সারা বিশ্ব জুড়ে জ্ঞানী গুণী, কুতুব, আর পণ্ডিতে থিক থিক করছে - কেউ কারো কথা শুনতে চায় না, সবাই বলতে চায়। বাইরে যতই ভেক ধরুক না কেন, মোটামুটি সবাই নিজেকে সর্বোচ্চ লেভেলের জ্ঞানী ভাবতে পছন্দ করে। ভয়াবহ এই রোগে পুরো মানবজাতি আক্রান্ত - আমিও তার ব্যতিক্রম নই।
রহস্যময় মহাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত
একদল প্রাণের রহস্যের মূলে জেনে বসে আছে, একদল মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য ঠিকঠাক জেনে গেছে, কেউ কেউ ব্ল্যাক হোলের মাঝখানে বসে নিয়মিত আপডেট দিচ্ছে। হাজার আলোকবর্ষ এখন তুড়ির খেল, গ্যালাক্সির চেয়ে মহাবিশ্ব নিয়ে আলোচনা চলছে কত মিলিয়ন ইউনিভার্স আছে সেই নিয়ে। চিলির সাগরের নিচে শতাধিক নতুন সামুদ্রিক প্রাণী আবিষ্কার নিয়ে আরেক দল হুলস্থুল করছে - বিশেষ প্রজাতির মাছ যে পানির নিচে হাঁটে, তা দেখে তারা অবাক।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা তাদের মত চিকিৎসা শাস্ত্র বোঝাচ্ছে - আমরা দ্বার্থহীনভাবে বিশ্বাস করে তর্ক জুড়ে দিচ্ছি। ভাষাবিদেরা তাদের মত করে ভাষা শাস্ত্র বোঝাচ্ছে - আমরা তা ধ্যানে, মনে, জ্ঞানে বিশ্বাস করে জান কাবার করে দিচ্ছি। ধর্মীয় নেতারা আমাদের ধর্মশাস্ত্র বোঝাচ্ছে - আমরা দুনিয়ার আরাম আয়েশ ছেড়ে ত্যাগের পথ বেছে নিচ্ছি। রাজনীতিবিদেরা জাতীয়তাবাদ শেখাচ্ছে - আমরা দেশকে ভালোবেসে জান কোরবান করছি।
ইউক্রেনের নাগরিক জানে না তারা কী জন্য দেশহারা হয়েছে আর কী জন্য মরছে। রাশিয়ার নাগরিক জানে না তারা কী জন্য নিজের ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। বার্মায় একই অবস্থা! গাজার মানুষেরও সেই অবস্থা যেমন ইসরায়েলিদের, ওদেরও রাতের ঘুম হারাম।
মানুষের সীমাবদ্ধতা এবং অগ্রগতি
মানুষ সর্বোচ্চ সাড়ে বারো কিলোমিটার নিজের পায়ের নিচের মাটির নিচে সুরঙ্গ খুঁড়তে পেরেছে - তাও সুদীর্ঘ তিরিশ বছরে তিনবার ফেল মেরেছে। কিন্তু মাটির নিচে যেতে না পারলে কি হবে, উপরের দিকে মানুষ কিন্তু এগিয়ে গেছে দুর্দমনীয়ভাবে; এর মাঝে চাঁদে কয়েকবার মানুষ নেমেছে। মঙ্গলে সত্তরের দশকে যে যাত্রা গুটি গুটি পায়ে শুরু করেছিল ভাইকিং, সেটার পূর্ণতা পেয়েছে: In the meantime, NASA's Mars Global Surveyor (MGS) left Earth on Nov. 7, 1996। মানুষের সৌরজগতের বাইরে জানার অদম্য আগ্রহের প্রচেষ্টার শুরুর Voyager মিশন: Feb 17, 1998: Became the most distant human-made object after overtaking NASA's Pioneer 10। কিন্তু ওই তিনবার মাটি খুঁড়ে ফেল মেরে অর্থাভাবে না কি ভয়ে আর কখনো ওমুখো হয়নি।
কোলা সুপারডিপ বোরহোলের অভিজ্ঞতা
কোলা সুপারডিপ বোরহোল: যদিও গবেষণা প্রক্রিয়া পৃথিবীর অভ্যন্তর সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য পেয়েছিল, ফলাফলগুলি অনেকাংশে অপ্রত্যাশিত ছিল, এবং তাদের ভিত্তিতে পৃথিবীর আবরণের প্রকৃতি এবং মোহোরোভিবিক পৃষ্ঠের সারাংশ সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না।
