
আগের পর্বের পরে
রাতে ঘুমিয়েছিলাম সিয়াম দিদির বাগান বাড়িতে। বাগান বাড়ি শুনলেই মনে হয় বাংলা সিনেমার আড্ডা, যেখানে নায়িকা সহ সুন্দরী মেয়েদের ধরে আনা হয় এরপরে নানা কান্ডকলাপ করতে হয়। তবে সিয়াম দিদির বাগান বাড়ি হচ্ছে বাগান বিলাসের জঙ্গলের মধ্যে একটা বাড়ি, সোলার ইলেক্ট্রিসিটি আছে, কাঠের চৌকি আর একটা করে টেবিল আছে। দরজা খুলে রাখলে বগা লেক থেকে চমতকার ঝিরি ঝিরি হাওয়া আসে, অবশ্য টক্কে, গিরগিটি আর লারামের শুকর গুলোও ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে।
বগালেকে এটা আমার চতুর্থবার। প্রতিবারই খুব ভোড়ে অন্ধকার থাকতে কেওকারাডং এর দিকে রওনা হয়েছি। ডিজিটাল টাইম সকাল ৬টায় চারদিকে ঘুরঘুট্টি আধার থাকে। কিন্তু এবারে উঠলাম সাড়ে সাতটার দিকে। অবশ্য উঠে দেখি কারো মধ্যে কোন গা নেই। সবাই আয়েশ করে নাস্তা করছে। টুটু ভাই অবশ্য কয়েকবার ধাওয়া দিলেন তারাতারি করার জন্যে, কিন্তু উনি নিজে যাচ্ছেননা, বগা লেকে থেকে যাচ্ছেন দুপুরের খাওয়ার আয়োজনে। নিরব ভাই আর মিজান ভাই উঠেছেন অনেক ভোড়ে, বগা লেক এবং নিচের রাস্তার কিছু অকল্পনীয় সুন্দর ছবি তুলেছেন।
রাস্তা কর্দমাক্ত। খুব সাবধানে পাহাড় বাওয়া শুরু হলো। পরিচিত রাস্তা। কিন্তু বৃষ্টির পড়ে আসে পাশের জঙ্গল যেন ট্রেইলটাকে কাঁচা খেয়ে ফেলার চেষ্টা শুরু করেছে। আমরা সাবধানে পা ফেলে হাঁটা শুরু করলাম। সময় বেশী লাগলো অনেককটা। তবে মেঘলা দিন রোদের ঝামেলা নেই। প্রচন্ডে জোড়ে পানি নেমে আসায় রাস্তায় জায়গা জায়গা গর্ত হয়ে গেছে। অদ্ভুত ভাবে জোঁকের উতপাতও কম। পথে আরিফ আর মিজান ভাইকে ২টো জোক ধরলো। ঝর্না আর ঝিরি গুলোতে পানি অনেক বেশী। চিংড়ি ঝর্নার মুখে অনেকক্ষন বসে রইলাম। পানি পড়ার দারুন শব্দ আসছিলো। ভুল করেছিলাম একটু এগিয়ে ঝর্নাটা দেখা হয়নি দেখে। বাঁশের সাঁকোতে এসে পুরা হিন্দি মুভী স্টাইলে নিচের একটা নরম বাঁশ খুলে গেল আর শিমুল ভাইয়ের একটা পা গেল তাতে আটকে।
চারপাশে শুধুই মেঘ। বড় বড় ঘাসের ট্রেইলে দাঁড়িয়ে মেঘের মাঝ দিয়ে হাটতে হাটতে সবারই সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে। আগে সব সময় ঘামে ভিজেছি, নইলে বৃষ্টিতে। মেঘের মধ্যে দিয়ে ভিজতে ভিজতে উঠতে অন্যরকম লাগছিলো। আকাশ ছোবার বাসনা সবার। সেই আকাশের মধ্যে দিয়ে হাটতে পারা স্বর্গিয় অনুভতি। দূরে চিম্বুকের দেয়ালের মতো রেঞ্জটা মেঘের আরাল থেকে বার বার মাথা গলাচ্ছে। হঠাত দু সারী পাহাড়ের মাঝ থেকে আমাদের হাইটে কালো এক পশলা মেঘ আসাতে তারাতারি পা চালালাম সবাই বৃষ্টি আসলে খবর আছে।
দার্জিলিং পাড়ায় পৌছাতে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশী সময় লাগলো। চারপাশে নির্জন। মাঝে মাঝে গভীরে বন থেকে পাখির ডাক ভেসে আসছে। অরণ্যের নিজের কিছু শব্দ থাকে। দার্জিলিং পাড়াতে চা-এর বিরতী। পিছের পার্টি অনেক পিছিয়ে গেছিলো। ওদের জন্যে অপেক্ষার পাশাপাশি দির্ঘসময় জিরালাম। আড্ডাফাইংও কম হলো না। একটা হরীনের চামড়া চোখে পড়লো। ইদানিং এ অঞ্চলে হরীন দেখা প্রায় অসম্ভব। এ বছরের শুরুতে থানছির চ্যামাখাল দিয়ে কেওকারাডং ট্রেকে পূর্ণিমা রাতে হরীনের ডাক শুনেছিলাম। ক-বার রাতের অন্ধকারে জ্বলজ্বলে চোখও নজরে পড়লো। হরীনের চামড়াটা ভালো করে দেখতে গিয়ে নজরে পড়লো গলার কাছে গুলির চিহ্ন। গুলিটা এফোড় ওফোড় করে চলে গেছে। দোকানী ছেলেটা জানালো তার বাবা ৪/৫দিন আগে জঙ্গলে গিয়ে এটা মেরে এনেছে। পথে অবশ্য আরেকদল বম শিকারী চোখে পড়েছিলো। কৌতুহলী হয়ে তাদের ব্যাগে উকি মেরে অনেকগুলো পাখি দেখেছি।
