[বই এবং লেখক পরিচিতি : অ্যা হিস্ট্রি অব দি আরব পিপলস বইটিতে লেখক সপ্তম শতক থেকে বিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত আরবের মানুষের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। নতুন ধর্ম ইসলাম আরব উপদ্বীপ থেকে কখন, কীভাবে পশ্চিমমুখী যাত্রা শুরু করে, সেটি এ বইয়ের বিষয়। ১৯৯১ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। বইটি সম্পর্কে মধ্যপ্রাচ্যের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছেন, ‘অবশেষে সত্যি সত্যি আরবদের নিয়ে পাঠযোগ্য সংবেদনশীল একটি ইতিহাস আমাদের হাতে এসেছে।’
লেখক অ্যালবার্ট হাবিব হাউরানির জন্ম ১৯১৫ সালে, ম্যানচেস্টারে। লেবানিজ পিতা-মাতার সন্তান হাউরানি অক্সফোর্ডের ম্যাগডালেন কলেজে দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯৪৮ সালের পর তাকে অক্সফোর্ডের ম্যাগডালেন কলেজে মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ইতিহাস বিষয়ে প্রথম লেকচারার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৫৮ সালে তিনি যান সেন্ট অ্যান্টনি কলেজে, যেখানে তিনি মিডল ইস্ট সেন্টারের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। তার নেতৃত্বে অক্সফোর্ড হয়ে ওঠে ইংরেজিভাষীদের মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়নের প্রধান কেন্দ্র। এছাড়া তিনি হার্ভার্ড, শিকাগো, প্রিন্সটনসহ বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আরব জাতীয়তাবাদের উদ্ভব এবং ইসলাম ও পশ্চিমের সম্পর্ক নিয়ে কাজের জন্য তিনি সারা দুনিয়ায় সম্মানিত। ১৯৯৩ সালে অ্যালবার্ট হাউরানি ইহলোক ত্যাগ করেন।
এখানে অ্যালবার্ট হাউরানির অ্যা হিস্ট্রি অব দি আরব পিপলস বই থেকে একটি অধ্যায় অনুবাদ করা হয়েছে, যেখানে সপ্তম থেকে দশম শতক কালপর্বে ইসলামী দুনিয়ার বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।]
একীভূত সমাজ : অর্থনৈতিক ভিত্তি
পূর্ব ও পশ্চিমে একক কাঠামোর সরকার ব্যবস্থার পতন সামাজিক বা সাংস্কৃতিক দুর্বলতার লক্ষণ ছিল না। সপ্তম শতকে সৃষ্টি হয়েছিল একটি মুসলিম দুনিয়া, যা বিভিন্ন লিংকের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। একই সঙ্গে এই মুসলিম দুনিয়া বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষমতা ও উচ্চতর সংস্কৃতির কেন্দ্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিল।
বিশাল এক অঞ্চল এই মুসলিম দুনিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তা এমন একটি অর্থনৈতিক একক বলয় গড়ে তুলেছিল, যা কেবল আকারের দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না; বরং একই সঙ্গে তা সভ্য দুনিয়ার দুটি গুরুত্বপূর্ণ সাগর অববাহিকাকে যুক্ত করেছিল। একটি হলো ভূমধ্যসাগর, অন্যটি ভারত মহাসাগর। এ দুই সাগরের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী, বণিক, কারুশিল্পী, পন্ডিত, তীর্থযাত্রী, চিন্তা, রীতি এবং বিভিন্ন প্রযুক্তির চলাচল সহজ হয়ে যায়। পারস্পরিক সংস্পর্শের এই বিরাট ক্ষেত্র সেখানে অর্থাৎ মুসলিম দুনিয়ায় শক্তিশালী সরকার, বৃহৎ শহর, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিকাশমান গ্রামাঞ্চল এবং প্রত্যেকের অস্তিত্বের জন্য একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার শর্ত তৈরি করে।