পাঁচ কিলোমিটার গভীরতায় তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে, সাত কিলোমিটারে - ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এবং ১২ কিলোমিটার গভীরতায় সেন্সরগুলি ২১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করেছে। ১৫ কিলোমিটার গভীরে তাপমাত্রা এত বেশি যে সেখানে মানুষ্য নির্মিত আর কোনো ড্রিল মেশিন কাজ করার কথা নয়। বিজ্ঞানীদের জন্য, এই কূপ থেকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় আবিষ্কারগুলির মধ্যে একটি হল যে গ্রানাইট থেকে ব্যাসাল্টে কোনো রূপান্তর প্রায় সাত কিলোমিটার (৪.৩ মাইল) গভীরতায় পাওয়া যায়নি। এই গভীরতায় কঠিন শিলার নিচে জল পরিপূর্ণ ছিল, যা আশ্চর্যজনক ছিল। এই জল, ভূপৃষ্ঠের জলের ঠিক বিপরীতে থেকে, গভীর ভূত্বকের খনিজ থেকে এসেছে যা পাথরের একটি অভেদ্য স্তরের কারণে পৃষ্ঠে পৌঁছাতে অক্ষম ছিল।
গভীর গবেষণার চমকপ্রদ আবিষ্কার
ভূপৃষ্ঠের ছয় কিলোমিটার (৩.৭ মাইল) নিচে মাইক্রোস্কোপিক প্লাঙ্কটন জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। আরেকটি অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার ছিল প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেন গ্যাস। গর্ত থেকে প্রবাহিত ড্রিলিং কাদার সাথে প্রচুর হাইড্রোজেন গ্যাস বের হয়ে আসছিল - যা উষ্ণ প্রস্রবণের মতো "ফুটন্ত" অবস্থায় চারদিকে তীব্রবেগে ছড়িয়ে পড়ছিল। ধারণা করা হয় যে ভূপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীর কোরের দূরত্ব ২৮৯০ কিলোমিটার গভীরে। যদিও গর্তটি ৭.৫ মাইল গভীর, এটি আসলে পৃথিবীর মূলের খুব কাছাকাছি আসেনি। অনুমান সাপেক্ষে ধারণা করা হয় যা, কোলা সুপারদীপ বোরহোল গ্রহের ভূত্বকের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র ০.২ শতাংশ পথ পেতে সক্ষম হয়েছে। ১২ কিলোমিটার গভীরে প্রবেশ করেই এত আশ্চর্যজনক আবিষ্কার হয়ে গেছে, বাকি ২৮৭৮ কিলোমিটারে কি আছে এটার সঠিক তথ্য দেবার মুরোদ কারো আছে?
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি
তবু বিজ্ঞানের কাছে আমরা প্রতিনিয়ত চরমভাবে ঋণী। মানুষের ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে অসীমকে জয় করার দুর্দান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে এবং থাকবে। প্রতিদিন একটু একটু করে অসীম ভাবনাকে জয় করছে মানুষ - গত এক শতাব্দীতে বিজ্ঞান এক লাফে যেন কয়েক মিলিয়ন যুগ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে।
~ চিলির আতাকামায় রোভার মহাকাশযানের পরিক্ষা চলছে।
ভবিষ্যৎ এবং অনিশ্চয়তা
বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির এত অগ্রগতি সত্ত্বেও, আমরা এখনও অনেক অজানার মুখোমুখি। চিলির আতাকামায় রোভার মহাকাশযানের পরীক্ষা চলছে। 'অতি সম্প্রতি, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে যে ব্যাকটেরিয়া মহাকাশে বেঁচে থাকতে পারে। কিছু বিজ্ঞানী সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, মঙ্গলে পাঠানো মহাকাশ যানের সাথে পৃথিবী বা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে কোনো অনুজীব চলে যেতে পারে মঙ্গলে। বিজ্ঞানীরা সেটাই উল্টো মঙ্গলের অনুজীব মনে করে একটা ভয়ঙ্কর ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেলতে পারেন। ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে, চিলির আতাকামা মরুভূমিতে অপরিচিত অণুজীবের একটি "অন্ধকার মাইক্রোবায়োম" (ইংরেজিতে 'ডার্ক মাইক্রোনায়াম' এর সন্ধান পাওয়া গেছে, পৃথিবীর সেই অংশটুকুর পরিবেশ ঠিক মঙ্গল গ্রহের মতো।'
মহাকাশ বিজ্ঞান এবং ডার্ক মাইক্রোবায়াম
