somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওয়াকফ: আল্লাহর আমানত নাকি রাজনীতির হাতিয়ার?

০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


"একদিকে আমানতের আলো, অন্যদিকে লোভের অন্ধকার—ওয়াকফ কি এখনও পবিত্র আছে?"

আমি ইকবাল হোসেন। ভোপালে বাস করি। আমার বয়স প্রায় পঁইত্রিশ। জন্ম থেকে এখানেই বড় হয়েছি, এখানেই আমাদের চার পুরুষের বসবাস। আমার দাদা হায়দার আলী ছিলেন একজন ওয়াকফ তত্ত্বাবধায়ক—মসজিদ আর কবরস্থানের দেখভাল করতেন। আমি ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে যেতাম সেই মসজিদে নামাজ পড়তে, কোরআনের ক্লাসে বসতাম, আর দাদার পাশে বসে শুনতাম জমির ইতিহাস—কীভাবে এই মাটি এক ভক্ত মুসলিম আল্লাহর নামে দান করে গিয়েছিলেন যেনো ভবিষ্যতের প্রজন্ম সেবা করতে পারে।

আজ, সেই মাটি নেই।

সবুজ গেটটা যেখানে ছিল, এখন সেখানে সরকারি অফিসের সাইনবোর্ড। কবরগুলোর উপর গড়ে উঠেছে পাকাপোক্ত ভবন, আর কেউ এখন আর ওখানে ফাতেহা পড়তে আসে না। যেনো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে নাম-নিশানাহীন শত শত মানুষের আত্মার স্মৃতি। আমার ছেলেটাকে নিয়ে একদিন ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ও বলল, "আব্বু, এখানে কি আগে কিছু ছিল?"

আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।

এই বছর জানুয়ারির সেই সকালটা আমার জীবনে একটা ছায়া ফেলে দিয়েছে। উজ্জেইনে যা ঘটল, সেটা আমার জন্য কেবল খবরের কাগজের শিরোনাম নয়। সেটা যেনো আগুনের ফুলকি হয়ে পৌঁছাল ভোপালের আমার ছোট্ট জীবনেও। কয়েক ঘণ্টায় ২৫০টিরও বেশি ঘরবাড়ি, দোকান আর একটা শতাব্দীপ্রাচীন মসজিদ মাটিতে মিশে গেলো—বুলডোজার চালাল সরকার, নোটিশ ছাড়াই। আমার বোনের শ্বশুরবাড়ি ছিল উজ্জেইনে। তার ছেলেটা সেদিন ভয় পেয়ে জোরে জোরে দোয়া পড়ছিল যখন ঘরের দেয়াল কেঁপে উঠছিল।

ওয়াকফের জমি—যা ধর্মীয় দান হিসেবে একবার আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা হয়, সেটা তো আর কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি না। সেগুলো তো মুসলিম সমাজের জন্য, দরিদ্রদের জন্য, গরিব ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য। অথচ আজ, সেই জমিগুলোকে আইন করে 'সরকারি' বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। আমাদের মতন সাধারণ মুসলমানেরা কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছি, কেমন করে ধীরে ধীরে আমাদের শিকড় কেটে নেওয়া হচ্ছে।

বাবা মাঝে মাঝে বলেন, "তুই লেখালেখি করিস, একটা কিছু লিখ এইসব নিয়ে।" কিন্তু আমি জানি, কথায় কি আর দেয়াল ঠেকানো যায়?

এই নতুন ওয়াকফ আইন সংশোধনের কথা যখন সংসদে উঠল, তখন আমি প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু যেদিন শুনলাম, অমুসলিমদেরকেও ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য করা যাবে, আর জমির মালিকানা নিশ্চিত করতে বাধ্যতামূলকভাবে জেলা প্রশাসনের রেকর্ডের উপর নির্ভর করতে হবে—তখন মনে হল, আমাদের অস্তিত্বকেই মুছে ফেলার একটা সূক্ষ্ম পরিকল্পনা চলছে। মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান—যেগুলোর উপরে আমরা চোখ বুজে ভরসা করতাম, সেগুলোও আর নিরাপদ নয়।