মুসলিম সাম্রাজ্যের গড়ে ওঠা এবং পরবর্তী সময়ে সেই ভূখন্ডে অনেক রাষ্ট্রের তৈরি হওয়া বৃহৎ নগরের বিকাশের পথ করে দেয়। এসব শহরে ধনিক শ্রেণি ও সরকারের সম্পদ এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য খাদ্য, উৎপাদনের কাঁচামাল এবং বিলাসদ্রব্যের দরকার হয়ে পড়ে। নগর জীবনের এই পরিবর্তন এবং জটিলতা ক্ষমতাবান বা বিদেশিদের নতুন ফ্যাশন অনুসরণের তাড়না জোগায়। নগরের নতুন চাহিদা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি দূরপথের বাণিজ্যকে (যা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল) নতুন পথ এবং পদ্ধতির সন্ধান দেয়। দূরপথের বাণিজ্যের জন্য ভারী এবং স্তুপাকারের মালামাল উপযুক্ত ছিল না। শহরগুলোর খাদ্যচাহিদা পূরণ হতো নিকটবর্তী গ্রামাঞ্চল থেকে। কিছু পণ্যের মুনাফা এতটাই বেশি ছিল যে, অনেক দূরের পথে সেগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়াটাও ছিল ব্যবসার জন্য লাভজনক। মরিচ, অন্যান্য মসলা, মূল্যবান পাথর, মিহি কাপড় ও পোর্সেলিন আসত ভারত ও চীন থেকে। পশমি কাপড় আসত উত্তরের দেশগুলো থেকে। এসবের বিনিময়ে আরব থেকে রফতানি হতো হাতির দাঁত, প্রবাল এবং বোনা কাপড়। মধ্য পূর্ব শহরগুলো শুধু ভোক্তাই ছিল না, তাদের নিজেদের ব্যবহার এবং রফতানির জন্য বিভিন্ন কারখানাজাত পণ্যও উৎপাদন করত। কিছু উৎপাদন হতো বড় আকারে, যেমন- যুদ্ধের উপকরণ প্রস্তুত হতো রাষ্ট্রীয় অস্ত্র কারখানায়। এছাড়া তৈরি হতো প্রাসাদের জস্য মিহি কাপড়। চিনি পরিশুদ্ধকরণ এবং কাগজ তৈরির কারখানাও ছিল। তবে এসব উৎপাদনের বেশিরভাগ হতো ছোট ছোট কারখানায়।
আধুনিক যুগে রেলগাড়ি, তারপর মোটরকার তৈরি হওয়ার আগপর্যন্ত স্থলপথের চেয়ে জলপথে পরিবহন অপেক্ষাকৃত সস্তা, দ্রুত এবং নিরাপদ ছিল। অধিবাসীদের খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য এ সময় বড় শহরগুলোকে অবশ্যই কোনো সাগরের কাছে বা নদীপথের পাশে অবস্থিত হতে হতো। দীর্ঘপথের নৌ-বাণিজ্য এ সময় পরিচালিত হতো সাগরপথে, বিশেষত ভারত মহাসাগরে। আব্বাসীয় আমলে এ পথের বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল ইরাকের বসরা এবং গালফের ইরান উপক‚লের সিরাত। এ দুটো স্থানই ছিল আব্বাসীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণে এবং রাজধানীর চাহিদা পূরণে অনুকূল অবস্থানে। দশম শতকে নৌ-বাণিজ্য গালফ থেকে সরে লোহিত সাগরে চলে যায়। আর এর পেছনে ছিল বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে কায়রোর উত্থান। কায়রোর উত্থানের পেছনে ছিল ইতালির বাণিজ্য শহরগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদা। কিন্তু এটা ছিল মাত্র শুরু।
বসরা থেকে সিরাত- পূর্বের সঙ্গে বাণিজ্য করত প্রধানত ইরানি, আরব ও ইহুদি বণিকরা। আরব বাণিজ্য জাহাজ পশ্চিম ভারতের বন্দর ছাড়িয়ে আরো দূরে চলে যেত। এক সময় তারা চীনেও পৌঁছে যায়। তবে দশম শতকের পর তারা দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বন্দরগুলো পেরিয়ে আর কোথাও যেত না। তারা দক্ষিণ এবং পশ্চিম আরব ও পূর্ব আফ্রিকায় যেত। বসরা থেকে নদীপথে মালামাল যেত বাগদাদে, বাগদাদ থেকে সিরিয়ার মরুপথ ধরে সিরিয়া এবং মিসর ও আনাতোলিয়ার মধ্য দিয়ে যেত কনস্টান্টিনোপল, ত্রেবিজোন্ডে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ ছিল বাগদাদ থেকে উত্তর-পূর্ব ইরানের নিশাপুর এবং সেখান থেকে মধ্যএশিয়া ও চীন। লম্বা দূরত্বে মালামাল পরিবহন করা হতো উটের পিঠে আর কম দূরত্বে খচ্চর বা গাধার পিঠে। ইসলামী সাম্রাজ্যের পত্তনের পর নিকট-পূর্বের এলাকাগুলো থেকে চাকাযুক্ত পরিবহন যান অদৃশ্য হয়ে যায় এবং উনিশ শতকের আগপর্যন্ত সেগুলো আর এ অঞ্চলে ফিরে আসেনি। এর পেছনে বিভিন্ন কারণকে দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেমন- রোমানদের পথগুলো ক্ষয়ে গিয়েছিল, আরব শাসকদের উট পালনে আগ্রহ ছিল, উটের পিঠে মালামাল পরিবহন চাকার গাড়ির তুলনায় বেশি সস্তা ছিল।
