লেখালেখির অল্প স্বল্প অভ্যাস এক সময় ছিল। 'এক সময়' শব্দটার মধ্যে কেমন একটা প্রাচীন, প্রাচীন গন্ধ, তাই না? প্রাচীন তো বটেই, ৪০ বছর, কম সময় তো নয়।
সময়ের সাথে, সাথে সব কিছু বদলে যায়। এক সময় একটা হারমোনিয়ামের অভাবে গান শিখতে পারিনি। যখন হারমোনিয়াম কেনার সামর্থ হল, তখন গান শেখার নেশাটা ছেড়ে চলে গেল আমায়।
সামহয়ার ইন ব্লগের সাথে যারা ২০০৬ এর কিছু আগে থেকে পরিচিত তাদের কাছে 'প্রাপ্তি' নামটা অনেক চেনা। কারণ সেই সময় প্রাপ্তি (আমার ভাতিজি) একটা অসাধারন কাজ করেছিলো। ব্লগের অনেকগুলো অচেনা মুখকে একসাথে করেছিল। তারা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পরেছিল আমার ভাতিজি প্রাপ্তি কে সুস্থ্য করার সংকল্পে, মানবতার টানে। প্রমাণ করেছিল মানবতার শক্তি। 'প্রাপ্তি' ছিল এতগুলো মানুষের 'মানুষের জন্য মানুষ' এর উজ্বল দৃষ্টান্ত। জানা-আরিল ছিলো আমাদের উৎসাহ, উদ্দীপনার প্রাণকেন্দ্র। ছোট্ট মেয়ে প্রাপ্তি লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত ছিল। অমি রহমনা পিয়াল আহবান করেছিল পাশে দাঁড়াতে। ছুটে এসেছিল সবাই। তাদের সেই চেষ্টা বৃথা যায়নি। প্রাপ্তি এখন সুস্থ, জয় হয়েছে আমাদের একটি যুদ্ধের।
সেই সময় কালপুরুষ দা'র ছাদের আড্ডা আমাদের অনেকের জন্য ছিল গাড়ির ট্যাংকিতে তেল ভরার মত। টুটুল, কৌশিক ভাই , শরৎ, আরিফ জেবতিক, পিয়াল, মেজবাহ য়াযাদ, রাগ ইমন (পিংকি), পথিক (মামুন ভাই), ঝড়ো হাওয়া (ইমরান), ভাস্কর দা, আবু-সালেহ, একরামুল হক শামীম, সাতিয়া মুনতাহা নিসা, আইরিন সুলতানা, সবার নামও মনে নেই এখন, হুটহাট হানা দিতাম কালপুরুষের বাড়িতে। ভাবি পরম ধৈর্য্য নিয়ে আমাদের অত্যাচার সহ্য করতেন। আড্ডার বাইরেও কিছু মানুষ ছিল আমাদের সাথেই, সাদিক, অরুপ-মাশিদ, গোপাল-ভাড় (তানভির), জানতে চাই (বন্যা), কাশফুল, গোধূলি , সন্ধ্যাবাতি, আস্ত-মেয়ে. শাহানা, অরুন, ত্রিভূজ, হাসান, শাওন, সুনীল সমুদ্র, নেমেসিস, মনজুর হক, মাহবুব মোর্শেদ, সুশান্ত দাস গুপ্ত, বিহংগ, মোস্তফা মনির সৌরভ, ক্যামেরাম্যান (রন্জু ভাই), রাত মজুর, ধানসিঁড়ি, সামি মিয়াদাদ, কনফুসিয়াস, আরাফাত, ফ্রুলিংস, মানবী আরো কত, কত নাম। সামহোয়ার ইন ব্লগে লেখা একটা নেশা হয়ে গিয়েছিল, তারপর টের-ই পেলাম না কখন সেটা চুপচাপ আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
