সাদাকালো কিংবা ধূসর জীবন
আমাদের বাসায় প্রায় পনের বছর আগে সাদাকালো একটা টিভি ছিল। সেই টিভি একটা কালো বাক্সের মত ছিল দেখতে। আমি মাঝে মাঝে সেই বাক্সের সামনে বসে থাকতাম আর মুগলি কার্টূন দেখতাম। রুটিন করে নানীর সাথে বসে শুক্রবারে পূর্নদৈর্ঘ্য বাংলা সিনেমা দেখতাম। আমি যখন বাক্সের সামনে বসে থাকতাম আমার ভাইয়া তখন গোল হয়ে বসে স্কুলের ভর্তি পরীক্ষার জন্য অংক করত। আম্মু-আব্বুর সাথে আমার বেশি দেখা হতনা। আমি ঘুম থেকে উঠার আগেই আব্বু অফিস আর আম্মু থিসিসের কাজে পিজি (বর্তমান বঙবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়) চলে যেতেন। রাতে আমি ঘুমানোর পর (আমার তখন খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া কোন কাজ ছিলনা। তাই মনে হয় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতাম) তাঁরা বাড়ি ফিরতেন। বলাই বাহুল্য আমি তখন ছোট ছিলাম—আমার বয়স ছিল চার। সেই বয়সের স্মৃতি কারো ভালভাবে মনে থাকার কথা না। কিন্তু আমার মনে আছে--ভালমতই মনে আছে। মনে থাকার কারণ ও আছে।
আমাদের বাসায় তখন পড়াশোনার পরিবেশ। আম্মু থিসিসের জন্য পড়ছে,ভাইয়া সবসময় পড়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য। আমার ও পড়তে ইচ্ছা করত। তাই আমি ও পেপার উলটা করে ধরে পড়া শুরু করলাম। লেখার উলটা সোজাও আমি তখন বুঝতাম না। আমার এক খালা বাসায় এসে দেখলেন আমি পেপার উলটা করে ধরে আছি। তিনি সেটা আম্মুকে বলে দিলেন এবং ব্যাপক হাসাহাসি হল। আমাকে এই ঘটনার কয়েকদিন পরে বাসার কাছে একটা স্কুলে প্লেতে ভর্তি করে দিল সবাই।
একদিন স্কুল ছুটির পর এক আন্টি (তাঁর মেয়ে আমার সাথে পড়ত) আমাকে আর আমার নানীকে তাঁদের বাসায় নিয়ে গেলেন বেড়াতে,অনেকটা জোর করেই। আমি তো তাঁদের বাসা দেখে অবাক! মানুষের বাসা এত বড়! তাহলে আমাদের বাসা এত ছোট কেন? তাঁদের বাসায় টিভি চলছিল। টিভি যে একটা আরেকটার থেকে আলাদা এবং সুন্দর হয় ছোট্ট আমি জানতাম না। সেই টিভিটা রঙ্গিন ছিল—সেই টিভির ভেতরের গাছের পাতা সবুজ ছিল। আমি অবাক হলাম। আমাদের টিভি পঁচা! আমার খুব মন খারাপ হল। আমাদের বাসা পঁচা,টিভি পঁচা,সব পঁচা। আমি কিন্তু বাসায় এসে আমার মন খারাপের কথা কাউকে বললাম না। শুধু সাদাকালো টিভি দেখা আমি কমিয়ে দিলাম। সেই তখন থেকেই মনে হয় মন খারাপ লুকিয়ে বেঁচে থাকা আমার স্বভাব হয়ে গেল।
কাগজে মোড়ানো আনন্দ