শুরুর দিকে ভূমধ্যসাগরে বাণিজ্য ছিল বেশ বিপজ্জনক এবং এর পরিসর ছিল সীমিত। পশ্চিম ইউরোপে তখনো রফতানি করার মতো উদ্বৃত পণ্য উৎপাদন বা নিজেদের অধিক ভোগের সক্ষমতা অর্জিত হয়নি। বাইজানটাইন সাম্রাজ্য চেষ্টা করছিল আরব নৌশক্তিকে এবং নৌবাণিজ্যকে গন্ডিবদ্ধ করে রাখার। দক্ষিণ উপকূল ধরে বাণিজ্য চলত স্পেন, মাগরিবের সঙ্গে- সিরিয়া ও মিসরকে যুক্ত করে। এ ক্ষেত্রে তিউনিসিয়া এক ধরনের বাজারই ছিল বলা যায়। এ পথ ধরে বণিকরা বিশেষত ইহুদি বণিকরা স্প্যানিশ সিল্ক, পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আনা সোনা এবং ধাতু ও অলিভ অয়েলের বাণিজ্য সৃষ্টি করেছিল। পরবর্তী সময়ে দশম শতকে ভেনিস এবং আমালফির সঙ্গে বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে।
শক্তিশালী সরকার এবং বড় শহর আশপাশে উৎপাদনক্ষম গ্রামাঞ্চল ছাড়া টিকতে পারে না, আবার একইসঙ্গে গ্রামাঞ্চল শক্তিশালী সরকার এবং শহরের বিনিয়োগ ছাড়া উৎপাদনে বিকশিত হতে পারে না। আরবরা যেসব দেশ জয় করেছিল বা যেখানে প্রচুর আরব অভিবাসিত হয়েছিল সেখানে এক নতুন ভূমি মালিক শ্রেণি গড়ে ওঠে। বিজিত এলাকার প্রাক্তন জমি মালিকদের তথা শেষবিচারে সেখানকার শাসকদের থেকে জমির মালিকানা দেয়া হয় আরবদের। তবে এক্ষেত্রে কর পরিশোধের বাধ্যবাধকতা ছিল। দশম শতকে এসে একটি ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যেখানে জমির খাজনা আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয় নির্দিষ্ট কর্মকর্তা এবং সেনা অধিনায়কদের। এতে কার্যত তারা জমির মালিক হয়ে পড়ে এবং এ কারণে জমির উৎপাদন নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জমির প্রাক্তন কৃষকরাই জমিতে কাজ করতেন, যদিও কিছু এলাকায় কৃষক এবং পশুপালকরা দেশান্তরিত হয়েছিলেন। অস্তিত্বমান প্রমাণ থেকে বোঝা যায়, জমির মালিক এবং চাষিদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল শস্যের ভাগাভাগি প্রথায়। খাজনা পরিশোধের পর ফসল, জমির মালিকানা, বীজ, পশু এবং অবদানের ভিত্তিতে শ্রমে ভাগাভাগি হতো। সেচসুবিধাযুক্ত জমি এবং যেসব জমিতে অন্য গাছ থাকত সেখানে হিসাবটা আরেকটু জটিল হয়ে যেত।
জমির মালিকরা বাণিজ্য বা অন্য কোনো খাতের অর্থ এনে কৃষিতে বিনিয়োগ করত। ফলে কৃষিতে নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রচলন হয়। মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তার তার মধ্যে নতুন নতুন ফসলের আমদানি ঘটায়। অন্তত যেসব ফসল আগে থেকেই অস্তিত্বমান ছিল সেগুলোর উৎপাদন বিকশিত হয়। মূলত প্রবাহ ছিল পশ্চিমমুখী। চীন ও ভারত থেকে ইরান হয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকায় চাষ হতো ধান, ইক্ষু, তুলা, তরমুজ, কমলা ও লেবু। এসব ফসলের কয়েকটি উৎপাদনে সেচ এবং জমি প্রস্তুতে অনেক বিনিয়োগের দরকার হতো। পুরনো সেচ ব্যবস্থাকে সচল করা হয়, যেমন- দক্ষিণ ইরাকে এবং একইসঙ্গে নতুন সেচ ব্যবস্থাও তৈরি হয়। পশ্চিমমুখী যাত্রায় দেখা যায় স্পেন সিরিয়া থেকে পায় জলচাকা (ওয়াটার হুইল), ইরান থেকে ভূগর্ভস্থ নালা এবং ফসলের পর্যায়ক্রমেও স্পেন, পায় নতুন পদ্ধতি।
ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, বাণিজ্য এবং উৎপাদনের বিকাশ নিকট-পূর্ব এবং ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকার অর্থনীতিতে অর্থের গুরুত্ব বৃদ্ধি করে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বিভিন্ন মূল্যবান ধাতুর আমদানি, বিশেষত আফ্রিকার স্বর্ণের কারণে খিলাফতে মুদ্রার বিকাশ ঘটে। আব্বাসীয় স্বর্ণমুদ্রা বা দিনার কয়েক শতক ধরে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামী রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং অক্সফোর্ডের উত্তরে উইচউডে। মুদ্রার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঋণ ব্যবস্থাও বিকশিত হয়।
