সোমালিয়ান পাইরেটরা পরিস্থিতির শিকার না রবিন হুড আমি সেই বিতর্কে যাব না। পেশাগত কারণে তারা আমাদের প্রতিপক্ষ। গত পর্বে প্রতিরোধের কিছু উপায় নিয়ে লিখেছিলাম । এটা তার ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় পর্ব। দ্বিতীয় পর্বটা আমি একটু ভিন্ন ভাবে লিখতে চাই। প্রথম পর্বে করা অনেকের প্রশ্ন এবং তার উত্তর দিয়ে এই পর্বটা সাজালাম।
এত প্রতিরোধের ব্যবস্থা করার পরও কিভাবে পাইরেটরা জাহাজে উঠে ?
সোমালিয়ান পাইরেটরা প্রথম দিকে ডেস্পারেট ছিল না। তারা সুযোগ বুঝে হুট করে একটা জাহাজে আক্রমণ করত। দূর থেকে একটি জাহাজকে লক্ষ্য রাখত । যদি মনে করত জাহাজের ডেক অফিসার এবং ক্রু তেমন সতর্ক নয়। সেই সব জাহাজে পিছন দিক দিয়ে হটাত করে আক্রমণ করে বসত। একটি জাহাজে সাধারণত হাজার কোটি টাকার কার্গো থাকে। সেই সাথে আমদানি কারক, রফতানি কারক , ব্যাংক , বীমা , শিপের মালিকসহ অনেক পক্ষ জড়িত থাকে।প্রথম দিকে এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করা হলেও ধীরে ধীরে জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়তে থাকে। তখন জাহাজ মালিকরা সহ সবাই খুব সতর্ক হয়ে যায়। ঐ অঞ্চল দিয়ে যাতায়াত করে এমন জাহাজে কি ব্যবস্থা নেয়া যায় এমন একটা গাইড লাইন তৈরি করে দেয়।প্রথম দিকে দেখা যত প্রায় বেশির ভাগ জাহাজেই গাইড লাইন অনুসরণ করা হত না। ফলে পাইরেটরা অনায়েসে ছিনতাই চালিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি এখনও অনেক কোম্পানির জাহাজে এসব গাইড লাইন ফলো করা হয় না।
পাইরেসির পিছনে আসলে কারা ? সোমালিয়ানরা নাকি ওদের নামে অন্য কেউ ?
ছিনতাই বেড়ে যাবার সাথে সাথে সব কর্তৃপক্ষ কঠোর হওয়া শুরু করে এবং বেশির ভাগ জাহাজ গাইড লাইন মেনে চলতে শুরু করে। কিন্তু ততদিনে এই ছিনতাই ব্যবসাটা অনেকের কাছেই খুব লাভজনক হয়ে উঠে। ছিনতাইকারী চক্রের সাথে যোগ হয় আন্তর্জাতিক চক্রের। তারা ছিনতাইকারীদের আধুনিক অস্ত্র , হাইস্পিড বোট , অত্যাধুনিক যোগাযোগের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে । তাদের ট্রেনিং দেয় । অনেক সময় জাহাজ সম্পর্কে আগাম তথ্য সরবারহ করে। বিনিময়ে মুক্তিপণের বড় একটা অংশ তারা হাতিয়ে নেয়।
এখানে আপনাদের কিছু মজার তথ্য দেই। মুক্তিপণের বেশির ভাগ টাকা লেনদেন হয় ইংল্যান্ডে। গোপনীয়তা রক্ষা এবং সার্ভিস চার্জ হিসাবে তারা প্রায় ৩০ ভাগ টাকা রেখে দেয় এমন কথা শোনা যায়।
পশ্চিমা দেশে কিছু এজেন্সি রয়েছে যারা জাহাজ ছিনতাই ঘটনায় মধ্যস্থতা করে। মধ্যস্থতা মানে কত টাকা মুক্তিপণ হবে, কিভাবে টাকা দেয়া হবে ইত্যাদি। তারাও বড় একটা অংশ পায়। টাকা নিরাপদে পৌঁছে দেবার জন্যও রয়েছে এজেন্সি। এমনকি একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির জাহাজ ছিনতাইকারী ধরবে না এই গ্যারান্টি দিয়ে অনেক এজেন্সি মাসিক বা জাহাজ প্রতি নির্দিষ্ট অংকের টাকাও নিয়ে থাকে!!
আন্তর্জাতিক মহল পাইরেসি প্রতিরোধে হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠল কেন ?
