ইউনির মাসিক পত্রিকায় টুকরো প্রবন্ধটা পড়ে বেশ মজা পেলাম, তাই শেয়ার করতে আসলাম। লেখক যেই প্রশ্ন নিয়ে ভেবেছেন তা হলো, 'পলিটিক্যাল স্যাটায়ার বা বিদ্রুপাত্মক রাজনৈতিক রম্য সব সময় বামপন্থীরা লিখে কেন?' আমারও প্রশ্ন ছিল এরকম। অস্ট্রেলিয়ায় বেশ নাম করছে এবিসি টিভির স্যাটায়ার 'চেইসার'। বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে সব কিছু নিয়ে তাদের হাসাহাসি। কিছুদিন আগে প্রাদেশিক নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনের আগ দিয়ে সব প্রার্থীদেরই প্রোফাইল বিশ্লেষন হচ্ছিল.. যেমনটা হয়। ব্যক্তিগত জীবন থেকে সব কিছু। পিটার ডেবনামের (লিবারেল পার্টির পরজিত প্রার্থী) ক্ষেত্রে আবিষ্কৃত হয়েছিল, ভদ্রলোক প্রতিদিন আন্ডারওয়্যার পড়ে সার্ফ করে। 'চেইসারের' লোকগুলো তাই আন্ডারওয়ার পড়ে গেল ডেবনামের সাথে সাক্ষাৎকার নিতে, নির্বাচনী প্রচারণার মধ্যেই!
প্রতি সপ্তাহে এরকম অদ্ভূত ডেয়ারিং সব কান্ড কারখানা করে। চেইসারের প্রডিউসাররা সব আইনবিদ, কম বয়সী ছেলে। পঁচিশ থেকে তিরিশ হবে বয়স। কথায় তীরটা মারাত্মক তীক্ষ, লাগে নির্ঘাত!
ওদের কথাবার্তা খুবই বাম ঘেষা। স্টাইলটা বাম ঘেষা। বামপন্থীদের একটা চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য হলো, কিছুর ব্যাপারেই 'কেয়ার' না করা। নির্দিষ্ট কিছু পবিত্র বলে থাকতে পারবে না, ধর্ম হোক, আর যাই হোক। যেখানেই কোন ফাঁক পাওয়া যাবে তাই নিয়ে রুথলেস স্যাটায়ার। মানুষ তাতে কেঁদে মরুক কি গুলি করুক, তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। এই 'কিচ্ছু কেয়ার করি না' ডেয়ারিং ভাবের সাহসিকতার জন্যই ওদের পলিটিক্যাল রম্যগুলো সত্যিকারের রম্য হয়ে উঠে।
সারাবিশ্বে যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ভুল ধারণা, মুসলিমদের কোণঠাসা অবস্থা, মিডিয়া মাত্রই মুসলিমদের সামান্য বিচ্যুতি ফুলিয়ে ফাপিয়ে তুলে ধরতে পছন্দ করে, তখন এই চেইসারই মুসলিমদের পাশে দাঁড়ায়। তাদের এই বাড়াবাড়িটা নিয়েই হুল ফুঁটানো রম্য করে।
তাই বলে অবস্থানটা কিন্তু মুসলিমদের পক্ষে না। মুসলিমরা যখন কোণঠাসা অবস্থায় থাকে না, তখন কিন্তু মুসলিমদের নিয়েই রম্য হয়।
বামপন্থী রম্য স্রষ্টাদের বৈশিষ্ট্য এটাই, প্রচলিত সব কিছুর উল্টা চলা। সমস্ত খুঁত বড় করে ধরে সেটা নিয়ে রুথলেস হাসাহাসি করা।
প্রশ্ন উঠেছিল, এর প্রধান কারণ কি বিগদ দশকে অস্ট্রেলিয়ায় ক্ষমতায় কেবল ডানপন্থীরা ছিল তাই? বামপন্থীরা ক্ষমতায় এলে কি তবে ডানপন্থীরা পলিটিক্যাল রম্য বানাবে?
