০৮ ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস । এ দিবসটিকে মাথায় রেখে সবচেয়ে ভালো বাক্য হতে পারেঃ
সাম্যের গান গাই- আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই! বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
আমাদের সামাজিক , রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে নারীর ক্ষমতায়ন , সুশিক্ষা নিশ্চিতকরণ , নারীর সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে ! নারী কখনো মা , কখনো বোন , কখনো স্ত্রী হিসেবেই কেবল নয় আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থায় বৈশ্বিক উন্নয়ন এর ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রতিযোগীতায় ধরে রাখতে নারীদের ভূমিকা উল্লেখ করার মত ।
কিভাবে আসলো নারী দিবস ?
বিশ্বব্যাপি এই দিবসটি পালনের পেছনে রয়েছে এক অনন্য ইতিহাস । ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে একটি সূচ কারখানার মহিলা শ্রমিকগণ কর্মক্ষেত্রে মানবেতর জীবন ও ১২ ঘন্টা কর্মদিবসের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। তাদের উপর নেমে আসে পুলিশি নির্যাতন । ১৮৬০ সালে ঐ কারাখানার মহিলা শ্রমিকেরা ‘‘মহিলা শ্রমিক ইউনিয়ন’’ গঠন করেন আর সাংগঠনিক ভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন । তারপর ১৯১০ সালের ৮ মার্চ কোপেনহেগেন শহরে অনুষ্ঠিত এক আর্ন্তজাতিক নারী সম্মেলনে জার্মানির মহিলা নেত্রী কারা জেটকিন ৮ মার্চকে ‘‘আর্ন্তজাতিক নারী দিবস’’ঘোষণা করেছিলেন। ১৯১১ সালে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ৮ মার্চ ‘‘আর্ন্তজাতিক নারী দিবস’’পালন করা হয়। ১৯৮৫ সালে ৮ মার্চকেও জাতিসংঘ আর্ন্তজাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মত ১৯৯১ সালে এই দিবসটি পালন করা হয় । এই বছর বাংলাদেশে নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে 'অগ্রগতির মূল কথা-নারী-পুরুষ সমতা।’
আমাদের সামাজিক বলয়ের বাইরে আমাদের অর্থনীতিতে নারীদের ভূমিকার কথা বলতে গেলে গর্ব করার মত একটা জায়গা তৈরী হচ্ছে । লন্ডনভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের করা সমৃদ্ধির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৩ যেখানে প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ১০৬ । নারী-পুরুষ ক্ষমতার সমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ১১ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ । ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ২০১৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ১৩৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫। ২০১২ সালে এ অবস্থান ছিল ৮৬।
সার্কভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। শ্রীলঙ্কা ৫৫তম অবস্থান নিয়ে প্রথম অবস্থানে ।
আমাদের সমৃদ্ধির সূচক এবং নারী-পুরুষ ক্ষমতার সমতা এই দুটি সূচকের পারস্পরিক অবস্থান বিচার করলেই আমাদের অর্থনীতিতে নারীদের গুরুত্ব অনুধাবনা করা যায় । বিগত বছরগুলোতে আমাদের অর্থনীতির একটা বড় অংশ এসেছে তৈরী পোশাক খাত থেকে । যেখানে ৮০% সূচকর্মী নারী , স্বল্প বেতনে আমাদের অর্থনীতিতে এ অবদান অনস্বীকার্য । বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে নারীরা , মহিলা আইনজীবির সংখ্যা বেড়েছে , ডাক্তারের সংখ্যা বেড়েছে । এটা শুধুমাত্র সম্ভাবনার একটা বীজ মাত্র , উন্নত দেশসমূহে যার সংখ্যাটা আরো অনেক বেশী । সব ধরনের পেশাতে নারীদের অংশগ্রহন দেশের সমৃদ্ধির জন্য কাজে লাগানো উচিৎ । আগে শুধুমাত্র যারা কৃষিকাজে সাহায্য করতো রাষ্ট্রীয় সূচকে যার কোন প্রভাব পড়তোনা , সেই নারীরাই যখন এখন সূচকর্মী হিসেবে কাজ করছে তার ফলাফল ই উন্নয়নের সূচকে আমাদের এগিয়ে যাওয়া ।
এই অগ্রযাত্রা আরো বেগবান করা সম্ভব শুধুমাত্র সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমেই । ঐতিহাসিক ভাবেই আমাদের সমাজ ব্যাবস্থায় নারীরা ঘরে – বাইরে নানা বৈষম্যের স্বীকার । পারিবারিকনারী নির্যাতন শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা , নারী শিক্ষার প্রসার নিশ্চিত করা , ধর্ষনের দ্রুত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের কাজ শুরু করা যায় । এতসব অর্জন ম্লান হয়ে যায় দেশব্যাপী নারী নির্যাতন , ২ বছরের কন্যা শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধার ধর্ষনের খবরে , ফতোয়া বাজদের ফতোয়ার শিকার গৃহবধূর নির্যারনের খবরে । সামাজিক ভাবে আমরা অসাম্প্রদায়িক । ধর্মীয় গোঁড়ামি যেমন ধর্মের জন্য ক্ষতিকর একই ভাবে ক্ষতিকর দেশের সামাজিক অবক্ষয় আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের । মাঝে মাঝেই দেখা যায় নারী নির্যাতনের পেছনের যুক্তি ধর্মীয় ভুল ব্যাখা । যেখানে ঘটছে দোররা মারার মত মধ্যযুগীয় নির্যাতনের ঘটনা সেখানে অনেকের খারাপ লাগা স্বত্বেও প্রতিবাদ করতে পারছেনা কেননা এর পেছনে রয়েছে ধর্মীয় ব্যাখ্যার অপব্যাবহার আর আমাদের জনগণ ধর্মভীরু ! নারীশিক্ষার প্রসার , সামাজিকভাবে নারী-পুরুষের সম অধিকার , রাষ্টীয় ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান আমাদের অগ্রযাত্রাকে আরো তরান্বিত করতে পারে । কারো মা , কারো বোন , কারো স্ত্রী হিসেবে নারী যেমন ব্যাক্তি জীবনে অবদান রাখতে পারে সামাজিক এবং রাষ্টীয় উন্নয়নে ও তেমনি অবদান রাখতে পারে সে সম্ভাবনা ইতিমধ্যে জাগ্রত হয়েছে !
রাজনীতির সুষ্টু এবং প্রগতিশীল উন্নয়নের মাধ্যমেই সম্ভব সামাজিক ভাবে সবাইকে সচেতন করা । তাই এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্যটি আবার সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই
“অগ্রগতির মূল কথা-নারী-পুরুষ সমতা।’“
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ৩:৩০