সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস মেক্সিকো হতে ২০০৯ এর এপ্রিল থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং এ পর্যন্ত বিশ্বের অনেক দেশেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। মেক্সিকো, আমেরিকা, ব্রাজিল, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে শতাধিক মানুষ মারা গেছেন। ব্রাজিল সবচেয়ে ঝুকির মধ্যে আছে। ব্রাজিলে এ পর্যন্ত সর্বাধিক লোক মারা গেছে, মৃতের সংখ্যা ৫৭৭। আফ্রিকার প্রায় ২০ টি দেশে সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস নিশ্চিত করা হয়েছে। এই ভাইরাস অনেক দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পরতে পারে বলে বিশেষজ্ঞগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশে এই প্রথম রাজধানীর ধানমন্ডির বেসরকারী ল্যাবএইড হাসপাতালে মিতা চক্রবর্তী (৩৫) নামে এক রোগী গতকাল রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
সোয়াইন ফ্লু?
মানুষের মত শুকরেরও ফ্লু হতে পারে কিন্তু মানুষ যেসব ফ্লু দ্বারা সচরাচর আক্রান্ত হয় সেগুলোর মত না। বর্তমানে যে মহামারী আকারে সোয়াইন ফ্লু ছড়িয়ে পড়েছে এর আগে এরকম দেখা যায় নাই। শুধুমাত্র যারা শুকরের সংস্পর্শে আসত তারা আক্রান্ত হত এই ভাইরাস দ্বারা। এখন যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে তা আগের ভাইরাস গুলোর থেকে ভিন্ন কারণ এই ভাইরাসটি একজন থেকে আর একজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। World Health Organization (WHO) এর নাম দিয়েছে "Pandemic (H1N1) 2009" ।
কিভাবে ছড়ায়:
এই ফ্লু ছোঁয়াচে, অন্যান্য মৌসুমী ফ্লুর মত একজন থেকে আর একজনকে আক্রান্ত করে। হাঁচি, কাশি বা করমর্দনের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। যাতে এই ভাইরাস ছড়াতে না পারে এজন্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাঁচি, কাশির সময় নাক/ মুখ রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এই সময় বাইরে বের হওয়া যাবেনা। তাদের হাত নিয়মিত পরিস্কার রাখতে হবে। যতদূর সম্ভব সুস্থ লোক থেকে দূরে রাখতে হবে।
উপসর্গ:
সববয়সী মানুষের মাঝে এই সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস ছড়ায়। এই ফ্লুর উপসর্গ অন্যান্য ফ্লুর মতই। যেমন তিন দিনের বেশী জর, সর্দি, কফ, শ্বাসকষ্ট, গলা ব্যথা,শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, ঠান্ডা লাগা, অবসন্নতা ইত্যাদি। এই ফ্লু হলে অনেকের এই উপসর্গগুলোর সাথে ডায়রিয়া/ বমিও হতে পারে। এই উপসর্গগুলোর মধ্যে কমপক্ষে দুইটি উপসর্গ থাকে। কিন্তু অন্য কারণেও এই উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সুতরাং একমাত্র ল্যাবটেষ্টই বলা যেতে পারে রোগী সোয়াইন ফ্লু আক্রান্ত কিনা।
চিকিৎসা:
গত ২৭/০৮/০৯ তারিখ পর্যন্ত ১৪৪ জন আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে Institute of Epidemiology, Disease Control and Research(IEDCR) & National Influenza Centre (NIC), Bangladesh (Mohakhali, Dhaka-1212 ; [email protected]; http://www.iedcr.org) থেকে। আজকে পর্যন্ত ২৪৭ জন আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে এবং আগামী ২ সপ্তাহ বাড়বে বলে জানা গেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেছেন আর টেস্টের দরকার নেই, ফ্লু মনে হলেই চিকিৎসা দিতে হবে, যাতে সোয়াইন ফ্লুর প্রকোপ না বাড়ে। বাংলাদেশে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফ্লু আক্রান্তের সময়। সিজনাল ফ্লু এবং সোয়াইন ফ্লু নিয়ে গবেষণা করছে IEDCR এবং ICDDR,B (মহাখালী) এবং এখান থেকে ফ্লু টেষ্ট করানো যায়। বর্তমানে সোয়াইন ফ্লুর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে এন্টিভাইরাল Oseltamivir এবং Zanamivir, তবে বাংলাদেশে Oseltamivir ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারীভাবে এই Oseltamivir জেলা পর্যায়ে পৌঁছানো হচ্ছে। যার একটি কোর্সে ১০টি ক্যাপসুল থাকে। আপাতত সরকার ৪০,০০০ কোর্স Oseltamivir সংগ্রহ করবে এরপর আরও ২০০০০০ সংগ্রহ করবে ২০০৯ এর ডিসেম্বরের মধ্যে। WHO জরুরী ১১০০০ Oseltamivir; ৮০০০ N95 mask এবং ২০০০০ সার্জিক্যাল মাস্ক পাঠিয়েছে। DGHS, ২০ হাজার সার্জিক্যাল মাস্ক পাঠিয়েছে। Personal Protective Equipment (PPE) জেলা পর্যায়ে পৌঁছানো হচ্ছে। ঢাকার মহাখালীর Chest Disease Hospital (NIDCH) প্রয়োজনীয় সেবা দিতে প্রস্তুত। এ পর্যন্ত ৫০০০ জন ফিজিশিয়ান ট্রেইনআপ করা হয়েছে এবং ৩০ টি জেলায় এই সেবা পাওয়া যাবে। এই বছরের শেষের দিকে বাকী জেলাগুলোতে সেবা পাওয়া যাবে।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
