বাংলাদেশে পড়াশোনার অংশটুকু চুকিয়ে উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হতে প্রতিবছর- আমাদের দেশ থেকে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে উন্নত দেশগুলোতে ভিড় জমান। এঁদের প্রত্যেকেই উল্লেখযোগ্য বৃত্তি নিয়ে তাঁদের এই উচ্চতর শিক্ষার অংশুটুকু শেষ করেন যা একাধারে তাঁদের জন্য তো বটেই আমাদের জন্যও অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের বিষয়। এমনি কিছু মেধাবী, প্রতিভাবান মানুষের মাঝে একজনের সান্নিধ্যে এসে তাঁর কাছ থেকে কিছুটা জানার এবং ছোট-খাট কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তিনি হলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বিল্লাহ স্যার। স্যারের কাছ থেকেই জানতে পারি জাপানে পি এইচ ডি ডিগ্রী নেয়াকালীন সময়ে স্যার এবং সেসময়ে জাপানে পি এইচ ডি অধ্যায়নরত কিছু বুয়েটিয়ানের অক্লান্ত পরিশ্রমে ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করেছিল জাপানে প্রকাশিত প্রথম সাপ্তাহিক ' সাপ্তাহিক ইসেহারা' ( http://www.shaptahik-isehara.com)যার উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও চালচিত্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরা। সফল যাত্রার পর এটি সফলতার সাথে পাড়ি দিয়েছিল অনেকখানি পথ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের ব্যস্ততার কারণে সফলতাটুকু বেশকিছুটা গল্প-ই হয়ে ওঠে। কিন্তু আশার কথা হল আমরা বাংলাদেশীরা জাতিগতভাবেই বেশ আশাবাদী তাই এখেত্রেও আমরা আশা করি 'সাপ্তাহিক ইসেহারা' আবারও হয়ে উঠবে সেই সময়কার মতই আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় বা তার থেকে খানেকটা বা অনেকটাই বেশী। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবারও তা তুলে ধরবে বাংলাদেশকে, আমাদের চিন্তাচেতনা ও ভাবনা কে। এই স্বপ্ন আর প্রয়াস নিয়েই আজ 'সাপ্তাহিক ইসেহারা'-য় আমার প্রকাশিত প্রথম লেখা দেয়া হল। পড়ে দেখতে পারেন। আশা করি খারাপ লাগবেনা।
অতঃপর ডোরেমন এবং অন্যান্য
ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। আমার ৬ বছর বয়সী এক মামাতো ভাইয়ের সাথে আমার সপ্তাহ খানেক আগে মোবাইল ফোনে কথা হচ্ছিল। সে গল্প করতে করতে হঠাৎ বলে উঠল, আপু তুমি একটু ‘ইন্তেজার’ কর, আমি আসছি। এইটুকু পড়েই নিশ্চয় হোঁচট খেয়েছেন, তাইনা? ঠিক তাই আমিও হোঁচট খেয়েছিলাম। সে যখন ফিরে এলো তখন সে আবারও গল্প শুরু করল এবং আমাকে আরও একবার অবাক করে দিয়ে বলল, আজকে আমি আর রাজ্য (তার বন্ধুর নাম) স্কুলে ‘ইয়ার্ড মে’ যখন খেলছিলাম তখন রাজ্য আমাকে ধাক্কা দিয়েছে, তুমি ঢাকা আসলে রাজ্যকে একটু বকে দিও তো। যাহোক অতঃপর আমি ওকে জিজ্ঞেস করি যে বাবু ‘ইন্তেজার’ মানে কি জানো??? বলল , হুম, ইন্তেজার মানে ওয়েট করা, কিন্তু নভীতা ইন্তেজার বলে তো তাই ভুলে বলে ফেলেছি। সাথে সাথেই ‘ইয়ার্ড মে’- রহস্য বুঝতে পারলাম। খেলার মাঠের বদলে ‘ইয়ার্ড’ শিখেছে সে তার নামী-দামী ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আর ‘মে’ টুকু ‘ডোরেমন’ খ্যাত নভীতার কথোপকথন থেকে পাওয়া। সত্যি কথা বলতে, আমাদের শহুরে বাচ্চাগুলোর বিনোদনের একটা বিশাল জায়গা জুড়ে আছে কার্টুন, আরও নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে ‘ডোরেমন’ নামক এই কার্টুনটি। পরিচিত প্রায় সকল বাচ্চাদের মুখে ডোরেমন এর গল্প শুনে, ষ্টেশনারী গুলোতে ডোরেমন কলম, ডোরেমন রাবার, ডোরেমন স্কেল, ডোরেমন পেন্সিল, ডোরেমন বক্স, ডোরেমন স্টিকার দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে একদিন এই বিখ্যাত কার্টুনটা দেখতে বসেছিলাম। কার্টুন