‘আমি বলছি, শুনুন, কে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছে। আমি, আমার সচিব ও তার টাইপরাইটার’— জিন্নাহ এমনটাই বলেছিলেন বলে জানা যায়। জিন্নাহর এ অহম সত্য। মুসলিমদের মধ্যে তার মতো যোগ্য ও শক্ত আর কোনো নেতা ছিলেন না, যিনি ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুলনীতিকে পরিণতি দিতে পারেন, অর্থাত্ ভারতের বিভক্তি বাস্তবায়ন করা যায়। অথচ এই জিন্নাহ একসময় ছিলেন জাতীয়তাবাদী। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, যাকে ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত’ বলেও অভিহিত করা হত। আর এই তিনিই একসময় বিভেদ বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। জন্ম নিল ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান, যার পরবর্তীকালের বিকাশ আজকের দিনেও স্বস্তিদায়ক বলা যাবে না। সন্ত্রাস, সেনা শাসন প্রভৃতি পরিচয় দেশটিকে পরিচিত করেছে। জিন্নাহ এতটা বদলে গিয়েছিলেন কীভাবে? প্রশ্নের জবাব পেতে জিন্নাহর ব্যক্তিগত জীবনে একটু নজর বোলাতে হবে।
৪০ বছর বয়সে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রেমে পড়েছিলেন তার বন্ধু পার্সি স্যার দিনেশ পেটিটের ষোড়শী, সুন্দরী কন্যা রতনবাই পেটিট বা রটির। রটিও জিন্নাহর প্রেমে হাবুডুবু খেলেন। তবে এই অসম যুগলের প্রেমের পরিণতি শুভ হয়নি। বিয়ে-পরবর্তী অশান্তি এবং শেষমেশ মাত্র ২৯ বছর বয়সে রটির অকাল মৃত্যু। রটির মৃত্যুতে জিন্নাহ নিজের দোষ খুঁজে পেয়েছিলেন। ভেঙেও পড়েছিলেন। রটির বন্ধু ও জিন্নাহর জীবনীকার কাঞ্জি দোয়ারকাদাস জিন্নাহর রাজনৈতিক নীতির পরিবর্তন নিয়ে লিখেছেন, ‘ব্যক্তিজীবনের ক্ষতি ও হতাশা থেকে জিন্নাহর মনে যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল, তা তার রাজনৈতিক জীবনকে প্রভাবিত করেছিল।’ এছাড়া রটির মৃত্যুর পর জিন্নাহর জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তার বোন ফাতিমা জিন্নাহ। ফাতিমার চিন্তা ও প্রভাব জিন্নাহর বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছিল। কাঞ্জির কথা স্পষ্ট, ‘রটির অকাল মৃত্যু না হলে জিন্নাহ সাম্প্রদায়িক দেশভাগে আগ্রহী হতেন না।’ মিস্টার অ্যান্ড মিসেস জিন্নাহ গ্রন্থের লেখক শীলা রেড্ডিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল রটির মৃত্যুর পরে জিন্নাহর জীবনদর্শনের পরিবর্তন নিয়ে, বিশেষত তার ‘মুসলিম’ পরিচয়ের ওপর বেশি বেশি জোর দেয়া বিষয়ে। জবাবে শীলা বলেছেন, ‘দুঃখ মানুষের জীবনে বিচিত্র প্রভাব রাখে। কারো ক্ষেত্রে এটা মানুষকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং জীবনে আরো সফল করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে এটা তিক্ততা সৃষ্টি করে, এমন এক বিষ তৈরি করে, যা সেই মানুষের সঙ্গে যুক্ত সবকিছুকেই বিষাক্ত করে তোলে।’
ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক শীলা রেড্ডি মিস্টার অ্যান্ড মিসেস জিন্নাহ গ্রন্থে জিন্নাহ-রটি সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ করেছেন। জিন্নাহ ও রটির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশদ তথ্যের অভাব ছিল সবসময়ই। কারণ জিন্নাহ কখনো আত্মজীবনী লেখেননি, ডায়েরি লিখতেন না। আর চিঠি লিখলেও সেগুলো ছিল শুষ্ক, ব্যক্তিগত ভাবাবেগ সেখানে স্থান পেত না। জিন্নাহর জীবনীকারদের সবাইকেই তার জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে ‘সম্ভবত’, ‘খুব সম্ভবত’, ‘প্রায় নিশ্চিতভাবেই’ শব্দগুলো ব্যবহার করতে হয়েছে। আর এখানেই শীলার মিস্টার অ্যান্ড মিসেস জিন্নাহ বইটি ব্যতিক্রমী। বইটি তৈরি হয়েছে অনেকগুলো ব্যক্তিগত চিঠির ওপর ভিত্তি করে। চিঠিগুলো সংরক্ষিত ছিল বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, কবি, স্বাধীনতা সংগ্রামী সরোজিনী নাইডুর কন্যা পদ্মজা ও লীলামণি নাইডুর কাছে। আর শীলা সেগুলো পেয়েছেন নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরিতে। এসব চিঠির বেশির ভাগই রটি লিখেছিলেন তার বান্ধবী পদ্মজা নাইডুকেজিন্নাহ ও রটির বিয়ে পুরো ভারতবর্ষকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। জিন্নাহ মুসলমান আর রটি পার্সি। তাদের যখন বিয়ে হয়, জিন্নাহ তখন রটির বাবার বয়সী। সমাজের প্রচলিত রীতি ভেঙে নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে জিন্নাহ রটিকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তারপর? না, তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল, তেমনটা বলার উপায় নেই। রটি মারা গেলেন মাত্র ২৯ বছর বয়সে। ভারতবর্ষের এ বহুল আলোচিত দম্পতির দাম্পত্য জীবন এক রকম রহস্য হয়েই রয়ে গেছে। শীলা রেড্ডির মতে, জিন্নাহ তার রাজনৈতিক জীবনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত আবেগকে বন্দি করে ফেলেছিলেন। তাই একে অন্যকে ভালোবাসলেও রটি কখনো জিন্নাহর দেয়াল ভাঙতে পারেননি। জিন্নাহ স্বভাবগতভাবেই একাকী ছিলেন। আর রটি সেটা টের পেয়েছিলেন তাদের বিয়ের পরে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনেকেই তাদের রাজনৈতিক জীবনের চাপে পরিবারকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেননি। এমনকি নেহরু ও সরোজিনী নাইডু নিজেদের এ সীমাবদ্ধতাকে স্বীকারও করেছিলেন। কিন্তু জিন্নাহর ব্যাপারটা ছিল বেশ ভিন্ন। তার রাজনৈতিক জীবনের ব্যস্ততা যখন কমেছে, তখন রটির সঙ্গে তার সম্পর্কেরও অবনতি হয়েছে আরো বেশি। শীলার মতে, আসল জিন্নাহকে তিনি নিজেই এমনভাবে কবরস্থ করেছিলেন যে, নিজেই তিনি আর নিজেকে খুঁজে পাননি।
রতনবাই পেটিট বা রটির জন্ম বোম্বাইয়ে, ১৯০০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। ব্রিটিশ ভারতের এক ধনাঢ্য পার্সি ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতা স্যার দিনেশ পেটিট ও মাতা সায়লা টাটা। সায়লা ছিলেন ভারতের সবচেয়ে বড় শিল্প গ্রুপগুলোর অন্যতম টাটার প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজি টাটার ভাগ্নি। রটির দাদা দিনেশ মানেকজি পেটিট ভারতবর্ষে প্রথম স্থাপিত কটন মিলগুলোর কয়েকটির মালিক।