একটি জটিল এবং দূর প্রক্ষিপ্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদে টিকতে পারে না, যদি সেখানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরস্পর অপরিচিত সক্রিয় মানুষদের মধ্যে প্রত্যাশার অংশীদারিত্ব না থাকে। যেমন, যে ইহুদি বণিকরা ভ‚মধ্যসাগর এবং এর বাইরে যেতেন বাণিজ্য করতে, তাদের মুসলিম এবং খ্রিস্টান দেশগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হতো। যদি সে ধরনের পারস্পরিক প্রত্যাশা বা সম্পর্ক না থাকত তাহলে সেখানে নির্দিষ্ট আইন বা সামাজিক নৈতিকতার দরকার হতো। একইভাবে জমির মালিক এবং কৃষকদের মধ্যে সম্পত্তির মালিকানা, উৎপাদনের ভাগাভাগি, খাজনা, পানি, গাছ ও মাটির নিচের সম্পদের ওপর অধিকার বিষয়ে পরিষ্কার এবং সুনির্দিষ্ট আইন দরকার ছিল। তাই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দাবি করছিল একটি সাধারণ আচরণের। এটা সম্ভব হয়েছিল মুসলিম সাম্রাজ্যে বসবাসকারীদের মধ্যে বেশি বেশি মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় এবং হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি প্রত্যাদেশিত নিয়ম সমাজ-জীবন থেকে নিষ্কাশিত হতে থাকায়।
ভাষা এবং বিশ্বাসের ঐক্য
অমুসলিমদের ইসলাম গ্রহণের পর্যায়গুলো আবিষ্কার করা খুব একটা সহজ নয়। তবে মুসলিম নাম আত্মীকরণের প্রমাণ বিশ্লেষণ করে ইসলাম গ্রহণের ব্যাপকতার মাত্রা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এ হিসাব অনুযায়ী উমাইয়া আমলের শেষ দিকে (ইসলামী দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে, যা ছিল খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক) ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মিসর, তিউনিসিয়া এবং স্পেনের ১০ শতাংশেরও কম মানুষ মুসলমান ছিল। অবশ্য আরব উপদ্বীপে এ পরিমাণ আরো বেশি ছিল। ইরাক এবং সিরিয়ায় ইসলামের আবির্ভাবের আগে থেকে থাকা আরব গোষ্ঠীগুলো বাদে বেশিরভাগ ধর্মান্তরিতরা এসেছেন সমাজের নিচু স্তর থেকে, যেমন- যুদ্ধে বন্দি হওয়া সৈনিক অথবা প্রশাসনিক সরকারের কর্মচারীগণ, যারা নতুন শাসকদের অধীনে কাজ করছিল। অন্যদের ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে কোনো চাপ বা সুবিধা দেয়ার লোভ দেখানো হতো না।
খ্রিস্টীয় দশম শতকে এসে চিত্র বদলে যায়। অসংখ্য মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। শুধু শহরের নয়, গ্রামের অনেক মানুষও ইসলাম গ্রহণ করেন। এর একটি কারণ হতে পারে এমন যে, ইসলাম ধর্ম অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট, অন্য ধর্মের সঙ্গে এর পার্থক্যটা অনেক বেশি সুস্পষ্টভাবে টানা হয়েছে। মুসলমানরা তখন এক বিস্তৃত আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মতত্ত¡ এবং আইনের মধ্যে বসবাস করছিলেন, যা অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে একেবারে পৃথক ছিল। খ্রিস্টান, ইহুদি এবং জরথুস্ত্র ধর্মাবলম্বীদের সামাজিক অবস্থান সুস্পষ্ট ছিল এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিচুস্তরের মনে করা হতো। তাদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হতো না, কিন্তু তারা সমাজে কিছু বিধিনিষেধের মধ্যে বাস করতেন। যেমন- তাদের নির্দিষ্ট কর প্রদান করতে হতো, কিছু নির্দিষ্ট রঙের পোশাক তারা পরতে পারতেন না, মুসলমান নারীদের বিয়ে করতে পারতেন না, মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের সাক্ষী আদালতে গ্রহণ করা হতো না, তাদের বাসগৃহ এবং প্রার্থনা গৃহ জাঁকজমকভাবে সাজাতে পারতেন না, ক্ষমতাবান পদ থেকে তাদের ছাঁটাই করা হয়েছিল (যদিও অনেক জায়গায় মুসলিম শাসকদের অধীনে অনেক ইহুদি ও খ্রিস্টান সচিব এবং অর্থনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন)। তবে এসব নিয়ম স্থানীয় পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে কঠোর বা শিথিল হতো। তবে সবচেয়ে শিথিল পরিস্থিতিতেও সংখ্যালঘুদের জীবন কিছুটা অস্বস্তিতে থাকত এবং সেই প্রেক্ষিতে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য এক ধরনের পরোক্ষ প্ররোচনা থাকত।