আমাদের বাসায় আনন্দ বেশি ছিলনা। আমি তখন অল্প অল্প বোঝার চেষ্টা করতাম। আব্বু-আম্মুর টাকা-পয়সার টানাটানি। আম্মু ৩ টাকা রিকশা ভাড়া বাঁচাতেও হেঁটে হেঁটে বাজার করত,অন্য সব কাজ হেঁটে হেঁটে করত। আব্বুর মনে হয় মেজাজ খুব খারাপ থাকত। তাই মাঝে মাঝে আমি আর ভাইয়া মারামারি করলে আমাদেরকে বেত দিয়ে মারত। অনেক জোরে জোরে মারত। ভাইয়া অনেক দুষ্টু ছিল ছোটকালে। মাঝে মাঝে আমাদের দোতালা বারান্দা দিয়ে রাস্তার মানুষের মাথায় ভাইয়া পানি ফেলে দিত। আমিও ভাইয়ার পাশে দাঁড়িয়ে তার কুকীর্তির সাক্ষী হতাম। রাস্তার মানুষজন উপরে তাকানো মাত্র আমরা লুকিয়ে যেতাম। এটা করতে মজা লাগত। ভাইয়া আরো অনেক দুষ্টামি করত। মার ও খেত প্রচুর। আমি খুব শান্ত ছিলাম ছোটবেলা থেকেই। ভাইয়াও আমাকে মাঝে মাঝে অনেক মারত। কোন কারণ ছাড়াই মারত। আমি আব্বু আর ভাইয়াকে খুব ভয় পেতাম। ভাইয়াকে বলতাম পুলিশ ভাইয়া।
একদিন হঠাৎ আমাদের বাসায় আনন্দ এল। ভাইয়া গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরী স্কুলে ক্লাস ওয়ানে চান্স পেয়ে গেল। আব্বু সেদিন একটা মিষ্টির প্যাকেট আনল। কাগজে মোড়ানো মিষ্টি! আর আম্মুর জন্য শাড়ি। আমি মিষ্টি খেয়েছি কয়টা মনে নাই—কিন্তু সেই কাগজে মোড়ানো মিষ্টির ছবি আমার আজো চোখে ভাসে!
তোমায় নিয়ে খেলেছিলাম খেলার ঘরেতে
আমাকে কোলে-পিঠে মানুষ করেছে আমার নানী। নানাকে (নানীকে নানা বলি) ছাড়া আমি থাকতে পারতাম না। একবার নানা কয়েকদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন। আমি কথা বলা একদম বন্ধ করে দিলাম। কোন কথা বলিনি কারো সাথে অনেকদিন। আব্বু-আম্মু অনেক চেষ্টা করেছিল। আসলে আব্বু-আম্মুর সাথে আমার সম্পর্কটা ততটা গাঢ় ছিলনা,যতটা ছিল নানার সাথে। আমার কথা বলা বন্ধ দেখে আম্মু আব্বু সময় করে আমাকে একটা পুতুলের দোকানে নিয়ে গেলেন। এত সুন্দর সুন্দর খেলনা পাওয়া যায় সেটা আমি প্রথম জানলাম। যখন সব পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চারা একটার পর একটা খেলনা নষ্ট করে তখন আমার কোন খেলনা ছিলনা। আমাকে আম্মু বলল,তোমার যেটা পছন্দ হবে সেটা নাও। আমি কিছু বললাম না। কারণ আমার অনেকগুলো পছন্দ হয়েছিল কিন্তু ছোট্ট আমি জানতাম সেই পছন্দের পুতুলগুলো আমার বাবা-মার পক্ষে কিনে দেওয়া সম্ভব না। পরে আম্মু নিজেই একটা পুতুল কিনে দিল। পুতুলের চোখ নীল। মাথার কোঁকড়া কোঁকড়া চুলগুলো লাল। ব্যাটারী দিলে হাঁটতে পারে। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম সেদিন। সবসময় সেই পুতুল নিয়ে ঘুরতাম। আমার নানীর জায়গা মনে হয় কিছুটা হলেও পুতুলটা নিয়ে নিল। পুতুলটা আজো আমার কাছে আছে। আগের মত-ই আছে। শুধু মাথার চুলগুলো পড়ে গেছে। বয়স হয়েছে তো! আমার নানীও এখনো আমার কাছে আছে। ছোট্ট একটা পুতুল হয়ে! সেই আগের মত! শুধু নানার দাঁতগুলো হারিয়ে গেছে।
ভাঁজ খুলে ফেলা রুমাল পেন্সিল বক্সের গল্প
আমি পাঁচ বছর বয়সে ক্লাস ওয়ানে মোহাম্মদ প্রিপারেটরী গালর্স স্কুলে চান্স পেয়ে গেলাম লটারীতে। লটারীর রেজাল্ট জানার পরও অবশ্য বাসায় বেশি আনন্দ হয়নি। কারণ স্কুলে ভর্তির টাকা আব্বু-আম্মু তখনো জোগাড় করতে পারেননি। আমার এক চাচার কাছে ধার চাওয়া হলেও সেই টাকা পাওয়া যায়নি। পরে কিভাবে ভর্তির টাকা জোগাড় হল মনে নাই। তবে টাকা জোগাড় না হলে আমার স্কুলে ভর্তি হওয়া হতনা সেদিন।
স্কুলে আমি এক অন্য পৃথিবীতে এসে পড়লাম। অনেক পিচ্চি পিচ্চি ছেলেমেয়ে,আমি নিজেও পিচ্চি। আমি সবার দিকে বোকা বোকা চোখে তাকাতাম। সবাই চকচকে ব্যাগ আর নতুন খাতা নিয়ে আসত। আমি নিয়ে যেতাম ভাইয়ার রাফ খাতা আর ভাইয়ার পুরোনো লাল ব্যাগ। আমাকে নতুন কিছু কিনে দেওয়ার প্রয়োজন হয়ত ছিলনা,কারণ ছোট ছিলাম—তার চেয়েও বড় ছিল টাকা-পয়সার অভাব। ব্যাগ বা খাতার জন্য আমার কখনো তেমন মন খারাপ হয়নি। কিন্তু আমার খুব লোভ হত একটা সুন্দর পেন্সিল বক্সের। আমার অনেক বন্ধুর আবার দোতালা পেন্সিল বক্স ছিল। তারা সেটাতে পেন্সিল দিয়ে খেলত। তবে আমি বাসায় বলিনি পেন্সিল বক্সের কথা। জানতাম আব্বু-আম্মু কিনে দিতে পারবেনা কিন্তু কষ্ট পাবে। সেই ছোট বয়সেই আমি মনে হয় মনের দিক দিয়ে অনেক বড় হয়ে গেছিলাম। তবে নানাকে চুপিচুপি একদিন বললাম পেন্সিল বক্সের কথা। আমার অদ্ভূত ভালোমানুষ নানী সেদিন-ই রুমাল ভাঁজ করে আমাকে একটা পেন্সিল বক্স বানিয়ে দিলেন ছেলেভুলানো গল্পের মত করে। সেই রুমাল পেন্সিল বক্স আমি ব্যাগে করে নিয়ে যেতাম। লুকিয়ে লুকিয়ে বের করতাম,যাতে কেউ না দেখে। তবে একদিন একটা ছেলে দেখে ফেলল এবং খুব হাসাহাসি করল। আমি সেদিন বাসায় যেয়ে একা একা অনেকক্ষণ কাঁদলাম রুমাল পেন্সিল বক্সটা জড়িয়ে। তারপর রুমালের ভাঁজ খুলে ফেলে চোখের পানি মুছে ফেললাম,কাউকে বুঝতে দিলাম না মন খারাপের কথা। আর কোনদিন সেই রুমালে পেন্সিল নিয়ে স্কুলে যাইনি। ছোটরা অনেক বেশি নিষ্পাপ দেখেই মনে হয় মাঝে মাঝে খুব নিষ্ঠুর হতে পারে!