১৯১৬ সালে জিন্নাহ দুই মাসের অবকাশ যাপন করেছিলেন দার্জিলিংয়ে অবস্থিত পেটিটদের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনকেন্দ্রে। জিন্নাহ ও রটির প্রেম এখানেই প্রস্ফুটিত হয়েছিল। রটি জিন্নাহকে ‘জেয়’ বলে ডাকতেন। রটির আগ্রহ ছিল রোমান্টিক কাব্যে, জিন্নাহ তার ভালো লাগা গল্পের চরিত্র হিসেবে দেখা দিয়েছিলেন। রটি ছিলেন সুন্দরী, ষোড়শী, তার ওপর ভারতের অন্যতম ধনী পার্সি ব্যবসায়ীর কন্যা। তার চোখের পলক একবার ঝুঁকলেই রটির সামনে হাঁটু গেড়ে লুটিয়ে পড়ার তরুণের অভাব ছিল না। এমন রটির সামনে জিন্নাহ যেন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিলেন। রটির কিশোরীসুলভ রোমাঞ্চপ্রিয় মন ধরা দিল জিন্নাহকে। তবে জিন্নাহ কীভাবে রটির প্রেমে পড়লেন, সেটা বোঝাটা একটু কঠিন। হতে পারে রটির সৌন্দর্য, যৌবন, বুদ্ধিমত্তায় মোহিত হয়েছিলেন; হতে পারে জিন্নাহ নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছিলেন। তার প্রথম স্ত্রী যখন মারা যান, তখন জিন্নাহর বয়স ২০ বছর পার হয়নি। কিন্তু তাই বলে নিজের বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে নতুন জীবন, যে তার মেয়ের বয়সী! কারণটা নিশ্চিত না হলেও আমরা এটা নিশ্চিত যে, জিন্নাহ গভীরভাবে রটির প্রেমে পড়েছিলেন।
সেবার দার্জিলিং থেকে ছুটি কাটিয়ে ফেরার পর জিন্নাহ রটির পিতা স্যার দিনশর কাছে তার মেয়েকে বিয়ের অনুমতি প্রার্থনা করেন। দিনশ জিন্নাহর মুখের ওপর ‘না’ করে দিলেন। বাবার রক্তচক্ষু অবশ্য রটিকে থামাতে পারল না। সে জিন্নাহর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই চলল। এর মধ্যে স্যার দিনশ আদালত থেকে রায় পেলেন, যার মাধ্যমে জিন্নাহ আইনত রটির সঙ্গে যোগাযোগের অধিকার হারালেন। কারণ রটি তখনো প্রাপ্তবয়স্ক নন। আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর কোনো ইচ্ছা রটির ছিল না। কিন্তু জিন্নাহ আইন ভাঙতে চাইলেন না। তাই তিনি ১৮ মাস অর্থাত্ রটি প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখলেন। এ সময় রটি জিন্নাহকে প্রচুর চিঠি লিখেছিলেন। তবে আশ্চর্যের বিষয় পাকিস্তানে জিন্নাহ ও রটির একে অন্যের প্রতি লেখা চিঠিগুলোর হদিস নেই, এমনকি সেখানকার ন্যাশনাল আর্কাইভেও সেগুলো নেই।
১৯১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রটির বয়স ১৮ হলো এবং আদালতের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল। ১৮ এপ্রিল রটি শূন্য হাতে পিতার প্রাসাদ ত্যাগ করলেন। জিন্নাহর সঙ্গে জামিয়া মসজিদে গিয়ে মাওলানা এমএইচ নাজাফির সামনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। পরদিন এই মাওলানাই জিন্নাহ ও রটির বিয়ে পড়ালেন। জিন্নাহর বয়স তখন ৪২। বিয়ের মোহরানা নির্ধারিত হয়েছিল ১ হাজার ১ রুপি। তবে জিন্নাহ তার নববিবাহিত পত্নীকে ১ লাখ ২৫ হাজার রুপি উপহার দিলেন।
