‘না’। এটা শুধুই একটি শব্দ নয়। ‘না’ মানে একটি সিদ্ধান্ত। একটি মত। একটি অসম্মতি। কিন্তু আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে নারীর মুখে ‘না’ মানে পুরুষের জন্য ইন্সাল্ট। পুরুষের প্রস্তাবে নারীকে শুধুই ‘হ্যা’ বলতে হবে। আমরা অনেকেই দাবী করি, নারীকে আমরা যথেষ্ট স্বাধীনতা দেই। প্রথম বিষয় হচ্ছে, একটি মুরগীকে যদি বলা হয়, তুমি চিকেন ফ্রাই নাকি চিকেন কারি হয়ে আমার পেটে যেতে চাও সেই সিদ্ধান্ত আমি তোমার উপর ছেড়ে দিলাম। অর্থাৎ মুরগীকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়া হলো। এটাকে যদি আমরা বলি মুরগীর স্বাধীনতা তবে বিষয়টা হাস্যকর হবে। তবে হাস্যকর হলেও এটি সত্য যে আমাদের সমাজে নারীরা ঐ মুরগীর মর্যাদাই ভোগ করে। এর বেশি যদি কোথাও করে থাকে তবে সেটা শুধুমাত্র দাপ্তরীক খাতা-কলমে। আমাদের ঘরে বা সমাজে নয়। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, আপনি নারীকে স্বাধীনতা দিচ্ছেন মানে আপনি পরোক্ষভাবে দাবী করছেন যে কোন এক সময় আপনি নারীর প্রভু ছিলেন অথবা এখনো আছেন। অর্থাৎ নারী আপনার উপনিবেশ।
খাদিজার ক্ষেত্রেও বিষয়টি এরকমই। একজন পুরুষ তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিবে, তার জন্য চাঁদ-সূর্য নিয়ে আসতে চাইবে অথচ তার প্রেমের প্রস্তাবে কোন নারী ‘না’ করতে পারবে না। কেননা সেই অধিকার কোন নারীর নেই। তাকে শুধু এবং শুধুই ‘হ্যা’ বলতে হবে। বদরুলও কিন্তু খাদিজাকে স্বাধীনতা দিয়েছিল। খাদিজাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে সে তার সাথে প্রেম করবে কিনা। জিজ্ঞেস করা মানেইতো আপনি তাকে মতামত দিতে বললেন। কিন্তু এ স্বাধীনতায় প্রস্তাবের উত্তর শুধুই ‘হ্যা’ হতে হবে।
কাকে, কিভাবে এবং কতুটুকু সম্মান দিতে হবে তা কেউ জন্ম থেকে শিখে আসে না। তাকে শেখাতে হয়। এবং শেখায় প্রতিবেশ। পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষা। বদরুলকে এগুলোর কোনটাই তা শেখাতে পারেনি। যা শিখিয়েছে তা সে প্রকাশ্যে করার ধৃষ্টতাই দেখিয়েছে। এবং এই শিক্ষায় শিক্ষিত বদরুল আরো শত শত আছে। বদরুলতো শুধুমাত্র তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর খাদিজা করছে মুরগীর মত ভোগ হওয়ার প্রতিক্ষায় থাকা শ্রেনীর প্রতিনিধিত্ব যাদেরকে আমরা এখনো পূর্ণাঙ্গ মানুষের মর্জাদা দিতে পারিনি।
এবার ছোট্ট করে একটু বলি মূল্যবোধ বা কমনসেন্সের কথা। ফেসবুকে খাদিজার বেডের পাশে দাড়ানো সাংসদের যে ছবিটি ভাইরাল হয়েছে সেখানে সাংসদ এবং আহত খাদিজা {(আগে সামাজিকভাবে পরে শাররীকভাবে আহত)(সম্ভবত আর বেশিক্ষণ আহত থাকবে না)} সবাই-ই নারী। একবার শুধু চিন্তা করুন, একজন সাধারন মানুষের সাধারন কোন কারনে চূড়ান্তরকম আহত মৃত্যুপথযাত্রী কোন মানুষের শয্যাপাশে দাড়িয়ে তার মনের অবস্থা কেমন হতে পারে। স্বাভাবিক কোন মানুষের এ অবস্থায় বুক কেঁপে উঠবে। অবশ্য তারাতো আবার সাধারন নন। তারা বাংলাদেশের নারী নেতৃত্বের অন্যতম কর্ণধার যারা নারীর অধিকার নিয়ে বক্তৃতা দেন।
এরপর আসুন ঐ ছবি নিয়ে আমরা যারা ফেসবুকে নগ্ন ঠা্ট্টা-মশ্করা করছি তাদের কথায়। এই মশ্করা দিয়ে আমরা নিজেদের খুব নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ প্রতিয়মাণ করছি তা কিন্তু না। বরং এটা প্রমাণ করছি আমাদের কাছে খাদিজার চাইতে ঠাট্টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটা কথা মনে করিয়ে দেই। ঐ ছবিতে কিন্তু খাদিজাও আছে যে আপনার-আমার লজ্জ্বাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। যে খাদিজাকে আপনি-আমি মারতে হয়তো পেরেছি, কিন্তু বাঁচাতে হয়তো পারবোনা। আমাদের ক্ষমতার দোড় ঐ পর্যন্তই।
সর্বশেষ এটাই বলবো, বদরুলরা জন্ম নিতেই থাকবে, তারা খাদিজাদের মারতেই থাকবে এবং খাদিজারা মরতেই থাকবে যতদিন না আমরা নারীদের সম্মান দিতে শিখবো, তাদের মতমতের সম্মান দিতে শিখবো।