আপনি যদি কোন জাহাজিকে জিজ্ঞাসা করেন “তার কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর প্রশ্ন কোন টি ?” নিঃসন্দেহে বলবে “আবার কবে জাহাজে যাবেন?” আমিও এই দলের বাইরে নই। দেশে আশা মাত্রই সবাই এই প্রশ্নটি শুরু করে এবং মাঝে মধ্যে মনে হয় এই প্রশ্নটির উত্তরের জন্যই তারাতারি জাহাজে যাওয়া প্রয়োজন। এমন কি ব্লগের আইডির ফেসবুকে অন লাইনে দেখলেও অনেক ব্লগার জিজ্ঞাসা করে “আপনি এখনও জাহাজে যান নি!!” তাই জাহাজে বসে ঐ আইডিতে লগ ইন বন্ধ করে দিব ভাবছি। আর একারনেই ওখানে লিখে রেখেছি “জাহাজেই আছি!মমিন!!”
তবে ২০০৭ এর পর এই জিজ্ঞাসায় নতুন আইটেম যোগ হয়েছে। উৎসাহ নিয়ে উত্তর দিলেও এখন এভয়েড করার চেষ্টা করি। প্রশ্ন টা হল “ভাই আপনাকে কখন সোমালিয়ান পাইরেট ধরে নি ? ব্যাপারটা এমন পাইরেটদের হাতে ধরা খাওয়া খুব জরুরী এবং হিরোয়িক ব্যাপার। প্রথম দিকের উৎসাহের জন্য “সোমালিয়ান পাইরেটদের নিয়ে একটা সিরিজ” শুরু করে ছিলাম । কিন্তু পরে ব্যস্ততা, আলসেমির কারণে আর হয়ে উঠে নি। ইদানিং কিছু প্রিয় মানুষের গুঁতাগুঁতিতে একটা ছবি ভিত্তিক পোস্ট দিলাম। বিষয় “ আমরা কিভাবে সোমালিয়ান পাইরেটদের প্রতিরোধ করি”।
পাইরেটদের প্রতিরোধের উপায়ের প্রথমেই বলে রাখি--ওদের হাতে থাকে আধুনিক অস্ত্র , হাই স্পীড বোট আর আমাদের কাছে থাকে শুধু কঠোর এবং দৃঢ় মনোবল। তার মানে কোন অস্ত্র ছাড়াই ওদের প্রতিরোধ করতে হয়। আর এই জন্য আমরা পাই বিশেষজ্ঞ দ্বারা রচিত একটা বই যার নাম “Best Management Practice-4” . নাম থেকেই বুঝতে পারছেন বর্তমানে এটার চতুর্থ ভার্সন চলেছে। আর এই বইটা খুব সহজ লভ্য । সুতরাং পাইরেটরাও যে এইটা থেকে গাইড লাইন পায় তা বলা বাহুল্য। পাইরেসির ব্যপারটায় একটা আন্তর্জাতিক ঘাপলা তা নিয়ে পরে আর একটা পর্ব লিখব।
আমাদের মুল মন্ত্র বা অস্ত্র হচ্ছে যে কোন উপায় ওদের জাহাজে উঠতে না দেয়া। আর কোন ভাবে যদি ওরা জাহাজে একটা পা দিয়েই ফেলে “হেড অফিস থেকে অর্ডার দেয়া আছে কোন ঝামেলা না করে ওদেরকে স্বাগত জানান এবং নেগোছিয়েশনের জন্য সহযোগিতা করা”
প্রথমেই আমরা জাহাজের চারদিকে রেজর অয়্যার বা ধারাল তার কাঁটা দিয়ে ঘিরে ফেলি। কিন্তু এই কাজটা খুব কঠিন কারন এত ধারাল থাকে প্রায় প্রতি বারই কোন ক্রু ইনজুরিতে পরে। যদিও যথেষ্ট সেফটি অনুসরণ করা হয়।
জাহাজের চারদিকে ষ্টীম লাইন ফিট করা হয়। এই লাইন দিয়ে ১/২ মিটার পর পর ছিদ্র থাকে এবং পাইরেট আক্রমণ করলে আমারা ষ্টীম চালু করে দেই। ১০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার ষ্টীম স্প্রে আমার মতে খুব কার্যকর ভুমিকা রাখে। শেষবার যখন আমরা সোমালিয়ান এলাকা পার হই এই ষ্টীমের কল্যাণে রক্ষা পেয়েছি। পাইরেটদের ৭ টা বোট আমাদের চারদিকে ঘিরে ফেলে। ইমারজেন্সি বেল বাজিয়ে সবাই ব্রিজে হাজির হয়ে ষ্টীম চালু করা হয়। ওরা অনেকক্ষণ চার পাশে ঘুরে চলে যায়। পরে খবর পেয়েছিলাম আমাদের পিছনে যে জাহাজ ছিল সেটাতে তারা আক্রমণ করে এবং ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
কাঁটা তার এবং ষ্টীমের পর পানির ব্যবস্থা করা হয়। জলদস্যুতা রোধে পানি হাস্যকর শুনালেও এটাও বেশ কার্যকর। জাহাজের পিছনে এবং চারদিকে ফায়ার হোজ দিয়ে ৬/৭ কেজি প্রেসারে পানি দেয়া হয়। পানির প্রেসারের কারণে জাহাজে উঠা সহজ হয় না। তাছাড়া জাহাজের পাশাপাশি ওরা বেশীক্ষণ চললে পানিতে ওদের বোট, অস্ত্র ভিজে যাবে।