রটির ধর্মান্তরিত হওয়া বহু বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। যেসব কট্টর উলেমা জিন্নাহর বিরুদ্ধে ছিলেন, তারা পরবর্তীকালে রটি কখনো ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলে স্বীকার করেননি। আর জিন্নাহবিরোধী উদারপন্থীরা বলেছিলেন, এ ধর্মান্তর প্রমাণ করে, জিন্নাহ একজন গোঁড়া মানুষ। তবে উভয় পক্ষই ভুল ছিল। রটির ইসলাম ধর্ম গ্রহণের দালিলিক প্রমাণ রয়েছে এবং মাওলানা নাজাফি সে ঘটনার সাক্ষীও ছিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মান্তরিত না হলে জিন্নাহ ও রটির বিয়ে হওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ তাদের বিয়ে করতে হয়েছে সিভিল কোর্টে আর তখনকার আইন আনুসারে একই ধর্মের না হলে কোনো যুগলের বিয়ে হওয়া সম্ভব ছিল না। অন্য একটি উপায় ছিল, নিজেকে ধর্মহীন হিসেবে ঘোষণা করা। জিন্নাহ নিজেকে মুসলিম ভিন্ন অন্য কিছু দাবি করেননি। যদিও তিনি ইসলামী আচারবিধি মেনে চলতেন না। তখন জিন্নাহ নিজে ছিলেন ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত একটি আসনের সদস্য। তাই নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যত্ বাঁচাতে নিজেকে মুসলিম ঘোষণা করা ছাড়া তার সামনে আর কোনো পথ ছিল না। রটিও জিন্নাহর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে যত্নবান ছিলেন। তাই নিজের ধর্মকেই তিনি উত্সর্গ করলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জিন্নাহকে বিয়ে করলেন। ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর রটির নাম রাখা হয় মরিয়ম জিন্নাহ। যদিও এ নাম সামাজিক জীবনে সেভাবে ব্যবহূত হয়নি।
বিয়ের জন্য রটি জিন্নাহকে একটি মাত্র শর্ত দিয়েছিলেন, আর সেটা হলো জিন্নাহকে তার গোঁফ কাটতে হবে। রটির কথামতো বিয়ের আগে ঠিকই জিন্নাহ তার গোঁফ বিসর্জন দিয়েছিলেন। খুব সম্ভবত বাকি জীবনে জিন্নাহকে আর গোঁফ রাখতে দেখা যায়নি।
জিন্নাহ তার ক্লাবের সদস্যপদ বাতিল করলেন। এ ক্লাবে তিনি সন্ধ্যায় দাবা ও বিলিয়ার্ড খেলতেন। এখন তিনি খেলা বাদ দিয়ে সোজা বাসায় ফিরে রটির সঙ্গে গল্প করতেন বাড়ির বাগানে বসে। এমনিতে জিন্নাহ কখনই খরুচে মানুষ ছিলেন না। তবে ঘর সাজাতে ও দামি পোশাক কিনতে রটির চাহিদামতো প্রচুর অর্থ তিনি হাসিমুখেই খরচ করতেন। পদ্মজার কাছে লেখা রটির চিঠিগুলো থেকে বোঝা যায় তিনি ছিলেন শৌখিন নারী। ভালোবাসতেন কুকুর, বিড়াল, ঘোড়া, কবিতা ও রাজনীতি। জিন্নাহ ও তার বোন ফাতিমার সঙ্গে চরিত্রগত পার্থক্যের কথাও রটি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। রটি ছিলেন একরোখা ও প্রখর মর্যাদাবোধসম্পন্ন। জিন্নাহর সঙ্গে বিয়ের পর ভাইসরিগাল লজে তিনি ভারতের ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডকেও ছেড়ে কথা বলেননি। ভাইসরিগাল লজে রটি শাড়ি পরে গিয়েছিলেন এবং হাত মেলানোর পরে লর্ড চেমসফোর্ডকে নমস্তে বলে সম্ভাষণ জানান। কিন্তু চেমসফোর্ড এ বেয়াদবি ছাড় দিতে নারাজ। তিনি রটিকে বলেছিলেন, ‘আপনার স্বামীর সামনে বিরাট রাজনৈতিক ক্যারিয়ার অপেক্ষা করছে, সেটা আপনার ধ্বংস করা উচিত নয়। রোমে আপনাকে রোমানদের মতোই আচরণ করতে হবে।’ জবাবে রটি বলেছিলেন, ‘আমি সেটাই করেছি, ইয়োর এক্সিলেন্সি। ভারতে মানুষ যেভাবে স্বাগত জানায়, আমি আপনাকে সেভাবেই জানিয়েছি।’
