অকারণে কাউকে রাগিয়ে দেয়া ঠিক না। কিন্তু বেশীরভাগ সময়ই আমরা ঠিক কাজটা করি না। আমরা বলাটা ঠিক হল না।
বলা উচিত আমি।
আমি অনেকসময় অকারণে অনেককে রাগিয়ে দেই। আজকেও এমন করেছি। এর এক অন্যরকম আনন্দ আছে। কি রকম আনন্দ ঠিক বলে বুঝানো সম্ভব না।
ছোটবেলায় একসময় গ্রামে ছিলাম। গ্রাম মানে গ্রাম, একেবারে আদর্শ ভিলেজ যাকে বলে। পাকা ব্রীজ ছিল আমাদের বাড়ী থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরে। ঐ ব্রীজ পর্যন্ত যেতে আরো দুইটা বাঁশের সাকো পাড়ি দিতে হত। যেনতেন বাঁশের সাকো না একেবারে সোলেমানী বাঁশ। পুরাতন বাংলা গল্প খুঁজলে এই ধরনের সাকোর সন্ধান মেলে।
আমার ধারণা, এই সাকো যারা বানায় তারা সরাসরি আর্মির কমান্ডো ট্রেনিয়ের মডেল ফলো করে। সাকোতে যারা পারাপার হয় তাদের ছোটখাট কমান্ডো ট্রেনিং হয়ে যাবার কথা। আগেকার দিনের লোকজন বোধকরি এই সাকো দেখেও পরকালের কথা ইয়াদ করত। যারা নিয়মিত এই সাকো ব্যবহার করেছে তারা চোখ বন্ধ করে আর্মিতে চান্স পেয়ে যাবে অন্তত এতটুকু নিশ্চিত।
এতক্ষন যে বাঁশের সাকোর কথা বলছি আমি গ্রামে থাকতে জানতামই না যে একে সাকো বলে। সবাই বলত "হাউক্কা"। একবার কোন এক ক্লাসের বাংলা বইতে পড়ে জেনেছিলাম ঐ সোলেমানী(!) বাঁশের পুলের নাম হাউক্কা না সাঁকো।
ততদিনে আমি গ্রাম্যবালক থেকে পুরোদস্তুর শহুরে।
প্রথম গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছি ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরের সাত তারিখ। পুঙ্খানুপুঙ্খ তারিখ অবশ্য আমার মনে থাকে না। সামাজিক বিজ্ঞান পরীক্ষাতেও ইতিহাসের তারিখ সাল ভুল করতাম। কিন্তু কোন এক অদ্ভূত কারণে এই তারিখটা মনে আছে।
এর আগে আমার শহর দেখার দৌড় ছিল টিভি পর্যন্তই। তবে একবার অনেক ছোট থাকতেই ঢাকায় গিয়েছিলাম। তখনকার কোন স্মৃতিই আর অবশিষ্ট নাই। শুধু মনে আছে একটা হোটেলের মধ্যে বসে কোক খাচ্ছি। খুবই ঠান্ডা কোক। পুরাটা খেতে পারতেসিলাম না বলে আব্বু ছোটখাট একটা ধমক দিয়েছিল। ব্যস আর কিছু মনে নেই।
গ্রাম ছেড়ে আসার আগে কয়েকটা মজার ঘটনা ভাসাভাসা মনে আছে। কিছু নিজের মনে আছে আর কিছু আম্মুর কাছ থেকে শুনেছি।
একদিক এক চাচা আমাদের বাড়িতে আসল। এসেই বাচ্চাদেরকে যেই টাইপের প্রশ্ন করার নিয়ম সেরকম প্রশ্ন করতে শুরু করল।
দুপুরে কি খেয়েছ?
বিকালবেলা ঘুমাওনি কেন? এইসব।
কি উত্তর দিয়েছিলাম মনে নাই। তবে উনার চেহারা দেখে মনে হয়েছিল আমার উত্তর পাশ মার্ক পাওয়ারও যোগ্য না। এরকম আরো কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হল গ্রামে থেকে ছেলেপেলে ঠিকমত মানুষ করা প্রায় অসম্ভব।
তাহলে কি উপায়?
যাও শহরে যাও।
ডিসিশান ফাইনাল হওয়ার পরে আমরা দুই ভাইবোন প্রতিদিন নিয়ম করে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। বিভিন্ন ধরনের নিয়ম কানুন শেখানো হল। কিছু নিয়ম বলি
-যেখানে সেখানে থুতু ফেলা যাবে না। থুতু ফেলার একমাত্র জায়গা বেসিন অথবা টয়লেট।
-বিকালবেলা ঘুরাঘুরি, খেলাধুলা, ঘাস কাটতে যাওয়া, মাছ ধরতে যাওয়া নাস্তি। দুনিয়াতে বিকাল নামক জিনিসটা আসে কেবলমাত্র ঘুমের জন্য।
-চুলে তেল দেয়া ছাড়া ঘর থেকে বেরুনো যাবে না।
-আন্চলিক ভাষায় কথা বলা যাবে না, পৃথিবীর একমাত্র ভাষা প্রমিত বাংলায় কথা বলতে হবে।
আরো অনেক কিছুর ট্রেনিং সেশন শুরু হয়েছিল, সবগুলো ঠিকমত মনে নাই।
তবে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল, কোন কারণে মার খেলে শব্দ করে কান্নাকাটি করা যাবে না।
হায় হায় সবই মানলাম কিন্তু এই জিনিস হজম করব কেমনে?
আমার আবার মার খাওয়া ছিল দৈনিক রুটিনের একটা অলিখিত অংশ। বলা বাহুল্য একদিন শব্দছাড়া কান্নাকাটির প্রাকটিসও করতে হয়েছিল। আহারে কি দিন গেছেরে মমিন?
গ্রাম ছেড়ে চলে আসার দিনের কথা তেমন মনে নাই। তবে শহরের মাঝে বড় বড় পাতাওয়ালা একধরনের গাছ দেখে সেদিন খুব অবাক হয়েছিলাম। আর তারচেয়েও অবাক হয়েছিলাম আমরা যেই বাড়িটাতে উঠেছিলাম সেই বাড়ির ছাদে বিড়ালের বাচ্চা দেখে। সাদা রংয়ের তিনটা বিড়ালের বাচ্চা।
০৭ডিসেম্বর,২০১২