আরবি ভাষা ইসলামের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তৃত হতে থাকে। অবশ্য অনেক জায়গায় তা ইসলামের বিকাশের আগেই ঘটছিল। সিরিয়ার অভ্যন্তরে এবং পশ্চিম ইরাকে ইসলামের বিজয়ের আগেই আরবি ভাষা প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। আরবদের দিয়ে অভিবাসিত এবং আরবদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সরকারের মাধ্যমে বিভিন্ন নতুন শহর আরবি ভাষা বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছিল। আরবি ভাষা লেখ্য এবং কথ্য ভাষা হিসেবে বিকশিত হচ্ছিল।
কথ্য ভাষা হিসেবে আরবি ইরানে ফারসি ভাষার মুখোমুখি হয়। লেখ্য ভাষা হিসেবে অবশ্য আরবি মুসলিম দুনিয়ায় কোনো বাধার মুখে পড়েনি। ধর্ম এ ভাষাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে চলেছিল। অনারব যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারাও, বিশেষত ইরানিরা কোরআন পড়তেন আরবি ভাষাতেই। যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি তারা ধর্মীয় এবং সাহিত্যের কাজে নিজেদের ভাষাই ব্যবহার করতেন। কিছু পূর্বাঞ্চলীয় চার্চের স্তোত্রমালা এখনো সিরীয় এবং কোপটিক ভাষায় রয়ে গেছে। ইহুদিদের ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত ভাষা ছিল হিব্রু ও আরামায়িক। জরথুস্ত্রদের ভাষা ছিল পহ্লবী, যা ফারসি ভাষার একটি রূপ। ইসলামের আবির্ভাবের আগে এবং পরে পহ্লবী ভাষা ব্যবহৃত হতো। তবে এসবের মাঝেও কিছু পরিবর্তন হচ্ছিল, যেমন- কিছু পূর্বাঞ্চলীয় চার্চের ধর্মচর্চার ভাষা হয়ে ওঠে আরবি; আবার স্পেনের ইহুদিরা তাদের দর্শন, বিজ্ঞান এবং কবিতা লেখায় আরবি ভাষা ব্যবহার করতেন।
ইসলামী দুনিয়া
ইসলামী যুগের তৃতীয় এবং চতুর্থ শতকে (খ্রিস্টীয় নবম ও দশম শতক) ‘ইসলামী দুনিয়া’ বলে স্বীকৃত একটি দুনিয়ার আবির্ভাব ঘটে। এ দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তে একজন পর্যটক মুসলমান শাসিত এবং মুসলমান অধ্যুষিত একটি ভূখন্ডে সে কী দেখেছে শুনেছে সেটা বর্ণনা করতে শুরু করল। এটা সম্ভব হয়েছিল মানুষের চলাচলের মাধ্যমে। রাজত্ব এবং তাদের সেনাবাহিনীর চলাচল, ভারত মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগর দিয়ে বণিকদের চলাচল, শাসক ও ধনীদের পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষ কারুশিল্পীদের বিভিন্ন শহরে গমনের কারণে। ইসলামী দুনিয়া থেকে আমদানি করা ও রফতানি হওয়া বিভিন্ন পণ্য, যেমন- বই, ধাতু নির্মিত সামগ্রী, সিরামিকস এবং বোনা কাপড় প্রভৃতির নকশা বা ধরনের মাধ্যমে এ দুনিয়ার একটি চিহ্ন পৌঁছে যাচ্ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে।
অসাধারণ কিছু স্থাপনা ছিল ইসলামী দুনিয়ার বাহ্যিক প্রতীক। পরবর্তীকালে মসজিদ নির্মাণ এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক নির্মাণশৈলীর আবির্ভাব ঘটে। তবে প্রথম শতকগুলোতে কর্ডোভা থেকে ইরাক- সব জায়গার নির্মাণরীতি প্রায় একই রকমের ছিল। বৃহৎ মসজিদগুলোর পাশাপাশি বাজার, লোকালয় বা গ্রামের জন্য ছোট ছোট মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। এসব মসজিদে শুক্রবারের জুমার নামাজ আদায় হতো না। এগুলো নির্মিত হয়েছিল স্থানীয় উপকরণ এবং নকশারীতি অনুযায়ী।