ডার্ক ম্যাটারের গল্প অনেক হয়েছে। যে ম্যাটারের অস্তিত্ব শুধু ধারণা করা যায় কিন্তু কোনোভাবেই প্রমাণ করা যায় না। 'ডার্ক মাইক্রোবায়াম' এর কাছাকাছি কিছু একটা কিন্তু এর অস্তিত্ব সম্ভবত প্রমাণ করা যায় তবে ব্যাস ওই পর্যন্ত! এখনো পর্যন্ত মঙ্গলে যতগুলো মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে, মঙ্গল চষে বেড়ে সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি নেই সেটা খুঁজে দেখার জন্য তার কোনোটা
তেই সেই প্রযুক্তি নেই যে ডার্ক মাইক্রোবায়ামের মতো অনুজীব শনাক্ত করবে। তার মানে ২০২২ সালে যেসব জীববিজ্ঞানীরা পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন, তারা এমন দুটো অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য না জেনেই আরো কত শত ভুল তথ্য জেনে বিদায় নিয়েছেন।'
উপসংহার
[আতাকামা মরুভূমির চিরশুষ্ক এই স্থানেই 'ডার্ক মাইক্রোবায়াম' বা 'রহস্যময় অনুজীবের' সন্ধান পাওয়া গেছে। (২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে)]
~ আতাকামা মরুভুমির চিরশুস্ক এই স্থানেই 'ডার্ক মাইক্রোবায়াম' বা 'রহস্যময় অনুজীবের' সন্ধান পাওয়া গেছে। (২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে)
(চিলির 'আতাকামা' মরুভূমিকে মঙ্গল গ্রহের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এর অন্য জাগতিক চেহারার কারণে, আতাকামাকে মঙ্গলগ্রহের দৃশ্যের চিত্রগ্রহণের স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, বিশেষ করে টেলিভিশন সিরিজ স্পেস ওডিসি: ভয়েজ টু দ্য প্ল্যানেটে। ২০০৩ সালে, গবেষকদের একটি দল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যেখানে তারা ভাইকিং ১ এবং ভাইকিং ২ ল্যান্ডারদের দ্বারা জীবন শনাক্তকরণ পরীক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালায় এবং সেই মরুভূমির মাটিতে কোনো জীবনের লক্ষণ শনাক্ত করতে সক্ষম হয় নি। ধারণা করা হয় এই ক্ষেত্রে অঞ্চলটি সম্ভবত পৃথিবীতে অনন্য এবং মঙ্গল গ্রহে ভবিষ্যতের মিশনের জন্য যন্ত্র পরীক্ষা করার জন্য NASA দ্বারা ব্যবহৃত হয়। ২০০৮ সালে, ফিনিক্স মার্স ল্যান্ডার মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠে পার্ক্লোরেট শনাক্ত করেছিল, যেখানে প্রথম জল আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই ধরণের পার্ক্লোরেট আতাকামাতেও পাওয়া যায় যার সাথে সংশ্লিষ্ট জৈব উপাদান ও নাইট্রেট জমা রয়েছে, যা মাধ্যমে ধারণা করা হয় দেয় যে মঙ্গল গ্রহে জীবনের লক্ষণ অস্পষ্ট হলেও একেবারে অমূলক নয়। এখন অন্য এক সমস্যায় পড়েছে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা - সত্যিই যদি 'ডার্ক মাইক্রোবায়ামের মতো তেমন কোনো রহস্যময় অনুজীব থেকে থাকে মঙ্গল গ্রহে তবে ওখানে পাঠানো কোনো যান সেটা শনাক্ত করতে পারবে না - অবশ্যই মঙ্গলের মাটি পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে এসে রিসার্চ করতে হবে। তাহলে উপায়?? যেগুলো গিয়েছে চলে সেগুলোর তো ফিরিয়ে আনার আপাতত রাস্তা নেই। অতএব মঙ্গলে জীবন আছে কি নেই সেজন্য নিদেনপক্ষে দশ/বিশ বছর আরো অপেক্ষা করতে হবে।)
ব্যক্তিগত উপলব্ধি
[প্রিয় ব্লগার: মহাকাশ বিজ্ঞান, মাইক্রোবায়োলজি - এসব আমার জন্য অতীব কঠিন একটি বিষয়। যেগুলো আমি বুঝি না, তার উপযুক্ত অর্থ করা কঠিন। দেড় বছর ধরে অপেক্ষা করছি। ব্লগ তো বটেই ফেসবুকেও কেউ কিছু এই নিয়ে লিখছে না দেখে শুরুটা করলাম। এই বিষয়ে ভালো কারো ধারণা থাকলে অবশ্যই লিখবেন। শুরুটা করলাম আমি শুধু আমার স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে। আমার অজ্ঞতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:১৪