কানা চাচার মুখ ভর্তি আধপাকা চাপ-দাড়ি।মাথা ভর্তি উস্কু-খুস্কু চুল। গায়ে ছেড়া-আধাছেড়া ময়লা পাঞ্জাবী।তিনি একটি বাঁশের লাঠিতে ভর দিয়ে খট খট শব্দে হাঁটতে হাঁটতে এ বাড়ি সে বাড়ি ভিক্ষা করেন। সারাদিন ভিক্ষা করে যা পান তাই ডান কাঁধে রাখা কাপড়ের থলেতে জমান। কানা চাচার বাম চোখটা কানা!কানা মানে একেবারেই কানা,কিছুই দেখেনা।ব্যাপারটা এমন যে তার ডান পাশ দিয়ে যদি একটা পিপঁড়া পির পির করে হেঁটে যায় সেটাও তার নজরে পরে কিন্তু বামপাশে নিঃশব্দে আশা কুকুরও তার নজরে পড়েনা। আর সম্ভবত এজন্যই চালের থলেটাকে কখনও তার বাম কাঁধে ঝুলতে দেখা যায়নি।
কানা চাচা প্রতি বৃহঃস্পতিবার দুপুরে আমাদের বাড়িতে আসে। আমার পড়ার ঘরের সামনে নারিকেল গাছের নীচে দাড়িয়ে ভিক্ষার জন্য হাঁক দেয়।যদি বাড়িতে কেউ থাকে তবে সে সাথে সাথেই ভিক্ষা পেয়ে যায়, না থাকলে অপেক্ষা করতে হয। তখন সে নারিকেল গাছের নীচে মাটিতে বসে থলের আশেপাশের পোঁকামাকড় তাড়ায়! কোন পিপড়া হাঁটতে হাঁটতে থলেটার কাছে এসে গেলে সে ডান হাঁতের বৃদ্ধাঙ্গূলীর নীচে মধ্যমা বাঁকিয়ে এনে ব্যাট দিয়ে বলে আঘাত করার মতো করে পিপড়ার গাঁয়ে আঘাত করে। পিঁপড়াটি তখন গড়াতে গড়াতে কমছে-কম দুই হাত দুরে গিয়ে পড়ে। বেঁচে থাকলে উল্টাদিকে হাটা ধরে আর মরে গেলে তো কথাই নেই!
২০০০ সালের কোন এক বৃহঃস্পতিবার। আমি আমার পড়ার ঘরে। কানা চাচা এসে নারিকেল গাছের নীচে দাড়িয়ে নিয়মমাফিক ভিক্ষার জন্য হাঁক দিয়েছেন। ভিক্ষা আসতে দেরি হওয়ায় তিনি তার বাম পাশে লাঠি আর ডান পাশে হাতের নীচে থলেটা রেখে বসে পড়েছেন। কোন ঘটনা যদি হঠাৎ করে ঘটে সেটা আমাদের নাড়া দেয়, কিন্তু যেটা ঘটতে ঘটতে কমন হয়ে যায় সেটা আর সেভাবে নাড়া দেয়না।যেমন হরতালে ককটেল ফুটানো বা গাড়ি পোড়ানো এখন আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা কিন্তু আগুন দিয়ে বাসে জীবন্ত মানুষ পোড়ানো এখনও আমাদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকে! খুব দ্রুতই হয়তো এটাও স্বাভাবিক হবে, আবার নতুন কিছু আসবে, প্রথম প্রথম সেটা অস্বাভাবিক ঠেকবে, তারপর ধীরে ধীরে সেটাও স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তেমনি কানা চাচার এভাবে বসা,পিপড়া তাড়ানো আমার কাছে একটা অতিপরিচিত ঘটনা।তাই তাকে ভূলে যেতে আমার সময় লাগলোনা।একটু পর পর তার দু-একটা হাঁক আমার পড়ার কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটালোনা।তার আঙ্গুলে টোকায় পিপড়ার সাথে সাথে কিছু ধুলোবালি ওড়ে যাওয়াও আমার নজরে আসলো না।