এ সময় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্রীয় অবস্থানে ছিল মসজিদ। মসজিদে প্রার্থনার পাশাপাশি কাজি বিচার করতেন। পথিক ও তীর্থযাত্রীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র, অসুস্থদের চিকিৎসার কাজেও ব্যবহৃত হতো মসজিদ। এসবের ভিত্তি নির্মাণ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হতো কোরআনের নির্দেশানুযায়ী দান-খয়রাতের মাধ্যমে। কোনো শহর বা অঞ্চলের বাঁধনের চেয়েও বড় পরিসরে মুসলিম দুনিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল অন্য এক ধরনের স্থাপনা। আর এ স্থাপনা হলো পবিত্র মাজার। কিছু মাজার হয়ে ওঠে তীর্থস্থান। এসব তীর্থকে কেন্দ্র করে প্রার্থনার রীতি এসেছিল এ অঞ্চলের আগের ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে, যাকে এবার ইসলামী অর্থ দেয়া হয়। মক্কার কাবা, জেরুসালেমের কুব্বাত আস-সাখরাহ (ডোম অব রক) এবং হেবরনে ইব্রাহিম (আ.)-এর সমাধি। একই সঙ্গে আরো কিছু আকর্ষণীয় স্থান নির্মিত হতে থাকে : ইসলামের প্রাথমিক সময়ের সঙ্গে জড়িত উল্লেখযোগ্য মানুষদের সমাধি। যদিও মুসলমানরা হজরত মোহাম্মদকে (সা.) অন্যদের মতো একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করেন, তবু তারা মনে করেন যে শেষবিচারের দিন তিনি তাঁর উম্মতদের জন্য সুপারিশ করবেন। মক্কায় হজের সময় মুসলমানরা মদিনায় হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সমাধি পরিদর্শন করেন। শিয়াদের ইমাম, বিশেষত যারা নিদারুণ নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন, তাদের সমাধি প্রাথমিক কাল থেকেই মানুষকে আকর্ষণ করেছে। ধীরে ধীরে ইসলামী দুনিয়ায় ‘আল্লাহর বন্ধু’ নামে পরিচিত- এমন সন্তদের মাজারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ সন্তদের আল্লাহর কাছে মানুষের পক্ষে ওকালতি করার ক্ষমতা আছে বলে মনে করা হয়। কোনো সন্দেহ নেই যে, এসব পবিত্র সমাধির অনেকগুলো গড়ে উঠেছিল এমন জায়গায়, যেগুলো আগের ধর্মগুলোর বা আদিকাল থেকে গ্রামীণ সামাজিক ঐতিহ্যের কাছে পবিত্র ছিল।
দ্বিতীয় আরেক ধরনের স্থাপনা ছিল, যেগুলো শাসকদের ক্ষমতা প্রকাশ করত। এসবের মধ্যে অনেকগুলো ছিল সাধারণ মানুষের সেবার জন্য, যেমন- বাণিজ্যপথে সরাইখানা, মধ্যপ্রাচ্য এবং মাগরিবের শুষ্ক অঞ্চলে জলাধার এবং জল সরবরাহের প্রণালী নির্মাণ। শহরের মানুষের জন্য পানি সরবরাহে এ জলপ্রণালী ছিল চমৎকার শাসন ব্যবস্থার একটি নিদর্শন। জমিতে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলা ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় আরবদের বিস্তারের সঙ্গে ইসলামী দুনিয়া বিস্তৃতি লাভ করে। প্রাসাদগুলো রাজকীয় মহিমা প্রকাশ করত। সেখানে থাকত বাগান ও ফোয়ারার মাঝে আমোদ-প্রমোদের প্যাভিলিয়ন। এসব প্রাসাদ ছিল স্বতন্ত্র এক স্বর্গের প্রতীক। একই সঙ্গে এগুলো ছিল সরকার, বিচার ব্যবস্থা এবং রাজকীয় জীবনযাত্রার প্রতীক। সামারায় পাওয়া ধ্বংসাবশেষ এবং লেখকদের বর্ণনা থেকে আব্বাসীয় প্রাসাদের কিছু বৈশিষ্ট্য জানা যায়। প্রাসাদের সামনে কুচকাওয়াজ এবং ঘোড়ার কসরত খেলার জন্য খোলা জায়গা থাকত। উঁচু প্রাচীরের ভেতরে বাগানের মধ্য দিয়ে পথ গিয়ে মিলত অভ্যন্তরে প্রবেশদ্বারের গোড়ায়। কেন্দ্রস্থলে দেখা যেত খলিফার বাসভবন, কার্যালয় এবং গম্বুজযুক্ত হল, যেখানে খলিফা আদালত বসাতেন। এসব ভবন ছিল ক্ষমতা, জাঁকজমক এবং আমোদ-প্রমোদের প্রতীক। এ প্রাসাদ ছিল বাইরের দুনিয়া থেকে একেবারেই এক স্বতন্ত্র জগৎ। সব মিলিয়ে এ প্রাসাদের বৈশিষ্ট্যগুলো অনুকরণ করা হয়েছে মুসলিম দুনিয়ায় এবং এটা তৈরি করেছিল এক আন্তর্জাতিক রীতি, যা টিকে ছিল কয়েক শতক ধরে।
