সাপ্তাহিক অধ্যয়নসভা
১৭তম ব্যাচের উদ্বোধন
বৃহস্পতিবার ১লা এপ্রিল ২০১০
সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা
‘জ্ঞানই শক্তি’- ফ্রান্সিস বেকনের এ উক্তিটি বোধকরি মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে অপব্যবহৃত একটি উদ্ধৃতি। বিশেষত আমাদের সমাজে এ কথা আরও সত্য। ইউরোপীয় রেনেসাঁর একটি সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রোপটে আধুনিক বিশ্ববীক্ষার অন্যতম প্রধান পুরোহিত বেকন একটি বিশেষ পদ্ধতির দ্বারা আহরিত উপাত্তভিত্তিক চিন্তার ফসলকেই কেবল ‘জ্ঞান’ বলেছিলেন। বেকনের আগে ও পরে বহু মানুষের শ্রম ও সাধনার দ্বারা জ্ঞানের এ পদ্ধতি বিকশিত হয়েছে যাকে আমরা নাম দিয়েছি ‘বিজ্ঞান’। আজ বিংশ শতকের শেষে, সুক্ষ্ম বিষয়ে অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌল পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট ঐক্যমতের সৃষ্টি হয়েছে। অথচ, মজার ব্যাপার, এসব পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে বসেও এক শ্রেণীর মানুষ নির্বিচারে বেকনদের উদ্ধৃত করে নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে জ্ঞান বলে দাবী করছেন।
মানুষের জ্ঞানচর্চার প্রয়াসের সঙ্গে তার খাদ্যাভ্যাস সৃষ্টির একটি বিস্ময়কর সাদৃশ্য রয়েছে। শিশু অবস্থায় সে প্রথম প্রথম হাতের কাছে যা পায় তা-ই খেয়ে ফেলতে চায়, এমন কি তার প্রিয় খেলনাটিও পর্যন্ত। ক্রমশ বেড়ে ওঠার সঙ্গে মানুষ বুঝতে পারে যে চারপাশের সবই খাদ্য নয়। আরও বড় হলে সে জানতে পারে যে খাদ্যেরও পুষ্টিভেদ রয়েছে এবং কিছু কিছু খাদ্য সুস্বাদু হলেও দেহের জন্য মারাÍক তিকর হয়ে উঠতে পারে। জ্ঞানের ক্ষেত্রেও মানুষ প্রথমে মনে করে ছাপার অক্ষরে পড়া কিংবা পিতা-মাতা-গুরুজন আর নামী-দামী ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া সব কিছুই বুঝি মূল্যবান জ্ঞান। ক্রমশ সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সে জানতে পারে যে সব শিক্ষাই সমান গুরুত্ববহ নয়, বরং কিছু কিছু পড়া ও জানার বিষয় রীতিমত জ্ঞানের শত্রু।
আমরা অধিকাংশ মানুষই জ্ঞানের সঙ্গে অজ্ঞান ও কুজ্ঞান-এর এই তফাৎগুলো খুব সতর্কভাবে দেখি না, ফলে মানসিক বয়সন্ধির বিবিধ পর্যায়ে আটকে থাকি। এমন কি কেউ কেউ চিরকাল শিশুই থেকে যাই। এই মহাবিশ্বকে চিরশিশুর বিস্মিত ও সরল চোখ দিয়ে দেখতে পারার মধ্যে অবশ্যই একটি মাহাত্ম্য রয়েছে। কিন্তু এর সীমা সম্পর্কে সচেতন না থাকলে জগত ও মানব সমাজ নিয়ে খুব শীগগীরই ‘ছেলেমী’ শুরু হয়ে যায়। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এ সত্য অনুধাবন করে মানুষ তার চিন্তার ফসলকে দুটি পরস্পর-সম্পর্কিত কিন্তু সুস্পষ্টভাবে পৃথক ধারায় প্রবাহিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ এদের নাম দিয়েছেন ‘ভাবের কথা’ আর ‘জ্ঞানের কথা’। এর মধ্যে প্রথমটি প্রধানত ব্যক্তি-মানুষের আবেগ-অনুভূতির ফসল যেখানে বিশ্ব-সংসার প্রকৃতপক্ষে তার মনের রঙে রাঙানো। আর দ্বিতীয়টি প্রধানত সামষ্টিক মানুষের নৈর্ব্যক্তিক চর্চার ফসল যা এ বিশ্বের রহস্য উদঘাটনের দ্বারা প্রকৃতির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ এবং সে সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্র সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত।