কাঁটাতার এবং বিভিন্ন জায়গায় হাই ভোল্টেজ কারেন্ট দিয়ে দেয়া হয় এবং একটা সতর্ক বাণী ইংরেজি/ সোমালিয়ান ভাষায় লেখা থাকে।
জাহাজের ভিতরে ঢোকার সকল দরজা বিশেষ ব্যাবস্থায় ভিতর থেকে বন্ধ করা হয়। এই দরজা খুব সহজে ভেঙ্গে ফেলা যায় না।
পাইরেসি এলাকায় চলাচলের সময় আমাদের কোম্পানি এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সকল রক্ষণাবেক্ষণ কাজ বন্ধ করা দিয়েছে। এবং সকল লোকবল নিয়ে পাইরেসি যেন না হয় তার ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। সাধারন অবস্থায় ব্রিজে ২ জন ডিউটি করে। একজন অফিসার এবং একজন ক্রু। কিন্তু পাইরেসি এরিয়ায় ওয়াচ করে ৬ জন করে। কমপক্ষে দু জন অফিসার এবং চারজন ক্রু । যে সব এলাকা বেশি ঝুকি পূর্ণ সেখানে লোকবল আর বাড়ান হয়।
লোকজন বেশি রাখার কারন পাইরেট এটাক হবার পূর্বেই সতর্ক হওয়া। একজন লোক সব সময় রাডারে চোখ রাখেন এবং কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই অফিসারকে রিপোর্ট করেন। অফিসার তখন একজনকে ঐ দিকে ভিজুয়ালি লক্ষ্য রাখতে বলে। ব্রিজের চারদিকে পাহারা বসান হয় এবং ঐ সময় সবাই ঠিক মত ডিউটি করছে কিনা ক্যাপ্টেন সাহেব নিজে তা তদারকি করেন। এই সময় কাজে গাফেলতি “০” টলারেন্স সহ্য করা হয়।
ব্রিজে সব সময় একজন অফিসার সতর্ক অবস্থায় থাকে । তার কাজ হল কোন এটাকের পূর্বাভাস পেলেই UKMTO ( এন্টি পাইরেসি হেড অফিস) সহ আসে পাসের নেভিকে জানিয়ে দেয়া । জাহাজের পজিশন পেলে ওরা নিকটবর্তী নেভাল শিপকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেয় সাহায্যের জন্য। এধরনের কাজে নেভাল শিপ গুলো হেলিকপ্টার পাঠিয়ে দেয়। জরুরী সময় অফিসাররা ঘাবড়ে না যায় সে জন্য তাদেরকে আগেই ট্রেনিং দেয়া হয়।
আর এসময় অন্য অফিসার জেনারেল এলারম বাজিয়ে সবাইকে হুঁশিয়ার করে দেয়। এবং জাহাজটিকে জিগজাগ করে চালায়। জিগজাগ করে চালালে একটা তরঙ্গ তৈরি হয় যা যে কোন ছোট বোটকে জাহাজের পাশে আসা কঠিন করে দেয়। ইঞ্জিন রুম থেকে ইঞ্জিনিয়াররা ষ্টীম চালিয়ে দেয়। উচ্চ প্রেসারে পানি ছেড়ে দেয়।
জাহাজের বিভিন্ন অবস্থান থেকে ওয়াচকিপাররা প্রতি পনের মিনিট পরপর একজন অফিসারকে রিপোর্ট করে। বিশেষ করে রাতে এটা খুব জরুরী। কারন অনেক সময় ওয়াচ করতে করতে ঘুম চলে আসে। পনের মিনিটের মধ্যে কেউ রিপোর্ট না করলে অফিসার তাকে জিজ্ঞাসা করে সব কিছু ঠিকঠাক মত চলছে কিনা। আর এই যোগাযোগের জন্য ওয়াকি টকি ব্যবহার করা হয়।
ডামি যা আমরা অনেকে “কাক তারুয়া” বলে থাকি খুবই গুরুত্ব পূর্ণ ভুমিকা রাখে। জাহাজের বিভিন্ন স্থানে এগুলো স্থাপন করা হয়। পাইরেটরা কোন জাহাজ আক্রমণ করার পূর্বে ঐ জাহাজকে ফলো করে এবং তখনই আক্রমণ করে যখন বুঝে বেশি প্রতিরোধ হবে না। এই সব ডামি দূর থেকে তো নয় খুব কাছ থেকেও অনেক সময় বোঝার উপায় থাকে না এগুলো আসল নয়।
আসল কথা হচ্ছে পাইরেটদের বোঝান আমারা সতর্ক এবং তৈরি , খুব সহজে তোমাদের ছাড়ছি না।
আজ এ পর্যন্তই । বাকিটা আগামী পর্বে।
পাইরেটস অফ সোমালিয়া --- প্রতিরোধের ও নাজানা গল্প (২য় পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৫