আজকের আমি কিছু মানুষ আর কিছু সংগঠনের কাছে চির কৃতজ্ঞ : ছোট বেলার 'আবহমান' আর বড় বেলার 'বাংলাদেশ স্কাউটস'। নিজের গন্ডির বাইরের জগৎটাকে চিনেছি এঁদের হাত ধরেই। ছবি ভাই, যার আত্না পরে থাকতো 'আবহমান' কে ঘিরে। শাহরিয়ার ভাই, মুন্না ভাই, কাজল ভাই, মনসুর ভাই, তাইমুর ভাইয়ের মত কিছু পাগলাটে যুবক তখন আমাদের মত ছোট, ছোট শিশুদের সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য নিজেদের নাওয়া-খাওয়া সব ভুলে দিনরাত পার করতো। শাহরিয়ার ভাইয়ের বিয়ের বরযাত্রা হয়ে গিয়েছিলাম আমরা সব 'আবহমান' এর বিচ্ছু বাহিনী। লুনা, ছন্দা, রানা ভাই, বাবলু, মানিক, বিটুল, শুভ, সারিয়া গং (আমি আর আমার সব বোনেরা ), আমাদের সবার জীবনে 'আবহমান' এর বিশাল অবদান। আবহমান নিযে লিখলে একটা আস্ত বই লিখে ফেলা যায়। হারিয়ে গেছে 'আবহমান' অনেক আগেই, ছেড়ে চলে গেছে 'ছবি ভাই' ও।
প্রায় ১৫ বছর পাগলের মত স্কাউটিং করেছি। হারিয়েছি অনেক, পেয়েছিও অনেক। বাংলাদেশ স্কাউটস্ এর হয়ে দেশে-বিদেশে চষে বেড়িয়েছি। পেয়েছি রফিক স্যার, রিপন ভাই, হাবিবুল আলম স্যার, ফজলুর রহমান স্যার, মরহুম মনযুরুল করিম স্যার সহ আরো অনেক, অনেক মানুষের সান্নিধ্য আমার জীবনের উজ্বল এক অধ্যায়। স্কাউটিং নিঃশন্দেহে আমার 'প্রেম'। ব্যক্তি ও কর্ম জীবনে যতটুকু সফলতা অর্জন করেছি, যতটুকু বিবেক এখনও আমায় ভালো কে ভালো, মন্দ কে মন্দ বলায় , তার জন্য স্কাউটিং এর অবদান অনেক বেশি। স্কুলের বাইরে, আমার বন্ধু জগতটা মোটামোটি পুরোটাই স্কাউটিং এর বন্ধু। বাংলাদেশ স্কাউটস্ এর সাথে সেই সূতোটাও এখন অনেক দূর্বল। কিছু মানুষের টানে সেটা আটকে আছে কোথাও। কিন্তু মূল সূতোটা আমায় ছেড়ে চলে গেছে অনেকই আগেই।
স্কুলের বান্ধবিদের মনে পরে খুব। ওদের নিয়ে এক সময় ডায়েরি লিখতাম। হারিয়ে গেছে ডায়েরিটাও।
কলেজের বন্ধুরা এখনও আছে, টানটা গভীর, শুধু সময়টা নিঃষ্ঠুর।
ভালো থাকার জন্য কিংবা ভালো রাখার জন্য দেশের ক্যারিয়ার, পরিবার, চেনা শহর, চেনা গন্ধ সব ছেড়ে এই প্রবাস জীবন। সারাদিন গাধার খাটুনি, বিনোদনের মধ্যে অল্প কিছু কাছের মানুষ যারা এই দেশে আামদের আত্নীয়-বন্ধু, তাদের সাথে সময় মিলিয়ে আড্ডা , গল্প, খাওয়া-দাওয়া, স্মৃতি উগড়ে দেয়া। সেদিন এক আড্ডায় আমাকে বললো পছন্দের একটা গান বলেন আপু। কেমন ধাক্কা লাগলো বুকে। হঠাৎ মাথাটা শূণ্য লাগলো, কোন পছন্দের গান মনে আসলো না। তবে কি গানেরা অভিমান করে আমাকে ছেড়ে চলে গেল?
অনেক কিছুই ইচ্ছে করে, কিন্তু উপায় নেই। জীবনের অনেকটা সময় অনেক অবহেলায় হারিয়ে এখন শুধু 'সময়'টাই বড্ড অল্প, কাজ অনেক বাকি। কোন কিছুরই অভাব নেই, তবুও কী যেন নেই, কী যেন নেই। খুব খা, খা করা বুকের ভীতর, শুধুই হারিয়ে যাওয়া অতীতের গন্ধ।