আমি ছিলাম মাইল দু-চারেক দূরে
দেখতে পেলাম পাহাড়-চূড়ায় মহল;
ছায়াবিহীন জোৎস্নার প্রান্তরে
চিরকালীন ঘোড়া দিচ্ছে টহল।
যেই না খানিক হাঁপিয়ে উঠে থামি
অমনি শুনি অদ্ভূত এক সুরে
গাইছে কে গান - চমকে উঠি আমি !
কাঁদছে কে যে অনেক অনেক দূরে...
কেমন ঘোরে পৌঁছে গেলাম মহল
দেখি, একটা ফুলের কাছে নত
গানের উৎস বাগানপথেই বসে;
আমায় দেখে ভীষণ থতমত !
আমায় ডেকে বলল, 'অ্যাই, তুমি কে?'
-'অন্ধ কবি, আর তুমি কে শুনি?
ফুলটা অবাক, 'রাণীকে চেনো না?
বিরাট পাজী, মাফ চাও এক্ষুণি !'
রাণী তখন মিষ্টি হেসে ওঠে
সর্বনাশের তখন সবে শুরু !
****************************************
হঠাৎ ফুল'টা দেখিয়ে রাণী বলে,
'একটা জিনিস দিলাম তোমায় বেছে -
এই ফুলটার হাজার বছর বয়স,
এই ফুলটা মরতে ভুলে গেছে !'
আমি ভীষণ চমকে উঠি, 'সে কী !
মরবে না সে? এ কোন প্রজাতি?'
- 'প্রতিদিন সে নতুন করে ফোটে
তাই জানো তার নেই পুরাতন স্মৃতি !
তবু জানো, মহাকালের কথা
সব জমা তার পাপড়ি'র উল্টোপাশে...'
ফুল'টা বলে, 'দোহাই লাগে রাণী,
আর বোলো না, মানুষ অচেনা সে !'
রাণী'র ভীষণ হাসির শব্দে তখন
একটা ঋষি ধ্যানটা ভেঙে কেশে
চোখটা কচলে অবাক হয়ে তাকায়,
রাণী'র পাশে মানুষ নাকি? কে সে?
ফুল বলে, 'এই দ্যাখো, কাজ সেরেছে
কবি মানুষ তুমি এখন পালাও !'
আমি ভীত, কোন পথে পালাবো?
রাণী হাসে, ফুলটা তো ছুঁয়ে যাও?
ফুলটা ভীষণ চিৎকার করে ওঠে,
'কক্ষণো না, কক্ষণো না, দোহাই...'
ভুল যা করার আমি করেই ফেলি
সেই ভুলে আজও নির্ঘুম রাত পোহাই
তারপর কী হল, কী যে হল
ওসব আমার খেয়াল তো নেই সকল
আমি আজও শিউরে শিউরে উঠি
কোনটা ছিল আসল, কোনটা নকল
ইতিহাসটা তীব্র তীরের মত
বিঁধল এসে আমার দুটি চোখে !
সত্য দেখে অন্ধ হলাম আমি
অন্ধ হলাম রাণীর'ই সম্মুখে !
আমায় ভীত দেখে রাণী বলে -
'যা দেখেছ সত্য - আমি জানি,
জানি বলেই মরতে হবে আমায়'
এই বলে ফের মুচকি হাসে রাণী !
ঘোরটা আমার কাটেনি তখনও
সেই ঘোরেতে হারিয়ে ফেলি তাকে।
জেগে দেখি, কোন দেশে ফের আমি?
আমার তখন রক্ত ঝরছে নাকে।
*****************************************************
দেখি তখন মহলে কী হল।
সপ্ত-ঋষি সাত-পাঁচ না ভেবে
রাজার কানে কী যে বলে গেল;
রাজা ছিল খানিকটা পাগলাটে
ওসব শুনে আরও এলোমেলো !
সেই রাজা তাই ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে
বলল, 'রাণী বন্দী হবে আজই !'
রাণী শুনে ফিসফিসিয়ে বলে,
'আমি নিজেই বন্দী হতে রাজি!'
রাণী বন্দী হল নিজের ঘরেই
বাইরে টহলে প্রাচীন সে ঘোড়াগুলি
এদিকে রাণী'র সঙ্গী কে হল জানো?
মরতে ভুলে যাওয়া সে ফুলের কলি।
রাণী হেসে ফুলকে প্রশ্ন করে,
'জানো, রাজা কী নিয়ে চিন্তিত?'
অবাক চোখে ফুল তাকিয়ে বলে,
'ওসব আমি খেয়াল করি নি তো!'
রাণী হাসে, 'ফুল তুমি বেশ আছো,
নিজের মনে এমনি সুখেই থেকো,
অন্ধ কবি আবার যদি আসে,
তার জন্যে গল্পগুলো রেখো?'
কবিকে সব সইতে বলো তুমি?
সত্য যে কী - সে তো আমিই জানি।
ওরা তোমার বিচার করার কে আজ?
রাণী, পালাও তুমি! পালাও রাণী!
রাণী শুধুই মুখটা টিপে হাসে
অন্ধ কবি'র ছন্দ নীল বাতাসে
ফুল বুঝেনা রূপকথাদের ধরণ
রাণী কেবল ঠোঁট'টা চেপে হাসে।
ওরা তখন বিচার করতে এল।
ওরা কারা? ওরা কাদের লোক?
'বাদ দাও না? ওসব জানতে হয় না !'
বলেই রাণী বন্ধ করল চোখ।
ওরা তখন তাকে ছিঁড়েই ফেলে!
ইচ্ছেমতন টেনে-হিঁচড়ে ধরে;
কালপুরুষের কোমর থেকে তখন
তিনটা তারা'র একটা খসে পড়ে...
রুপকথাটা শেষ হয় না তবু,
রুপকথা'রা শেষ হতে জানে না।
মাঝরাতে এক তারা'র জন্ম হল
সবাই অবাক, 'মুখটা যেন চেনা!'
এসব গল্প বলতে হবে জেনে
মরতে চেয়েও কবি আজ পারছে না...
***************************************
অ-নামিকা নক্ষত্রের রাতে
মহীনের ওই ঘোড়াগুলি'র মত
'অমর' হয়ে একবার জন্মাতে?
বুঝতে কেমন - মরতে চাওয়ার ক্ষত।