পাইরেটরা অস্ত্র এবং ট্রেনিং পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠে। অস্ত্রের গরমে অনেক নাবিক হত্যা করা শুরু করে। তখন একটা নতুন সমস্যা শুরু হয়। তারা এখন আর যে কোন জাহাজ নয় বেছে বেছে কেমিকাল এবং ট্যাংকার জাহাজ আক্রমণ শুরু করে। এইসব জাহাজ আক্রমণের জন্য সুবিধা অনেক। কাঠামোগত কারণে খুব সহজেই এইসব জাহাজে উঠা যায়। আর যেহেতু জাহাজ গুলো বিস্ফোরক কার্গো বহন করে। অল্প কিছু গোলাগুলি করলেই এসব জাহাজ থেমে যেতে বাধ্য হয় ।
পাইরেসির এলাকাও দিনে দিনে বাড়তে থাকে । গালফ অফ এডেন ছাড়িয়ে ইন্ডিয়ান ওশেন, এরাবিয়ান সি(Sea) সহ মাদাগাস্কার এর বিশাল এরিয়া জুড়ে শুরু হয় পাইরেসি।ফলে সারা বিশ্বে জাহাজ পরিবহণ বিশেষ করে তেলের বাজার অস্থির হয়ে উঠে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল পাইরেটরা প্রথম দিকে ইউরোপ/আমেরিকার জাহাজ গুলোকে এড়িয়ে চলত। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল চায়না, জাপান, কোরিয়া এবং ভারতসহ এশিয়ান দেশ গুলো। কিন্তু পরে এত পাইরেট গ্রুপ তৈরি হয় যা কল্পনাতীত এবং তারা বিচ্ছিন্ন ভাবে হামলা শুরু করে। এরকম একটা অপারেশনে আমেরিকান চারজন নাবিক এবং ফ্রান্সের একটি ইয়োট এর কিছু নাবিক নিহত হয়।
পাইরেসি রোধে বিভিন্ন দেশের নেভাল ফোর্স ?
এইসব ঘটনার পর পাইরসির রোধে প্রথম বারের মত জাতিসংজ্ঞ বিদেশী নৌবাহিনীর পাহারা এবং নৌ/ আকাশ পথে আক্রমণের অনুমতি দেয়। তবে এর আগেই নিজেদের দেশের জাহাজ এবং নাবিকদের নিরাপ্তার কারন দেখিয়ে চীন, জাপান , কোরিয়া , ইন্ডিয়া , রাশিয়া তাদের নৌবাহিনীর তৎপরতা শুরু করে দেয়।বর্তমানে ২২ টি দেশের ৩০ টি নৌবাহিনীর জাহাজ এবং হেলিকপ্টার এই এলাকা নিয়মিত টহল দিচ্ছে । সবাই বিচ্ছিন্ন ভাবে টহল না দিয়ে একটা গ্রুপ করে কাজ করছে যা কোয়ালিশন ফোর্স নামে পরিচিত। কোয়ালিশন ফোর্সের মধ্যে কোরিয়া , ইন্ডিয়া , রাশিয়া বেশ আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে পাইরেসি দমন চেষ্টা চালায়। দেখা মাত্র গুলি এবং হেলিকপ্টার দিয়ে পাইরেট বোট ধ্বংস শুরু করে। পাল্টা জবাব হিসাবে পাইরেটরা জিম্মি(নাবিকদের) হত্যা শুরু করে। পূর্বে জিম্মিদের জাহাজেই রাখা হত । কিন্তু ব্যাপক ধর পাকড় শুরু হবার পর পাইরেটরা কিছু নাবিকদের সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যাওয়া শুরু করল। মুক্তিপণের টাকা দেয়ার পরও কিছু নাবিকদের জিম্মায় রেখে দেয়া শুরু করে। বিশেষ করে ইন্ডিয়ান নাবিকদের।
নাবিক, জাহাজ মালিক এবং বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ মুখোমুখি ঃ নাবিক হত্যা শুরু হবার পর আমাদের তরফ থেকে জাহাজ মালিকদের উপর চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে । হয় আমাদের আর্মস দাও অথবা আর্মস গার্ড । কিন্তু বিভিন্ন সরকার এর প্রবাল বিরোধিতা শুরু করে। তাদের সাথে যোগ দেয় আন্ত্রজাতিক বিভিন্ন সংস্থা । শেষ পর্যন্ত কি হল জানতে আগামী পর্ব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আজ এর চেয়ে বেশি লিখতে ইচ্ছে করছে না।
প্রথম পর্ব যারা মিস করেছেন ।