১৯২৭ সালের ডিসেম্বরে রটি জিন্নাহর সঙ্গে মুসলিম লীগের কলকাতা সেশনে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু জানুয়ারিতে ফেরার সময় রটি তাজ হোটেলে উঠলেন! কী সমস্যায় এ বিচ্ছেদ হয়েছিল, তা কারো জানা নেই। তাদের এক বন্ধু বিষয়টি মিটমাট করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘এটা আমার দোষ। আমাদের উভয়েরই একটু বোঝাবুঝি দরকার, যেটা হচ্ছে না।’ আরেকজন বন্ধু রটিকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি বললেন, ফিরে যাবেন, তবে সেজন্য জিন্নাহকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই বন্ধু যখন বিষয়টি নিয়ে জিন্নাহকে অনুরোধ করলেন, তখন তিনি সেটাকে তাদের ব্যক্তিগত বিষয় বলে উল্লেখ করে এড়িয়ে যান।
জিন্নাহ ধীরে ধীরে তার রাজনৈতিক জীবনে আরো বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অন্যদিকে রটির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে লাগল। ১৯২৮ সালের এপ্রিলে রটি মায়ের সঙ্গে প্যারিসে গেলেন চিকিত্সার স্বার্থে। সেখানে রটি কোমায় চলে গেলেন। জিন্নাহ তখন ডাবলিন সফরে। সবকিছু ফেলে ছুটে এলেন প্যারিসে। পরবর্তী এক মাস জিন্নাহ তার স্ত্রীকেই সুস্থ করায় মনোযোগ দিলেন। তার যত্ন নিলেন, তার সঙ্গে সময় কাটালেন। রটিকে সুস্থ করতে জিন্নাহ অনেক ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন। তবে রোগ শানক্তকরণ নিয়ে আজো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রচলিত মতের মধ্যে আছে, নার্ভাস ব্রেকডাউন থেকে কোলাইটিজ। অনেকে আবার মনে করেন, রটির যক্ষ্মা হয়েছিল। যা হোক, তার স্বাস্থ্য একটু একটু করে ভালো হতে শুরু করল। শুধু রটির স্বাস্থ্য নয়, বরং মনে হচ্ছিল, যেন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আবার জোড়া লাগতে শুরু করেছে। এ দম্পতির একজন সাধারণ বন্ধু ছিলেন শিমনলাল। তার বর্ণনামতে, তিনি জিন্নাহ ও রটিকে বেশ ভালো মেজাজে দেখে প্যারিস ছেড়েছিলেন। তিনি জানান, এমনকি তারা একত্রে কানাডা সফরেরও পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু শিমনলাল কিছুদিন পর প্যারিসে ফিরে দেখেন, সেখানে জিন্নাহ একা। জিন্নাহ বললেন, ‘আমাদের ঝগড়া হয়েছে, সে বোম্বে চলে গেছে।’ বোম্বে ফিরে রটি আবারো তাজ হোটেলে গিয়ে উঠলেন। কয়েক দিন পর জিন্নাহও বোম্বে ফিরে এলেন। তারা এক ছাদের তলায় আর না থাকলেও প্রতি সন্ধ্যায় জিন্নাহ রটির সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। ১৯২৯ সালের ২৮ জানুয়ারি অ্যাসেম্বলির বাজেট অধিবেশনে যোগ দিতে দিল্লি গেলেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি রটি আবার কোমায় চলে গেলেন। তিনি আর সুস্থ হননি। ২০ ফেব্রুয়ারি মাত্র ২৯ বছর বয়সে রটি দুনিয়াকে বিদায় জানালেন। রটির মৃত্যুসংবাদ জিন্নাহকে জানালেন তার শ্বশুর। তার মেয়েকে বিয়ের পর এই প্রথম তিনি জিন্নাহর সঙ্গে কথা বললেন।
জিন্নাহ বোম্বে পৌঁছলেন ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে। পরিচিত এক কর্নেল ও তার স্ত্রী জিন্নাহকে স্টেশন থেকে কবরস্থানে নিয়ে গেলেন। পুরো পথে জিন্নাহ একেবারে নীরব, শান্ত ছিলেন। যদিও চেহারায় ছিল শোকের নিশানা। কবরস্থানে অনেকেই কাঁদছিলেন। কিন্তু জিন্নাহ তখনো নিস্তব্ধ। