এম এ ক্লাশের ছাত্র আবুল বরকত।
এরপর মারা যায়, জব্বার, শফিউর রহমান, রফিক আরো কয়েক জন নাম না জানা ছাত্র। ১৭ জন ছাত্র মূমূর্ষভাবে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ইতিহাসে প্রথমবারের মত মায়ের ভাষার জন্য রক্ত ঝরল আমি পেলাম মায়ের ভাষা-
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি।
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি।
আমার সোনার দেশের রক্তে জাগালো ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি।
জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
বিভিন্ন পত্রিকা ঘেটে ভাষা আন্দোলনের এই ক্রমপঞ্জী দেবার চেষ্টা করলাম। কোন তারিখ যদি বাদ যায় জানবেন সেটা আমার অনিচ্ছায়। আর ছবি গুলো বিভিন্ন ওয়েব ঘেটে। সবাইকে আলাদা ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারলাম না। কিন্তু এই লেখার তথ্য আমি যে সব বই ও পত্রিকা ঘেটে বের করছি তাদের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা আর ভাষা শহীদদের যেন আল্লাহ বেহেশত নসীব করে
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:২১