আসলে সেটা হয় না। বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। আওয়ামী ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে সবাই প্রথম আলোর ব্যাপারে দারুণ খুশি ছিল। আওয়ামী লীগকে ছেড়ে কথা বলে না, তাই। অথচ প্রথম আলো বাম ঘেষা। একটা রাজনৈতিক দলও যদি থাকে যা বামদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, তবে তা হলো আওয়ামী লীগ। তাই আওয়ামী লীগকেও যখন ছেড়ে কথা বলে না তখন সবাই দারুণ খুশি হয়েছিল।
বিএনপি শাসনামলে প্রথম আলোর কথা শুনে একই মানুষগুলোই অনেক সময় বলেছে, আওয়ামী লীগের নগ্ন সমর্থন করছে।
আসলে ঘটনা তা না। নিজেদের আদর্শিক অবস্থান... যা হচ্ছে সব সময় সরকার এবং প্রতিষ্ঠিত যে কোন সিস্টেম এবং ব্যক্তির খুঁত খুঁজে বের করে তার বিরোধিতা করা, তা অব্যাহত ছিল। আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় থাকা কালীন সময়েও তারা একই কাজ করেছেন।
তবে, এখানে একটা পাথর্ক্য আছে।
ডানপন্থীরা ক্ষমতায় থাকলে স্যাটায়ারটা হয় বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কিন্তু বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকলে স্যাটায়ার কিন্তু মোটেও ডানপন্থী অবস্থান থেকে হয় না!
বরং বাম সমালোচকরা তখন আরেকটু বামে সরে যান এবং "আরেকটু বেশি বাম" অব্স্থান থেকে রম্য চালালেন।
অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসেও তাই দেখা গিয়েছে। ডানপন্থীরা সব সময় আলোচনার কথা বলে, একে অন্যের প্রতি ভুল ধারণা ভেঙে যাবে আলোচনার মাধ্যমে, বিরোধীপক্ষের সাথে কথা বললে তাকে সরিয়ে আনা সম্ভব এই রকম একটা ধারণা নিয়ে থাকে এবং কাজ করে। টিভিতে তাই ডানপন্থীদের পক্ষ থেকে সরকারের সমালোচনা করে কাজ মানে 'টক শো' জাতীয় আলোচনা সভা! অথচ এই রকম প্রচারণাগুলো কখনও ঝাঁকি সৃষ্টি করতে পারে না! কে শুনতে চায় আলোচনার পর আলোচনা, হাসাহাসি করে অপর পক্ষের খুঁত বের করা বেশ মজার আসলে।
কম বয়সী শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বামপন্থী সমালোচনার রুথলেস পন্থা আর ধারাটা পছন্দ করে। আর সবাইকে নিচে নামানো আসলে বেশ মজার, কারণ কাজটা অপেক্ষাকৃত সোজা! আমরা মানুষকে নিচে দেখতে ভালোবাসি! তাই ইন্টেলেকচুয়াল মিডিয়ার দখল থাকে এই চাকচিক্যের, সরকার ডানপন্থীর হোক কি বামপন্থীর।
মানুষ মাত্রই প্রচন্ড ভুলে ভরা। তাই খুঁত বের করতে চাইলেই সব সময় করা যাবে। সেটা নিয়ে হাসাহাসি করা যাবে। জন হাওয়ার্ড, অস্ট্রেলিয়ার প্রধান মন্ত্রী বেচারার ভুরু জন্মসূত্রে বিচ্ছিরি রকমের মোটা। অন্তত: তিন আঙ্গুল চওড়া তো হবেই। সে সার্জারি পর্যন্ত করেছে, কিন্তু তবু খুব বেশি কমে নি। বামপন্থী মিডিয়া জন হাওয়ার্ডের ভুরু বা পেঙ্গুইনের মত দুলে দুলে হাঁটা নিয়ে রম্য করতে বেশ মজা পায়। আমি যদিও ভদ্রলোককে সহ্য করতে পারি না, এই ব্যাপারটা ঠিক মানতে পারি না। আহারে, চেহারার উপর কি কারও হাত আছে?
অথচ বাম রম্যের ধারাটাই এই রকম, চেহারা থেকে শুরু করে যাবতীয় যা আছে, সামান্য কিছুকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে যদি জনগণ যাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখছে তার থেকে দূরে সরানো যায়... একটাই মূলনীতি: দেয়ার শুড নট বি এনিথিং সেইকরেড!
মূলনীতিটার সাথেই আমি কখনও একমত হতে পারলাম না!