দেখার বয়স বেশ আগেই পেরিয়ে গেলেও আমি একজন নিয়মিত কার্টুন দর্শক। মোটামুটি পরিচিত এবং বহুল প্রচারিত সব কার্টুন চরিত্র সম্পর্কে আমার কিছুনা কিছু ধারনা আছে বলেই বলছি সাধারণত সব কার্টুনেই একটা ইতিবাচক চরিত্র থাকে আর থাকে একটা নেতিবাচক চরিত্র। ইতিবাচক চরিত্রটিকে প্রাধান্য দিয়ে তাকে মূল চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে সেই সাথে কম-বেশী সব কার্টুনেই নেতিবাচক চরিত্রটিকে হেরে যেতে এবং নিন্দিত হতে এবং ইতিবাচক চরিত্রটিকে জিতে গিয়ে নন্দিত হতে দেখা যায়। কিন্তু ডোরেমন নামক এই বিখ্যাত কার্টুনটি একেবারেই অন্যরকম। এখানে দেখানো হয় ‘নভীতা’ নামের একটি ছোট ছেলেকে যে পড়াশোনায় অত্যন্ত অমনোযোগী। প্রায় প্রতি পর্বেই সে তার দুষ্ট বন্ধুদের, তার শিক্ষককে এবং তার মার চোখে ধুলো দিয়ে নানান অপকর্ম করে থাকে এবং এই সকল অপকর্মের জন্য সে কখনই কোনও শাস্তি পায়না কারণ ডোরেমন তাকে সাহায্য করে এবং সে শাস্তি থেকে বেঁচে যায়। আমি মোটামুটি ১৫/২০ টা পর্ব দেখলাম এবং হতাশ হয়ে লক্ষ্য করলাম সবগুলোর মূলকথা এক। শুধু তাই নয় এই কার্টুনটির সবথেকে বড় নেতিবাচক দিক হল এটি ‘হিন্দি’ ভাষাভাষী শিশুদের জন্য তৈরি করা। আপাদমস্তক হিন্দিতে ডাবিং করা এই কার্টুনটি আমাদের শিশু বিনোদনের অনেক বড় একটি জায়গা দখল করে নিয়েছে খুব দ্রুত। আরও একটি উল্লেখ করার মত বিষয় হল এই কার্টুনটি প্রায় সারাদিন-রাত ই প্রচারিত হতে থাকে বলে বাচ্চাদের টেলিভিশন দেখার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই, বেশীরভাগ বাচ্চাই দিনের অনেক বড় একটা অংশ টেলিভিশনের সামনে কাটাচ্ছে এই কার্টুনটির কল্যাণে। এতে করে তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। চোখের সমস্যা, স্থূলতা, ক্ষুধামন্দার মত রোগে আক্রান্ত শিশুর হার বেড়েছে অস্বাভাবিকহারে। সেইসাথে শিশুদের সুস্থ মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে সেটুকু বলার অপেক্ষা রাখেনা। টেলিভিশন মানুষের মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা কমিয়ে দেয় সেখানে টেলিভিশন এমন একটা অনুষ্ঠানকে সাথে নিয়ে হয়ে উঠছে শিশুদের প্রধান বিনোদন যা সত্যি হতাশাজনক। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, প্রায়-ই বাচ্চাদের আফসোস করতে দেখি কেন তাদের ডোরেমন নেই, তাহলে তাদের হোমওয়ার্ক করতে হত না, তাহলে তারা তাদের মাকে, শিক্ষকদের বোকা বানাতে পারত, অঙ্কুরেই যদি তাদের মাথায় এ ধরনের চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়া যায় তবে আমরা কি তাদের সুস্থভাবে ‘বেড়ে ওঠা’ আশা করতে পারি??? তাদের চিন্তাগুলো যে খুব বড় মাপের অপরাধ সেটা বলছিনা কিন্তু যেখানে ছোটবেলা শুরু হবার কথা ‘পিতা মাতাকে ভক্তি কর’, ‘শিক্ষক পিতার সমান’ বা ‘অন্ধজনে দেহ আলো’ এই জাতীয় নীতিবাক্য শিখে সেখানে এরকম দুষ্টুবুদ্ধি তাদের মেধা-মননের বিকাশে কতটা ভূমিকা রাখবে বা কতটা নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ আসলেই থাকেনা। সারাদিন এধরনের নেতিবাচক চরিত্র, এধরনের বুদ্ধি এবং এগুলোর প্রয়োগ দেখতে দেখতে এগুলোকে স্বাভাবিক ভাবেই তারা তাদের বাস্তব জীবনে কাজে লাগাবে বা লাগাতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক, কারণ শিশু মাত্রই অনুকরণপ্রিয়। এই অনুকরণপ্রিয়তার হাত ধরেই বাচ্চারা শিখে যাচ্ছে অনর্গল হিন্দিতে কথা বলা। এখনকার বাচ্চাদের অধিকাংশই এই ডোরেমন এর কল্যাণে হিন্দি বলতে ও বুঝতে পারে। এর পরিণতি যে খুব বেশী সুখকর না তা বলে বোঝানোর দরকার পড়েনা। নিজের ভাষা পুরোপুরি রপ্ত করার আগেই একটা বাচ্চা হিন্দি বুঝতে পারছে, কিছুটা বলতেও পারছে