দার্জিলিং পাড়া থেকে কেওকারাডং চুড়া দেখা যায়। দুরত্ব মাত্র আধাঘন্টার। কিন্তু আমাদের প্রায় একঘন্টার মতো লাগলো। পিছিয়ে পড়া পার্টি নজরে আসতেই আমরা গ্রাম থেকে বেড়িয়ে গেলাম। আমাদের দলটাই আগে। কিন্তু আস্তে আস্তে আমি পিছিয়ে পড়তে লাগলাম। কাল রাত থেকে জ্বর। খারাপ লাগছিলো। আর পাহাড়ে জ্বর,খুব ভয় পাই ম্যালেরিয়াকে। সৌরভ আমাকে সঙ্গ দিচ্ছিলো ভালোমতো। কেওকারাডং এর সিড়িতে আসতেই উতসাহে সে দৌরে দৌরে উঠে গেল। বকর ভাই ধার্মিক মানুষ। গতবারের মতো উঠেই শোকরানা নামায পড়ে ফেলেছেন। অনেকদিন টুরিস্টের অত্যাচার নাই। কেওকারাডং তাই যৌবন ফিরে পেয়েছে। লাল পিলারটা পেলাম না। প্রথম কালো পিলারটাই স্বগর্বে ঘোষনা করছে* বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অবস্থান। চারদিকে বড় বড় ঘাস আগাছার জঙ্গল। বেশ কয়েকটা জোঁক বের হলো ক-জনার গা থেকে। ছাউনির সামনে অর্ধনির্মিত একটা চালা ঘর দেখলাম এবার। মনে হয় টুরিস্ট মৌসুমে দোকান টোকান করার ভয়ঙ্কর চিন্তা।
নিচে থাক থাক পাহাড় ওদিকে ছবির মতো সুন্দর কিছু গ্রামের চালা ঘর মাঝে মাঝে ঝিলিক দিচ্ছে, রুমানা পাড়া, সুংসাং পাড়া... হঠাত ডানের পাহাড় থেকে এক খন্ড মেঘ আসলো আমাদের একটু নিচ দিয়ে। ঘন মেঘ। বৃষ্টি হয়ে সুংসাং পাড়ার উপরে পড়ার অপেক্ষা। বাঙ্গালীর ছেলে বৃষ্টি ভালো বাসে না হতেই পারেনা। কিন্তু মেঘের উপরে বসে নিচে বৃষ্টি দেখতে পাওয়া... সে অন্যরকম কিছু।
গ্রুপ ছবি তোলা হলো। হাউ কাউ করা হলো। লাফা লাফি চিল্লা চিল্লিও হলো। এবার ফেরার পালা। মেঘের ফাঁক গলে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। দার্জিলিং পাড়াতে এক মুরং দাদার সাথে আলাপ হলো। কথা বলে জানলাম তার ঘোরার নেশা প্রচুর। এই ব্লকের দুর্গল এলাকা গুলো সব দেখেছেন। রাং তল্যাং (উচ্চারন RANG TLANG), বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়া ক্ল্যান ময়, রাইখান লেক, রাইখাং ঝর্না, তিনমাথা... আমি স্বপ্নের দেশের কথা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম।
নামার সময় তারা তারি হয়। আমরা একটার মধ্যেই বগা লেকে হাজির। ব্যাগপেকটা রেখে এক লাফে বগা লেকে। গলা পানিতে ডুবে রইলাম সবাই। ছোট ছোট মাছের পোনা আলতো কামড়ে গা ম্যসাজ করে দেয়। খুব আরাম লাগে।
সন্ধ্যায় চা এর আসর বসলো লারামের চাতালে। আসার আগের রাতে ‘আমরা একটা সিনেমা বানাবো’ গ্রুপের শিশির দা এসেছেন সদলবলে। ওরা উঠেছে লারামের ঘরে। লারামের গিটার নিয়ে গানের আড্ডা বসিয়েছে। আমি আর ইশতি গেলাম উপরে বগা লেক পাড়ায়। প্রতিবার বগালেকে এসে লারাম, সিয়াম দিদি, গীর্জা, স্কুল এর বেশী কিছু দেখা হয়না। দাদুকে (লারামের দাদা) খুজে বের করলাম। দাদু অনেক গল্প জানেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মিজো গেরীলা, শান্তিবাহিনী, উনিশশো একাত্তর। সমস্যা গল্প শুরু করলে উতসাহে বাংলা, বম, আরাকানী মিশ্র ভাষা বলতে থাকেন। দারুন মজার মানুষ। দাদু দেখি আমাকে চিনতেই পারলো না। গতবার ত্রিভুজ তাকে সানগ্লাস গিফট করেছিলো। সানগ্লাসের গল্প বলতেই আবার জগাখিচুড়ি ভাষার তুবরি ছোটালো।
রাতের বেলা গা শির শির করতে লাগলো। বুঝলাম জর আসছে।
ছবিঃ (অনেকগুলা, লোড হইতে সময় লাগবে, তাই যারা পড়বেন তাদের কাছে অগ্রিম ক্ষমা প্রার্থনা)