গত সপ্তাহে এক বন্ধুর সঙ্গে ওয়াকফ অফিসে গিয়েছিলাম, তার দাদা কিছু জমি ওয়াকফ করেছিলেন। সে শুধু জানতে চেয়েছিল, জমির বর্তমান অবস্থা কী। অফিসে কেউই সঠিক কিছু বলতে পারলো না। কেউ বলল, "রেকর্ড নাই", কেউ বলল, "এটা এখন সরকারি মালিকানায়"। বন্ধুটার চোখে আমি অসহায়তা দেখলাম—ঠিক যেমন আমার নিজের চোখে দেখি প্রতিদিন।

আমার মেয়ে ইনায়া সেদিন বলল, "আব্বু, মসজিদটা আবার বানানো যাবে না?"
আমি জবাব দিতে পারিনি। কারণ এই প্রশ্নটার উত্তর কেবল কাগজে কলমে নয়, নীতিতে, সাহসে, আর সত্যে খুঁজে পাওয়া যায়।
আর সেসব আজকাল বড়ই দুর্লভ।

আমার দাদা বলতেন, "ওয়াকফ হলো আমানত। এটা আমরা ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাই। এটা রক্ষা করা মানে নিজের ইমান রক্ষা করা।"
আমি আজ সেই ইমানের ভার কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু চারদিকে শুধু ভাঙনের শব্দ। যে জমিগুলো একদিন দান করা হয়েছিল মানুষের কল্যাণে, আজ সেগুলো হয়ে গেছে রাজনৈতিক লাভের হাতিয়ার।

আমি জানি না এই গল্প কবে থামবে। জানি না কখন আবার কোনো শিশুর হাতে হাত ধরে আমি বলতে পারব, "এই জমিটা একদা আল্লাহর নামে দান করা হয়েছিল। এখানে মানুষের ভালো হতো।"

তবে আমি লিখে যাচ্ছি। যেন কেউ জানে, আমরা চুপ করে থাকিনি। আমরা স্মৃতি ধরে রেখেছি, আমরা প্রশ্ন করেছি, আমরা হারানোর গল্পগুলো লিখে রেখে গেছি—এই আশায়, যে একদিন কেউ ফিরে আসবে সেই শেকড়ের খোঁজে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১০:০০
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস ওয়ান ম্যান আর্মি!!!!!

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১০ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:৩২

ইন্টারিম সরকারে প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর একের পর এর চমক দিয়ে যাচ্ছেন ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস। ভঙ্গুর, মেরুদন্ডহীন শাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু, গৃহযুদ্ধের কাছাকাছি চলে যাওয়া একটি দেশের দায়িত্ব কাঁধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফ্রিল্যান্সারদের রক্ত-ঘামে অর্জিত অর্থ আটকে রাখার ষড়যন্ত্র: পেপ্যাল চালু না করার পেছনে কাদের হাত?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১০ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭

ফ্রিল্যান্সারদের রক্ত-ঘামে অর্জিত অর্থ আটকে রাখার ষড়যন্ত্র: পেপ্যাল চালু না করার পেছনে কাদের হাত?

পেপ্যাল লোগোটি বিবিসি ওয়েব পেইজ থেকে সংগৃহিত।

ভূমিকা

বিশ্বের প্রযুক্তিনির্ভর শ্রমবাজারে বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীরা এখন এক অনস্বীকার্য শক্তি। আপওয়ার্ক,... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বৃষ্টি এলেই মন নরম নরম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১০ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৪:৪০



যত বিতৃষ্ণা এক লহমায় যায় দূরে চলে, বৃষ্টি এলেই,
কী ফুরফুরে হাওয়া বয় দেহ জুড়ে, ভালো লাগে আমার
ভালো লাগে জমানো কর্মে মন দিতে,
দেহ যেন পাখিরর পালক, ছুটোছুটিতে নেই ক্লান্তি;
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় সার্কাস দল!!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১০ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:১৫

আওয়ামিলীগ আমলে আওয়ামি মন্ত্রী এম্পিরা বিনোদনবঞ্চিত :( এই দেশের জনগনকে বিনোদিত করত তাদের বিভিন্ন মন্তব্যের দ্বারা। এখন এই স্থান একছত্রভাবে দখল করেছে বিএনপি !! দুই রাজনৈতিক দলের নেতাদেরই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষ ইজ গুড ফর হেলথ !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১:২৩


সিরাজদিখানের মাহফুজুর রহমান সাহেবের কান্ড দেখে মনে হলো, তিনি ব্রিটিশ আমলের একটা গল্প খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছেন। গল্পটা পুরনো, কিন্তু ঘুষখোরদের মধ্যে এখনো জনপ্রিয়। এক ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট বাংলায় দুর্বল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×