মন খারাপের বৃষ্টিতে বর্ষাও ভিজে যায়
আমি যখন ক্লাস টু’তে পড়ি তখন একবার একাধারে তুমুল বৃষ্টি হওয়া শুরু করল। আমি আর আমার নানী বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরি। আমাদের বন্ধুদের দেখতাম রেইনকোট পড়ে স্কুলে আসে,রেইনকোট পড়ে বাসায় যায়। রেইনকোট জিনিসটা আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল। পছন্দ হওয়ার কারণ তখন টিভিতে রোবোকপ দেখাত,আমার খুব প্রিয় ছিল রোবোকপ। আর রেইনকোট পরলে কেন জানি সবাইকে রোবোকপ রোবোকপ লাগত। ছোট্ট আমি কোনদিন কোন জিনিসের জন্য আবদার করিনি। কিন্তু রেইনকোট কেনার জন্য আম্মুর কাছে বায়না করে ফেললাম। আম্মু কথা দিলেন সামনের শুক্রবারে কিনে দিবেন। কিন্তু শুক্রবার মনে হয় মাসের শেষ ছিল আর আব্বুর কোন জরুরী কাজ ছিল-তাই আমাকে নিয়ে নিউমার্কেটে রেইনকোট কিনতে যাওয়ার কথা আম্মুর কাছ থেকে শুনে আব্বু খুব রেগে গেলেন আর আমাকে অনেক বেশি বকা দিলেন। আম্মু আমার হয়ে কথা বলায় আম্মু আর আব্বুর ঝগড়া লেগে গেল। সেই শুক্রবারে আর আব্বুর জরুরী কাজেও যাওয়া হলনা। এরপর আম্মু বলেছিল-“থাক তুমি মন খারাপ করোনা,তোমাকে আমি বেতন পেলে পরের মাসে রেইনকোট কিনে দিব”। সেই “পরে” আর কোনদিন আসেনি,আমি ও আর রেইনকোট কিনতে চাইনি। আর কোনদিন আমি রেইনকোট কিনবনা।
বৃষ্টি আমার অসম্ভব প্রিয় জিনিস। আমি বহুবার বৃষ্টিতে ভিজেছি,কারণে-অকারণে। কিন্তু তারপরও বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে যখন রেইনকোট পরা স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দেখি আমার তখন খুব মন খারাপ লাগে। বাচ্চা মেয়েদের মত রেইনকোট পরে পানিতে থপ থপ করে পা ডুবিয়ে হাঁটতে ইচ্ছা করে! আমার মন খারাপের বৃষ্টিতে তখন বর্ষাও ভিজে যায়।
“আব্বু গাড়ি কিনে দিবে”
আমার এক চাচা সেই সময় প্রচুর সম্পত্তি করে ফেলেছিলেন। আমরা মাঝে মাঝে তাঁদের বাসায় বেড়াতে যেতাম এবং আভিজাত্য দেখে মুগ্ধ হতাম। আব্বু আমার চাচার বাসার গ্যারেজে মোটরসাইকেল রাখতেন। মোটরসাইকেল রাখতে গিয়ে একদিন আব্বু দেখলেন সেখানে নতুন কেনা গাড়ি রাখা। আব্বু পরের দিন ভাইয়াকে নিয়ে গেলেন চাচার কেনা নতুন গাড়ি দেখাতে। চাচা ভাইয়া আর আব্বুকে গাড়ির কাছে দেখে কি মনে করে যেন আসলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন,"গাড়ি পছন্দ হয়েছে?” ভাইয়া মনে হয় হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়েছিল। আমার চাচা ভাইয়াকে বলেন,"তোমাকে এরকম একটা গাড়ি কিনে দেই গভঃল্যাবে চান্স পাওয়া উপলক্ষ্যে?” ভাইয়া সেদিন বলেছিল,"না,আমাদের গাড়ি আব্বু কিনে দিবে”। আব্বু সেদিন বাসায় ফিরে এসেছিল চোখে মুখে উজ্জ্বলতা নিয়ে। আম্মুকে বলেছিল,"দেখ আমাদের গাড়ি কেনার সামর্থ্য নাই,তারপরও আমাদের ছেলে অন্যদের দেওয়া গাড়ি নিতে চায়না। বলেছে আব্বু কিনে দিবে। ঠিক আছে,আমার বেটাকে আমি-ই গাড়ি কেন দিব।"
আব্বু ভাইয়াকে দেওয়া কথা রেখেছে সেইদিনের থেকে অনেক বছর পরে। আজ যখন বুয়েটে পড়ুয়া তরুণ ছেলেটা একটা পার্ল রঙ্গের প্রিমিও নিজে ড্রাইভ করে তার আব্বু,আম্মু,নানী আর ছোট বোনকে নিয়ে রাতের উৎসবমুখর ঢাকা দেখার জন্য বের হয় তখন কি ছেলেটার সেই ছোট্টবেলার কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে সে একদিন অনেক অভাব অনটনের মাঝেও রিনরিনে কন্ঠে অথচ দৃপ্ত উচ্চারনে বলেছিল,'আব্বু গাড়ি কিনে দিবে!'?
আমাদের লাল-নীল ছোট্ট সংসার-২
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৩৬