প্রিয় সুনয়না,
জানিনা এ লেখা তোমার চোখে পড়বে কিনা, তাতে কি বা আসে যায়। কোন চিঠি তো তোমার পড়া হয়নি, এটাও নাই বা পড়লে। আগের চিঠিগুলো কিভাবেই বা পড়বে তুমি? একটা চিঠিও যে প্রাপকের ঠিকানায় পৌছায়নি, রয়ে গেছে প্রেরকের ডায়রিতে। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন ঘোর লাগা সেই সময়টাতে আমি ডায়েরির পাতায় এঁকে গিয়েছিলাম তোমার মুখাবয়ব। জীবননান্দের চোখে খুঁজে পেয়েছিলাম সেই শ্রাবস্তী নগরের দুর্লভ অমূল্য শেষ তৈলচিত্রটি।
মানুষ যা ইচ্ছে তা স্বপ্নে দেখতে পারে না। তবু প্রতি রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে আমি স্রষ্টার কাছে একটি দৃশ্য চেয়ে মিনতি করতাম। নির্জন কোন গোধূলিতে আমি বসে আছি তোমার হাত ধরে। নিশ্চুপ তুমি, নির্বাক আমি। তবু মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব ভাষা, সব ব্যাকরণ লুঠোপুঠি খাচ্ছে দুজনের পদতলে। চারিদিক নিস্তব্ধ। নীরবতার কাছে হেরে গেছে কোলাহল। কখনো উচ্চস্বর, কখনো ফিসফিস। তুমি হাসছ, আমাকে মুগ্ধ করে দিয়ে হেসে চলেছ। তোমার কাছে পরাজিত হচ্ছে পাখিদের সংলাপ। তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি পড়ে চলেছি কোন প্রেমিকের কাছে লেখা প্রেমিকার প্রথম প্রেমপত্রটি। কাজল চোখে তুমি চেয়ে আছ খোলা চিঠির মত। কখনো পাখির নীড়, কখনো বা কাশবন। ঠোঁটে হাসি। সে হাসির আহ্বানে নেমে আসে জ্যোৎস্নারা। এই ইট পাথরের নগরে মিছিল করতে করতে এগিয়ে আসে জোনাকির দল। প্রেমিকের অব্যাক্ত ভালবাসার প্রতিনিধি হয়ে তারা ছুঁয়ে যায় প্রেমিকার হাতের আঙ্গুল, নদীর মত চুল আর গ্লাডিউলাসের মত ঠোঁট।
সুনয়না, তোমার খোলা চুলে আঁচড়ে পড়ছে সমুদ্রের নিঃশ্বাস। তুমি দাঁড়িয়ে আছো কোন সৈকতে। সামনে অপার সমুদ্র, পায়ের নিচে শুভ্র বালি। পূর্ণিমার চাঁদের সাথে আলো নিয়ে লুকোচুরি খেলছে ছোট ছোট ঢেউগুলো। সে ঢেউগুলো থেকে অনেক দূরে, সৈকত থেকে এক চোখের দৃষ্টি পেরিয়ে কেউ একজন ডাকছে তোমাকে। খালি পায়ে, নুপুরের গর্জন তুলে তুমি মিশে যাচ্ছ সমুদ্রের জলে। তোমার জন্য দিশাহীন নাবিকের আমরণ অপেক্ষা। তার হাল ভাঙ্গা জাহাজ প্রাণ ফিরে পাবে তোমার স্পর্শে, চাহনিতে, তোমার দৃঢতায়, তোমার স্থিরতায়। তোমার কাজল চোখে তন্ময় হয়ে চেয়ে রবে নাবিক। সে চোখ যেন নাবিকের হারিয়ে যাওয়া কম্পাস। কখনো কাজল লেপ্টে গড়িয়ে পড়বে অশ্রুধারা। ঝড় উঠছে, প্রলয়ংকারী ঝড়। প্রমত্ত ঝড়ে ভাঙছে, উড়ে যাচ্ছে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে নাবিকের বুক। পৃথিবীটা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিবে সে, মিশিয়ে দিবে ধূলোর সাথে। শুধুমাত্র প্রেমিকরাই প্রেমিকার এক ফোঁটা চোখের জলের প্রতিশোধ নিতে এমন হিংস্র, এমন বুনো, এমন উন্মত্ত হতে পারে।
সুনয়না, আমি জানি আগে তীব্র অসহায় নিয়ে তুমি আত্মসমর্পন করতে কান্নার কাছে। আজ তোমার আত্মসমর্পন যেন একটি বিজয়ের আখ্যান। তুমি মাথা রেখে আছো প্রেমিকের কাঁধে, পরম ভরসায়। তোমার চোখের জল আগের মত এই ধুলো বালি কাঁদার রাজ্যে গড়াগড়ি খায় না। সে জল লেগে থাকে কোন একজনের শার্টের কাঁধে, হাতের তালুতে। তোমার মনে হবে পৃথিবীর আয়তন বেড়ে গেছে অনেক গুণ। জীবনের ছোট দৈর্ঘ্যের জন্য বিধাতার কাছে অনুযোগ জানিয়েছ তুমি। পাহাড়ের মত মৌনতা নিয়ে নিশ্চুপ থাকেন বিধাতা। সবার কাছে উত্তর থাকে না।
তারপর শহরে সন্ধ্যা আসে নিয়ম মেনে। নীড়ে ফেরার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে সাদা বক। ফিরতে হবে তোমাকেও। তবু হাত ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না তোমার। প্রেমিকের অমসৃণ হাত তোমাকে বেঁধে রাখে শেকলের মত। তুমি চলে যাবে। বাড়ি ফেরার তাড়া তোমার। প্রেমিকের হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছ তুমি। অন্ধকার ঘিরে ধরে প্রেমিকের চারপাশ। সে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে মেঘের মত, নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে রাতজাগা পাখির মত। হঠাৎ প্রেমিকের কাতর মুখের দিকে চেয়ে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত কান্না আসে তোমার। তুমি যাবে না। এ হাত ছেড়ে তুমি কোথাও যাবে না। এখানেই রাত্রি নামুক, আঁধার ঘনাক, শিশির ঝরে পড়ুক কাঁচা রোদের মত।
আগন্তুকের মত ভোরের আলো ঠিকরে পড়ে তোমার ঘুমঘোর মুখের উপর।
সময় কেটে যায় জলপ্রপাতের মত। আমরা দুজন বসে আছি নদীতে ডুবে থাকা পাথরের মত নিশ্চল হয়ে, আমরা ভেসে যাচ্ছি সমুদ্রে ভেসে চলা হিমবাহের মত জড়তা নিয়ে। অনন্তকাল।
নাবিকের চোখে বিস্ময়। সুনয়নার চোখে ঘুম। তার অলস চুলের ঘ্রাণ নাবিকের কাছে মাদকের মত নেশা জাগায়।
এসব দৃশ্যকল্প আঁকা আছে রাত্রির গভীরে, কাল্পনিক চিত্র গুলো লেখা আছে ডায়েরীর পাতায়। সুনয়না জানেনা কিছুই।
গল্পের প্রধান চরিত্র কাছে গল্পটা অজানা। অদ্ভুত সে গল্প।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৪:০৮