এক বিবেচনায় বলা যেতে পারে, প্রাসাদের প্রকৃতপক্ষে ‘ইসলামিক’ বলে নির্দিষ্ট কোনো কিছু ছিল না। বরং একটি সাম্রাজ্যে দুনিয়ার অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন উৎসের নানা জিনিস এক নতুন ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। শাসকরা ইসলামের দুনিয়ার গন্ডির বাইরে গিয়েও একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতেন। শাসকদের মধ্যে উপহার বিনিময় হতো। দূতরা নিয়ে আসতেন অনবদ্য সব নতুন কাহিনী। শাসক শ্রেণির অভিজাতরা নতুনকে গ্রহণ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন। প্রাসাদের সজ্জায় থাকত রাজপুত্রদের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন আখ্যান, যেমন- যুদ্ধ, শিকার, মদ এবং নাচ।
এসব আখ্যান ফুটিয়ে তোলা হতো দেয়ালচিত্রে। এসব চিত্রে প্রাণী এবং মানুষের অবয়বগুলোর প্রাধান্য ছিল। ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত ভবনে জীবন্ত প্রাণীর চিত্র বাদ দেয়া হতো। যদিও কোরআনে জীবন্ত প্রাণীর চিত্রাঙ্কনকে স্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়নি, কিন্তু ধর্মীয় আইনজ্ঞরা হাদিসের ভিত্তিতে মনে করেন, এ ধরনের চিত্র তৈরি সৃষ্টিকর্তার প্রাণ সৃষ্টির একচ্ছত্র ক্ষমতার ওপর অবৈধ হস্তক্ষেপ। দামাস্কাসের উমাইয়া শাসনামলের প্রাথমিককালে নির্মিত মসজিদে প্রাকৃতিক জগৎ এবং ঘরবাড়ির চিত্র অনবদ্যভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে, যা রোমান চিত্রকলাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে এ চিত্রে কোনো জীবন্ত প্রাণী আঁকা হয়নি। মসজিদ এবং অন্যান্য সাধারণ সরকারি ভবনের দেয়াল একেবারে সাদামাটা ছিল না। মেঝেতে ছিল গাছ এবং ফুলের কারুকাজ, আর ছিল রেখা এবং বৃত্তের সংযোগ। সবকিছুর ওপরে ছিল ক্যালিগ্রাফি। ক্যালিগ্রাফি প্রধানত তৈরি হয়েছিল শাসকদের দফতরে কাজ করা কর্মকর্তাদের হাত ধরে। তবে এসব ক্যালিগ্রাফি মুসলমানদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তাদের মতে, আল্লাহ আরবি ভাষার শব্দের মাধ্যমে পবিত্র পুরুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আর ক্যালিগ্রাফাররা সেই ভাষার লেখাকে এমন এক উপায়ে নকশা করেছেন, যাতে তা স্থাপত্যে ব্যবহার করা যায়। শব্দ বা বাক্যগুলোকে অসংখ্য নকশায় রূপ দেয়া হতো, লেখাগুলোতে উদ্ভিদ বা জ্যামিতিক নকশার ছাপ মেশানো হতো। এভাবে ক্যালিগ্রাফি হয়ে ওঠে ইসলামিক শিল্পকলার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। আরবি লেখা শুধু ভবনের সজ্জাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা বিস্তৃত হয়েছিল মুদ্রা, মৃৎ ও পিতলের পাত্রে, তৈরি পোশাকে, বিশেষত যেগুলো রাজকীয় কারখানায় উপহার দেয়ার জন্য তৈরি হতো। এ লেখা সৃষ্টিকর্তার মহিমা ও অবিনশ্বরতার বার্তা ঘোষণায় ব্যবহৃত হতো, যেমন- কুব্বাত আস-সাখরাহ-এর (ডোম অব রক) চারপাশের খোদাই কাজ। আবার কোনো শাসকের উদারতা বা বিশালতা এবং স্থপতির নৈপুণ্য প্রদর্শনের জন্যও ক্যালিগ্রাফি ব্যবহৃত হতো।
এ সময়ে শহরে মুসলমানদের তৈরি ঘরবাড়ি এখন আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু হস্তনির্মিত বিভিন্ন জিনিসের নকশা দেখে বোঝা যায়, সেসব নকশার অনেকগুলোই ছিল প্রাসাদের নকশার অনুরূপ। বণিক ও বিদ্বানদের জন্য বই নকল করা হতো এবং সেগুলোকে চিত্রসংযুক্ত করা হতো। বণিকদের জন্য আরো তৈরি হতো কাচ, ধাতু ও মৃৎপাত্র। টেক্সটাইল ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মেঝে মোড়াতে কার্পেট ব্যবহৃত হতো। বসার চেয়ার সুদৃশ্য কাপড় দিয়ে মোড়ানো হতো, দেয়ালে শোভা পেত কার্পেট বা কাপড়। এসব সজ্জাই ছিল ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর সাজসজ্জার সদৃশ। এসব নকশায় থাকত গাছ ও ফুল, জ্যামিতিক নকশা এবং আরবি শব্দ। রাজকীয় বিশেষ নকশার তেমন উপস্থিতি ছিল না। মানুষের চিত্র অনুপস্থিত ছিল না, অন্তত বেশ কিছুকাল পর্যন্ত। মিসরে তৈরি সিরামিকসে মানুষের চিত্র ছিল। পান্ডুলিপিতে রূপকথা এবং দৈনন্দিন জীবনের চিত্র ফুটিয়ে তুলতে প্রাণী এবং মানুষের চিত্র ব্যবহৃত হতো।