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, পাথরে খোদাই করা মূর্তি, চোখের দৃষ্টি সামনে দূরে নিবদ্ধ। রটির মরদেহ কবরে নামানোর পর জিন্নাহকে প্রথম মাটি দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। জিন্নাহ মাটি দিলেন এবং সোজা হয়েই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। না, জিন্নাহ নীরবে চোখের পানি ফেলছিলেন না, বরং হাত দিয়ে মুখ ঢেকে শিশুদের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। কয়েক মিনিট কেঁদেছিলেন জিন্নাহ। কারো কাঁধে ভর দিয়ে নয়, বরং স্বাভাবসুলভ একাকী। কান্না শেষ করে জিন্নাহ চোখ মুছলেন এবং ফিরে গেলেন তার প্রস্তরসদৃশ চেহারায়।
পরদিন দোয়ারকাদাস গেলেন জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে। এই দোয়ারকাদাস ছিলেন রটির ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। রটির শেষ দিনগুলোতেও তিনি তার সঙ্গে দেখা করেছেন। দোয়ারকাদাস দেখলেন, জিন্নাহ নিজেকে রটির মৃত্যুর জন্য দোষারোপ করছেন। দোয়ারকাদাসের মতে, রটির মৃত্যুতে নিজেকে দায়ী করে জিন্নাহ এ ঘটনাকে তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা বলে মনে করেছিলেন। এ মনোভাব তিনি বাকি জীবনে আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
পরিবার, ধর্ম, জীবন— সব হারিয়ে ইতিহাসে ট্র্যাজিক চরিত্রটি হয়ে থাকবেন রটি। দুজনের সম্পর্কের টানাপড়েন সবচেয়ে ভালো বোঝা যাবে জিন্নাহকে লেখা রটির শেষ চিঠিতে। প্যারিস থেকে ফিরে তিনি এ চিঠি লিখেছিলেন—
“প্রিয়তম, তোমাকে ভালোবাসি... আমি তোমাকে ভালোবাসি... একটু কম ভালোবাসলে আমি তোমার সঙ্গেই থাকতে পারতাম... কারণ কেউ সুন্দর একটি ফুল ফোটালে সেটাকে কখনো কাদায় টেনে আনবে না। তুমি তোমার জীবনের লক্ষ্যে যত ওপরে উঠেছ, তোমার প্রেম তত ফিকে হয়ে গেছে।
প্রিয়তম, আমি তোমাকে যতটা ভালোবেসেছি, তা খুব কম মানুষকেই কেউ বেসেছে। আমি শুধু তোমার কাছে একটি মিনতি করি, যে দুঃখগাথা প্রেমের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে, তা যেন প্রেমেই শেষ হয়।
প্রিয়তম, শুভরাত্রি ও বিদায়।”
রটি ও জিন্নাহর গল্প শেষ করার আগে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। একদিন রটির পিতা স্যার দিনেশ যে ক্রোধ আর হতাশায় ভুগেছিলেন, সেটা জিন্নাহকেও ভোগ করতে হয়েছিল। রটি ও জিন্নাহ দম্পতির কন্যা দিনা যখন পার্সি নেভিল ওয়াদিয়াকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন জিন্নাহ ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। কন্যাকে ত্যাজ্য করার হুমকি দেন। কিন্তু দিনা তার মায়ের মতোই দৃঢ়, অটল ছিল। জিন্নাহর এক গাড়িচালক সে সময়ের স্মৃতিচারণ করেছিলেন বিখ্যাত উর্দু গল্পকার সাদাত হাসান মান্টোর কাছে। সেই গাড়িচালক বলেন, ‘জিন্নাহ আবেগাক্রান্ত হয়ে ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি কারো সঙ্গে তখন দেখা করতেন না। সারাক্ষণ সিগারেট খেতেন আর নিজের ঘরে পায়চারী করতেন। সেই দুই সপ্তাহে তিনি অন্তত শত মাইল হেঁটেছিলেন তার ঘরের মধ্যেই।’
(লেখাটির পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ 'দৈনিক বণিক বার্তা'র বিশেষ সাময়িকী 'সিল্করুট'-এ প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১:৩৩