ভাবের কথা ও জ্ঞানের কথার স্বরূপ ও পদ্ধতি উপলব্ধি করা প্রতিটি সচেতন মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরী। মানব ইতিহাসের প্রধান প্রধান মনীষীদের প্রত্যেকেই প্রথমে স্থির করতে চেষ্টা করেছেন যে কোন পদ্ধতির চিন্তাকে তিনি জ্ঞান মনে করেন আর কোনগুলিকে জ্ঞান মনে করেন না। পদ্ধতিগত এই ভিত্তির ওপরেই গড়ে উঠেছে তাঁদের চিন্তার ইমারত। যাঁরা নিজেরা জ্ঞানের ভিত্তি নিয়ে মৌলিক চর্চা করেননি তাঁরা অন্য কারো না কারো মডেল অনুসরণে নিজেদের চিন্তা বিকশিত করেছেন। এঁরা প্রত্যেকেই অনুধাবন করেছেন যে জ্ঞানের পদ্ধতিগত বিষয়টি স্পষ্ট না থাকলে জগতে বড় কিছু সৃষ্টি অসম্ভব।
একটি কথা এখানে স্পষ্ট করা দরকার যে জ্ঞানের এ পদ্ধতিগত স্পষ্টতা শুধু জ্ঞানী(!) ব্যক্তির জন্য প্রয়োজন তা নয়, এটি সবার জন্য প্রয়োজন। প্রাত্যহিক জীবনেও প্রতিটি মানুষের জানা দরকার কাদের কথাকে তিনি কতটুকু গুরুত্ব দেবেন ও কোন কোন বিষয়কে ‘জ্ঞান’ মনে করবেন। আমাদের সমাজে এই বিষয়টি অত্যন্ত ধোঁয়াটে থাকায় এখানে অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অপজ্ঞান নির্বিঘ্নে তাদের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণী আরও বেশী এর শিকার হচ্ছি কারণ ‘অর্জন’-এর সুযোগ বেশী থাকায় আমাদের মধ্যে ঘোলাটে শিক্ষার পরিমাণও বেশী।
প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয়ভাবেই আমাদের সমাজে যাঁরা জ্ঞানের বিকাশে অগ্রসর হয়েছেন, দুর্ভাগ্যবশত, তাঁরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভ্রান্ত। সুপরিকল্পিতভাবে জ্ঞানের পদ্ধতিগত সচেতনতার ভিত্তি তৈরী না করে ঢালাও পাঠাভ্যাস সৃষ্টির ফলে তরুণ ও নিষ্ঠাবান জ্ঞানার্থীকে তাঁরা কিছুদিনের মধ্যে পরিণত করছেন আপাত উজ্জ্বল ও ধারালো এক ধরনের উদ্ধৃতিজীবিতে। এসকল তার্কিক জ্ঞানার্থী প্রয়োজনে বিপরীত মেরুর দুই মনীষীর চিন্তাকেও নিজের স্বপে উদ্ধৃত করেন আর ‘প্রচুর পাঠ’-এর চোখ ধাঁধানো বিকিরণ দিয়ে খ্যাতি এবং সাফল্যও লাভ করেন। একটু চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারবো যে এ ধরনের অন্ধ পাঠ ও লাইব্রেরি আন্দোলন সমাজ ও দেশের উন্নয়নে কোন সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারবে না। ‘অজস্র পাঠ নয় নির্দিষ্ট লক্ষে সুনির্বাচিত অধ্যয়ন’-এ সত্য অনুধাবন না করলে আমরা কেবল অজস্র সম্পদ ও মেধার অপচয়ই ঘটিয়ে যাব।