দশম শতক নাগাদ নিকট-পূর্ব এবং মাগরিবে বসবাসরত জনগোষ্ঠী এমন এক দুনিয়ায় বাস করত, যা ইসলাম দিয়ে নির্দেশিত হতো। ইসলাম এবং যুদ্ধের আবাস দিয়ে বিশ্ব বিভক্ত হয়েছিল। মুসলমানদের আবাসস্থলে পবিত্র স্থান এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত স্থানগুলো সেই মুসলিম ভূখন্ডকে আলাদা চরিত্র দিয়েছিল। সময় নির্ধারিত হয়েছিল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, শুক্রবারের বিশেষ নামাজ, রমজান মাসের শেষে ঈদ, মক্কায় হজ এবং ইসলামী ক্যালেন্ডার দিয়ে।
ইসলাম মানুষকে একটা পরিচয় দিয়েছিল, যা দিয়ে সে নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদাভাবে উপস্থাপন করত। অন্যদের মতো মুসলমানরাও বিভিন্ন স্তরে বসবাস করত। সব সময়ই তারা শেষবিচার আর স্বর্গের কথা চিন্তা করত না। নিজেদের স্বতন্ত্র ব্যক্তি-অস্তিত্বের বাইরে তারা দৈনন্দিন কাজে পরিবার বা আরো বড় পরিসরে আত্মীয় দলে, গোত্রে, গ্রাম বা গ্রামীণ জেলা-নগরের প্রেক্ষিতে নিজেদের বিবেচনা করত। এসবের বাইরে তারা আরো একটি বড় পরিচয়ের প্রেক্ষিতে নিজেদের বিবেচনা করত, আর সেটা হলো বিশ্বাসীদের সমাজ (উম্মা)। তারা সাধারণভাবে যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করত দুনিয়া এবং পরকাল সম্পর্কিত একটি সাধারণ ধারণা তা তাদের এক অপরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল এবং অন্য ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তাদের পৃথক করেছিল; তা এই মুসলমানরা মুসলিম দুনিয়ায় বাস করুক আর তার বাইরেই বাস করুক।
এই ‘ইসলামী দুনিয়া’র মধ্যে এর এবং কিছু সংযোগকারী ছোট দলের মধ্যে মধ্যবর্তী সময়ে এমন কিছু দল ছিল যারা সামগ্রিকভাবে ইসলামের প্রতি পূর্ণ দীর্ঘমেয়াদি আনুগত্য প্রকাশ করেনি। কোনো রাজত্বে দীর্ঘদিন কাজ করা এবং বাধ্যতার মধ্যে থাকলেই কেবল দীর্ঘমেয়াদি আনুগত্য সৃষ্টি হতে পারে। একটি ভাষাকে খুব বেশি ব্যবহার যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্য এবং গর্বের সৃষ্টি করে। একাদশ শতকে আরবদের ইসলাম দিয়ে নির্দেশিত করার প্রবণতা যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল, এমনকি ইরানীয় বংশোদ্ভ‚ত আল বেরুনীও সেটা করেছেন। তিনি বলেছেন : ‘আমাদের ধর্ম এবং সাম্রাজ্য হচ্ছে আরব, এ দুটো পরিচয় যমজ। একটি রক্ষা করছে আল্লাহর শক্তি এবং আরেকটি রক্ষা করছেন আল্লাহ নিজে। মাঝে মাঝেই কিছু গোত্র জড়ো হচ্ছে একটি অনারব পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু তারা সেই উদ্দেশ্যে সফল হতে পারবে না।’
আধুনিক জাতিগত জাতীয়তাবাদ, যেখানে একই ভাষা ব্যবহারকারীরা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সমাজে একত্রিত হয়ে বাস করবে অথবা ভৌগোলিকভাবে নির্দিষ্ট একটি ভূখন্ডে একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে- এসব ধারণার কোনোটাই আজ আর কার্যকর নেই। তবে আরব দুনিয়ায় এখনো কিছু শহর এবং গ্রামের কিছু বিষয়ে মানুষের মাঝে এক ধরনের চেতনা কাজ করে, যাকে তারা ইসলামী হিসেবে বিবেচনা করে। মিসরকে বিবেচনা করলে এ ধরনের চেতনার অস্তিত্বকে অনুভব করা যায়। যেমন এর প্রাকৃতিক উপহার এবং উর্বরতা, ইসলামের ইতিহাসে এর অবস্থান, এর নায়ক, শহীদ এবং সন্তরা। এর বাইরে ইসলাম-পূর্ব প্রাচীন সভ্যতার বেশকিছু অস্তিত্বও রয়েছে, যেমন- পিরামিড, স্ফিংস, প্রাচীন মাজার; গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান; মানুষ নিজেদের রক্ষার জন্য এখনো যেগুলোর শরণ নেয়।
অনুবাদ : শানজিদ অর্ণব