নিম্নে WHO কর্তৃক প্রস্তাবিত ১০ টি ব্যবস্থার কথা বলা হলো যা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে:
১. আপনার হাত পরিস্কর রাখুন: সাবান দিয়ে প্রায়শই হাত পরিস্কার করুন
২. পর্যাপ্ত ঘুমান: অন্ততপক্ষে ৮ ঘন্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন। যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে।
৩. পর্যাপ্ত পানি পান করুন: কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন যা শরীর থেকে বর্জ্য নিস্কাশনে সহায়ক হবে।
৪. শক্তিবর্ধক খাবার খান: চর্বি জাতীয় খাবারের চেয়ে বেশী করে শস্য, শাকসবজি, ফলমূল খান।
৫. এলকোহল পরিত্যাগ করুন: এলকোহল শরীরের অবসাদ বাড়ায় যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লোপ করে।
৬. শারীরিক ভাবে কর্মদক্ষতা বাড়ান (শরীরচর্চা): অন্ততপক্ষে সপ্তাহে ৩/৪ দিন দ্রুত ৩০/৪০ মিনিট হাঁটুন। যা শরীরের অবসাদ দুর করবে, ঘামের মাধ্যমে বর্জ্য বের হবে। রক্তের অক্সিজেন সার্কুলেশন বৃদ্ধি পাবে এবং চিন্তা মুক্ত করে শরীরকে চাঙ্গা রাখবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।
৭. যেকোন ধরনের সংস্পর্শ থেকে সচেতন হতে হবে: যেমন কারো সাথে করমর্দনের পর বা কারও ব্যবহৃত কলম বা অন্য কোন জিনিস নাড়ার পর অবশ্যই আগে হাত পরিস্কার করতে হবে- তার আগে হাত মূখমন্ডলে দেয়া যাবেনা।
৮. অসুস্থ লোকের সংস্পর্শ পরিত্যাগ করতে হবে: হাঁচি/ কাশির মাধ্যমেই ফ্লু ছড়ায়। সুতরাং রুমাল ব্যবহার করতে হবে এবং ঘনঘন রুমাল পরিস্কার করে নিতে হবে। অসুস্থ লোকের সংস্পর্শ পরিত্যাগ করতে হবে/ নিদেনপক্ষে ২০ ফুট দূরে থাকতে হবে।
৯. কখন সেবা দরকার তা জানতে হবে: সোয়াইন ফ্লু এবং অন্যান্য ফ্লুর মধ্যে বেসিক তেমন পার্থক্য নেই। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তার দেখাতে হবে। যদি আপনার এলাকা সোয়াইন ফ্লু প্রবন হয় তাহলে যথাশীঘ্র ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
১০. সচেতন থাকতে হবে নিজেকে এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে।
নিম্নে হাসপাতাল সমূহের নাম দেয়া হল যেখানে প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়া যাবে।
সরকারী হাসপাতাল:
১. ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
২. স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
৩. শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
৪. ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর ডিজিজ অব চেষ্ট এন্ড হসপিটাল (NIDCH)
৫. ইনফেক্সাস ডিজিজ হসপিটাল
বেসরকারী হাসপাতাল:
১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি হাসপাতাল)
২. বারডেম (BIRDEM)
৩. বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ধানমন্ডি
৪. উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল, উত্তরা
৫. হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
৬. ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
৭. ঢাকা শিশু হাসপাতাল
৮. সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন:
১. মহানগর শিশু হাসপাতাল
২. মহানগর জেনারেল হাসপাতাল (কর্মজীবি হাসপাতাল)
সিটি কর্পোরেশন হেল্থকেয়ার সেন্টার (এনজিও দ্বারা পরিচালিত ৯৫টি)
আরও জানতে চাইলে: প্রিয়জন হারিয়ে যাওয়ার আগেই আসুন সতর্ক হই
ডিসক্লেইমার: এখানে তথ্যগুলো বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে এবং টিভি ও পত্রিকা থেকে নেয়া। অনেকে হয়ত সোয়াইন ফ্লু সম্পর্কে জানেন। যারা জানেন না তাদের জন্য এখানে তুলে ধরা হলো।