এ উপলব্ধির পটভূমিতে বিগত প্রায় বিশ বছর ধরে দর্শন ক্লাব কর্তৃক আয়োজিত হচ্ছে একটি সাপ্তাহিক অধ্যয়ন সভা- চিন্তার ইতিহাস। সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন মানুষ ‘জ্ঞানের পদ্ধতি’ নিয়ে কি ভেবেছেন তার পাঠ ও আলোচনাই এ সভার উদ্দেশ্য। গ্রীসের আয়োনিয় চিন্তা থেকে শুরু করে প্রাক-সক্রেটিক যুগ ও সক্রেটিক যুগ, প্রাচীন ভারত ও চীন, মধ্যযুগ, রেনেসাঁ ও আধুনিক কালের প্রধান প্রধান চিন্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় এ অধ্যয়ন সভায়। যে সব মনীষীর মৌলিক চিন্তা পঠিত ও আলোচিত হয় তাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক-সক্রেটিক যুগের দার্শনিকবৃন্দ, প্লেটো, এরিস্টটল, ইউকিড, প্রাচীন ভারতীয় চিন্তাবিদগণ, কনফুসিয়াস, লাওৎসে, সেন্ট অগাস্টিন, শংকরাচার্য, ইবনে সিনা, আল কিন্দি, আল ফারারী, ইমাম গাজ্জালী, টমাস এ্যাকুইনাস, ইবনে খলদুন, পেট্র্যার্ক, ম্যাকিয়াভেলী, বেকন, হবস, দেকার্ত, লাইবনিজ, স্পিনোজা, লক, বার্কলে, হিউম, কান্ট, হেগেল, মার্কস-এঙ্গেলস, গ্যালিলিও, নিউটন, প্যাসকাল, ম্যাখ, রাসেল, পঁয়েকার, আয়ার, কারনাপ, রাইখেনবাখ, নিউর্যাথ, ফায়রাব্যান্ড, ভিটগেনস্টিন, পপার, ডুহেম, কুইন প্রমুখ। এসব মৌলিক চিন্তা অধ্যয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই সভায় শিল্প-সাহিত্যসহ মানব ইতিহাসের প্রধান প্রধান বিষয়গুলি স্পর্শ করা হয় যাতে সদস্যরা প্রতিটি চিন্তার কালিক পটভূমির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন।
এ তালিকা দেখে ভীত হওয়ার কারণ নেই। দর্শন কাবের এ অধ্যয়ন সভার একটি বিশেষ দিক হল যে, এত ‘ভারী ভারী’ মনীষীকেও অত্যন্ত মজার সঙ্গে পাঠ করা হয়। এ কাবের প্রথম দুই-এক ব্যাচের সদস্যরা দীর্ঘ পাঁচ-ছয় বছর চর্চার মাধ্যমে এ সকল লেখকের গ্রন্থসমূহের মধ্য থেকে ‘জ্ঞানের পদ্ধতি’ সম্পর্কিত আলোচনাগুলিকে চিহ্নিত করেছেন। এর ফলে তৈরী হয়েছে মোটামুটি একটি ‘পাঠক্রম’ যা একনাগাড়ে দু’বছর অধ্যয়ন করলেই শেষ করা যায়। এর আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি লাভ হল, মনীষীদের অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি পড়ে ভারাক্রান্ত না হওয়ার ফলে বিদ্যার্থীরা কেবলমাত্র গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো নিয়ে আনন্দময় আলোচনায় লিপ্ত হতে পারেন। একাধিক ব্যাচের বেশ কিছু সদস্য-সদস্যা (যাঁরা অধিকাংশই ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী) বর্তমানে এ আনন্দময় অধ্যয়নে মগ্ন রয়েছেন।
এ অধ্যয়ন সভায় অংশগ্রহণের জন্য যোগ্যতার ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা নেই, তবে আলোচনা যথাযথ অনুধাবনের জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি বাঞ্ছনীয়। অংশগ্রহণের জন্য কোন ফি নেই।
আগ্রহী সকলের জন্য রইল সাদর আমন্ত্রণ।
অধ্যাপক লিয়াকত আলি
সভাপতি
সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র
ঠিকানা
১/ই/১, পরিবাগ, ঢাকা-১০০০, ফোন : ৮৬২৪১৭৮
(ব্লগারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দর্শন ক্লাবের লিফলেট থেকে কম্পোজ করে পোস্টটি দিলাম। -শাহাদাত, ০১৭১৫-০০৯০০১)