কিন্তু মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গেল! হঠাৎ করে কানা চাচা ওরে বাবাগো, ওরে মাগো বলে চিৎকার দিয়ে উঠলেন।আমি কানা চাচার দিকে তাঁকালাম! কানা চাচা বাম পা-টা সোজা করে হাঁটুর নিচে দুই হাতে মুঠি করে ধরে বসে আছেন, আর মুঠি করা অংশের নীচের মাংসল অংশ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। রক্তে তার পা,লুঙ্গি এবং মাটি ভিজে যাচ্ছে।
এটি দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম! কানা চাচাকে জিঙ্গেস করে কোন জবাব না পেয়ে আশেপাশে তাকালাম। চাচার বামপাশে পাঁচ হাত দুরে দাড়িয়ে আছে পাশের বাড়ীর চীন মুরগী।মুরগীটির ঠোট রক্তে মাখা।সেই মুরগীর কয়েকটি ছোট ছোট বাচ্চা মাকে কেন্দ্র করে মাটি থেকে ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে খাবার খাচ্ছে।পাশের বাড়ীতে পোষা বিদেশী এই মুরগীটি সম্প্রতি কয়েকটি বাচ্চা দিয়েছে। মা মুরগীর বাচ্চা প্রীতি অনেক বেশী। এত বেশী যে বাচ্চার আশেপাশে কাউকে দেখলেই সে ধাওয়া করে। কোন এক ফাঁকে খাবার খেতে খেতে একটি বাচ্চা এই কানা চাচার বাম পায়ের কাছে এসে গিয়েছিল। আর সেটি স্বাভাবিক কারণেই বাম চোখ কানা,কানা চাচার নজরে পড়েনি। কিন্তু সেটা সন্তানকে চোখে চোখে রাখা মা মুরগির নজর এড়ায়নি। মা মুরগীটি ধারালো ঠোট দিয়ে আঘাত করে কানা চাচার পায়ে! সম্ভবত আঘাতের স্থানটায় চাচার আগেই কোন ঘা ছিল, তাই মা মুরগীর ঠোটটা একটু বেশী গভীরে যায় ফলে রক্ত ঝরার তীব্রতা বাড়ে সেই সাথে বাড়ে চাচার আহাজারীঃ-
“ হে আল্লাহ!আমারে কেন তুমি এক চোখা বানাইলা!দুইটা চোখ কেন্ দিলানা! দুইটা চোখ থাকলে তো আর আমার এই ডাইনি মুরগির ঠোহর খাইতে অয়না!এইভাবে আমার রোগা শরীর থেকে রক্তও ঝরেনা!!”
কানা চাচা মরে গেছেন।কানা চাচা আমার পরিচিত একমাত্র ফিজিক্যাল একচোখা।সেইটা নিয়া কানা চাচার আফসোসও ছিল!আল্লায় কেন তাঁকে দুটি চোখ দিলনা এই আহাজারি তিনি সুযোগ পেলেই করতেন।কিন্তু আজ ১৩ বৎসর পরে আমার দেখা হাজারো মানসিক একচোখা বর্তমান সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে দাপটের সাথে।তাদের দুটি চোখ থাকা সত্ত্বেও ভয়াবহ রকমের একচোখা! তাদের কেউ কেবল ডান চোখে দেকে আবার কেউ বাম চোখে! তাদের এক চোখের ফাঁক দিয়ে পিঁপড়া যেতে না পারলেও অন্য পাশ দিয়ে হাতী সদৃশ প্রাণী দিব্যি চলে যায়!! তারা যা দেখেন তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেশসুদ্ধ সবাইকে দেখান! হতভাগ্য দু-চোখওয়ালাদের সেটা বিশ্বাস না করে উপায়ও থাকেনা কারণ একচোখাদের চোখের পাওয়ার যে অনেক বেশী!!!
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:১০
১. ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ২:০৮ ০