কেওকারাডং এর চুড়ায় আমাদের ভিজিয়ে মেঘদল যাচ্ছে সামনে। নিচের সুংসাং পাড়া/রুমানা পাড়াকে ভিজাতে ব্যাস্ত।

মেঘে ঢাকা দার্জিলিং পাড়ার ট্রেক। দুরের আবছা কালো দেয়ালটা চিম্বুক রেঞ্জ।


সাদা ধোয়া ধোয়া গুলো মেঘ। পুরো ট্রেইলটাকেই ভিজে চুপশে দিয়েছে।

চ্যামাখাল (থানছির) আদিগন্ত প্রান্তর

আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেব আকাশে। কিন্তু আকাশ তো আমার নিচে।

বোঝা যায় না এমন ফিনফিনে বৃষ্টি, চারদিকে অন্ধকার। আসলে আমরা বৃষ্টির উৎসে দাঁড়িয়ে, চারপাশে কালো মেঘ।

খুব পছন্দের একজন প্রবাসী ব্লগার সৌরভকে পেলাম এবারে সঙ্গি হিসাবে।

আমি আকাশ ছুয়েছি।

মেঘের দেশে পথ চলা।


সুংসাং পাড়ার জুম ক্ষেত।

বাবুটা দার্জিলিং পাড়ার আর দিদি বগালেক পাড়ার। কি কাজে দিদি যাচ্ছিলেন টের পেলেন বম পাড়ায় এই বাবু কাঁদছে, মা গেছে জুম ক্ষেতে। বাবুটাকে কোলে করে হাটা হাটি করে কান্না থামিয়ে আবার আগের পথে চলে গেলেন। উনি বাবুটার মা-বাবাকে চিনেনও না। বমদের কালচার আমাদের কাছে একটু অদ্ভুত।

জুম ক্ষেত।

পাখির চোখে দার্জিলিং পাড়া।