যেখানে দেশের কোথাও এই ভাষার চর্চা হয়না সেখানে ব্যাপারটা রীতিমত আশঙ্কা করার মত। এ ধরনের শিশু বিনোদনের আদৌ কি কোন প্রয়োজন আছে??? টেলিভিশন অপেক্ষা গল্পের বই যে অনেক বেশী আনন্দদায়ক তা শিশুকে বোঝানোর দায়িত্ব তার বাবা-মায়ের। শিশু মাত্রই কার্টুন দেখবে, গেইম খেলবে কিন্তু সেগুলো হওয়া উচিত তাদের উপযোগী। মীনা, সিসিম্পুরের মত অনুষ্ঠান আমাদের দেশে কম হলেও আছে যেগুলোর মাঝে ভালোএবং প্রয়োজনীয় কিছু দিক তুলে ধরা হয়। এই অনুষ্ঠানগুলোর সাথে শিশুকে পরিচয় করিয়ে দিন, তাকে বোঝাতে চেষ্টা করুন এগুলোই তার উপযোগী অনুষ্ঠান। বিদেশী ভাষার বা বিদেশী সংস্কৃতির অনুষ্ঠানগুলোর বিপক্ষে আমি নই তবে তা হতে হবে পরিমিত এবং শিশুদের জন্য যথাযথভাবে উপযোগী। তা না হলে এধরনের অপ্রয়োজনীয়, মাত্রাতিরিক্ত ও অনুপযোগী বিনোদন শিশুদের জন্য কতখানি সুফল বয়ে আনতে পারে, প্রশ্নটা রইল বেশ প্রকটভাবেই।
এবার আসা যাক ‘ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা’ বিষয়টিতে। আজকালকার বাবা-মায়ের প্রথম পছন্দ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই ভাষার প্রয়োজন পড়ে তাই অবশ্যই এই ভাষাটি শুদ্ধ-ভাবে শেখার এবং আয়ত্ত করার প্রয়োজন আছে। এই চিন্তা থেকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি মাধ্যম কে পছন্দ করতেই পারেন কিন্তু ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষায় প্রধান সমস্যা তাদের সবটুকু জোর থাকে শুধু এবং শুধু ইংরেজির উপর। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া একটি শিশু ডিম চিনতে না পারলেও এগ ঠিক-ই চিনতে পারছে, কলা চিনতে না পারলেও ব্যানানা চিনতে পারছে। সরি শব্দটির বাংলা যে দুঃখিত তা শিখতে শিখতে হয়ত তাদের বয়স ১০ পেরিয়ে যাচ্ছে। আপত্তি ঠিক এই জায়গাটাতেই। ইংরেজি শেখার প্রয়োজন আছে। কিন্তু নিজের ভাষাকে না চিনে এই তথাকথিত ইংরেজি চর্চার মূল্য কতটুকু??? ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে শুনেছি আর সব বিশেষ দিবসের মতই ২১ শে’ ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে অনুষ্ঠান হয় কিন্তু এই দিবসগুলোকে এতখানি আড়ম্বরের সাথে পালনের উদ্দেশ্য কি?? শুধুই কি উৎসব হিসেবে উদযাপন করা নাকি এর পেছনের গল্পটুকু, এর সাথে চলতে থাকা আমাদের সংস্কৃতিটুকুকে তুলে ধরা? তুলে যদি ধরাও হয় তবে কেন ইংরেজী মাধ্যমে পড়ুয়া একটা ৬ বছরের বাচ্চা মিল্ক বললে তার দুধের কৌটাখানা চিনতে পারে অথচ দুধ বললে তা চেনার জন্য কিছুক্ষণ তাকে ভাবতে হয়। নিজের ভাষাকে ভালোবাসা নিজের সংস্কৃতিকে ভালোবেসে নিজের মাঝে লালন করার ভিত্তিটুকু যদি ছোটবেলা থেকেই একটু একটু করে গড়ে না দেয়া হয় তবে আমরা কিভাবে তাদের সঠিক মূল্যবোধ নিয়ে বড় হবার স্বপ্ন দেখতে পারি?? এই প্রশ্নটুকু কি সব বাবা-মায়ের অন্তত একবার হলেও আসা উচিত না???
পৃথিবী, সমাজ, মানুষ সবকিছুই চরমভাবে পরিবর্তনশীল। পরিবর্তন আসবে প্রতিনিয়তই। কিন্তু তা গ্রহণ করবার আগে অন্তত একবার ভেবে দেখুন পরিবর্তনটুকু কতখানি গ্রহণযোগ্য। সন্তানকে সবথেকে সঠিক পথটি বেছে দেবার দায়িত্বটুকু বাবা-মায়ের, তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। তাই তথাকথিত পরিবর্তন, প্রচলিত সবকিছুতে বা আধুনিকতার জোয়ারে গা ভাসানোর আগে একবার ভেবে দেখুন তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে। কেবলমাত্র তখনি আপনি বেছে নিতে পারবেন সর্বোৎকৃষ্টকে, সরিয়ে দিতে পারবেন অগ্রহণযোগ্য সবকিছুকে।
সাদিয়া ফাতেমা কবীর
শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল
লেখা প্রকাশের লিঙ্কঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৪৩