"একদিকে আমানতের আলো, অন্যদিকে লোভের অন্ধকার—ওয়াকফ কি এখনও পবিত্র আছে?"
আমি ইকবাল হোসেন। ভোপালে বাস করি। আমার বয়স প্রায় পঁইত্রিশ। জন্ম থেকে এখানেই বড় হয়েছি, এখানেই আমাদের চার পুরুষের বসবাস। আমার দাদা হায়দার আলী ছিলেন একজন ওয়াকফ তত্ত্বাবধায়ক—মসজিদ আর কবরস্থানের দেখভাল করতেন। আমি ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে যেতাম সেই মসজিদে নামাজ পড়তে, কোরআনের ক্লাসে বসতাম, আর দাদার পাশে বসে শুনতাম জমির ইতিহাস—কীভাবে এই মাটি এক ভক্ত মুসলিম আল্লাহর নামে দান করে গিয়েছিলেন যেনো ভবিষ্যতের প্রজন্ম সেবা করতে পারে।
আজ, সেই মাটি নেই।
সবুজ গেটটা যেখানে ছিল, এখন সেখানে সরকারি অফিসের সাইনবোর্ড। কবরগুলোর উপর গড়ে উঠেছে পাকাপোক্ত ভবন, আর কেউ এখন আর ওখানে ফাতেহা পড়তে আসে না। যেনো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে নাম-নিশানাহীন শত শত মানুষের আত্মার স্মৃতি। আমার ছেলেটাকে নিয়ে একদিন ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ও বলল, "আব্বু, এখানে কি আগে কিছু ছিল?"
আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।
এই বছর জানুয়ারির সেই সকালটা আমার জীবনে একটা ছায়া ফেলে দিয়েছে। উজ্জেইনে যা ঘটল, সেটা আমার জন্য কেবল খবরের কাগজের শিরোনাম নয়। সেটা যেনো আগুনের ফুলকি হয়ে পৌঁছাল ভোপালের আমার ছোট্ট জীবনেও। কয়েক ঘণ্টায় ২৫০টিরও বেশি ঘরবাড়ি, দোকান আর একটা শতাব্দীপ্রাচীন মসজিদ মাটিতে মিশে গেলো—বুলডোজার চালাল সরকার, নোটিশ ছাড়াই। আমার বোনের শ্বশুরবাড়ি ছিল উজ্জেইনে। তার ছেলেটা সেদিন ভয় পেয়ে জোরে জোরে দোয়া পড়ছিল যখন ঘরের দেয়াল কেঁপে উঠছিল।
ওয়াকফের জমি—যা ধর্মীয় দান হিসেবে একবার আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা হয়, সেটা তো আর কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি না। সেগুলো তো মুসলিম সমাজের জন্য, দরিদ্রদের জন্য, গরিব ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য। অথচ আজ, সেই জমিগুলোকে আইন করে 'সরকারি' বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। আমাদের মতন সাধারণ মুসলমানেরা কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছি, কেমন করে ধীরে ধীরে আমাদের শিকড় কেটে নেওয়া হচ্ছে।
বাবা মাঝে মাঝে বলেন, "তুই লেখালেখি করিস, একটা কিছু লিখ এইসব নিয়ে।" কিন্তু আমি জানি, কথায় কি আর দেয়াল ঠেকানো যায়?
এই নতুন ওয়াকফ আইন সংশোধনের কথা যখন সংসদে উঠল, তখন আমি প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু যেদিন শুনলাম, অমুসলিমদেরকেও ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য করা যাবে, আর জমির মালিকানা নিশ্চিত করতে বাধ্যতামূলকভাবে জেলা প্রশাসনের রেকর্ডের উপর নির্ভর করতে হবে—তখন মনে হল, আমাদের অস্তিত্বকেই মুছে ফেলার একটা সূক্ষ্ম পরিকল্পনা চলছে। মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান—যেগুলোর উপরে আমরা চোখ বুজে ভরসা করতাম, সেগুলোও আর নিরাপদ নয়।
গত সপ্তাহে এক বন্ধুর সঙ্গে ওয়াকফ অফিসে গিয়েছিলাম, তার দাদা কিছু জমি ওয়াকফ করেছিলেন। সে শুধু জানতে চেয়েছিল, জমির বর্তমান অবস্থা কী। অফিসে কেউই সঠিক কিছু বলতে পারলো না। কেউ বলল, "রেকর্ড নাই", কেউ বলল, "এটা এখন সরকারি মালিকানায়"। বন্ধুটার চোখে আমি অসহায়তা দেখলাম—ঠিক যেমন আমার নিজের চোখে দেখি প্রতিদিন।
আমার মেয়ে ইনায়া সেদিন বলল, "আব্বু, মসজিদটা আবার বানানো যাবে না?"
আমি জবাব দিতে পারিনি। কারণ এই প্রশ্নটার উত্তর কেবল কাগজে কলমে নয়, নীতিতে, সাহসে, আর সত্যে খুঁজে পাওয়া যায়।
আর সেসব আজকাল বড়ই দুর্লভ।
আমার দাদা বলতেন, "ওয়াকফ হলো আমানত। এটা আমরা ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাই। এটা রক্ষা করা মানে নিজের ইমান রক্ষা করা।"
আমি আজ সেই ইমানের ভার কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু চারদিকে শুধু ভাঙনের শব্দ। যে জমিগুলো একদিন দান করা হয়েছিল মানুষের কল্যাণে, আজ সেগুলো হয়ে গেছে রাজনৈতিক লাভের হাতিয়ার।
আমি জানি না এই গল্প কবে থামবে। জানি না কখন আবার কোনো শিশুর হাতে হাত ধরে আমি বলতে পারব, "এই জমিটা একদা আল্লাহর নামে দান করা হয়েছিল। এখানে মানুষের ভালো হতো।"
তবে আমি লিখে যাচ্ছি। যেন কেউ জানে, আমরা চুপ করে থাকিনি। আমরা স্মৃতি ধরে রেখেছি, আমরা প্রশ্ন করেছি, আমরা হারানোর গল্পগুলো লিখে রেখে গেছি—এই আশায়, যে একদিন কেউ ফিরে আসবে সেই শেকড়ের খোঁজে।