তোমায় সাজাব যতনে কুসুমে রতনে
কেয়ূরে কঙ্কণে কুঙ্কুমে চন্দনে।।
কুন্তলে বেষ্টিব স্বর্ণজালিকা, কণ্ঠে দোলাইব মুক্তামালিকা,
সীমন্তে সিন্দুর অরুণ বিন্দুর– চরণ রঞ্জিব অলক্ত-অঙ্কনে।।
রবিঠাকুরের এ গানের কলির কুসুমে রতনে কেয়ুরে কঙ্কনে সাজের বর্ণনায় চোখের সামনে ফুটে ওঠে মনি মানিক্য অলঙ্কার শোভিত, চোখে মোটা কাজল, কপালে কারুকার্য্যময় টিপ, বিনুনীতে ঝুলানো গোড়ের মালায় এক সুসজ্জিতা অপরুপা নারীমূর্তী। যদিও আধুনিক যুগে এসব সাজ প্রায় অচল তবুও গায়ে হলুদ বিয়ে বা বৌভাতের অনুষ্ঠান বা যে কোনো সনাতনী উৎসবে বাঙালী রমনী সাজতে ভালোবাসে সেই সব আদি পৌরানিক সাজেই।
তবে আমি আজ বাঙ্গালী রমনীদের সাজসজ্জা নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছিনা। আমি আজ বলতে চাচ্ছি বাঙ্গালীর প্রিয় সংস্কৃতির একটি শাখা শাস্ত্রীয় নাচের বিশেষ সাজগুলির বৈশিষ্ঠাবলী নিয়ে।
নৃত্য বা নৃত্যকলার ইংরেজি প্রতিশব্দ Dance এসেছে প্রাচীন ফ্রেঞ্চ শব্দ Dancier থেকে, যা মূলত দৈহিক প্রতিভঙ্গিমা, তবে তা প্রতিদিনের ব্যবহার্য্য জীবনের প্রতিভঙ্গিমা নয়। এতে আছে গতি, মুদ্রা, সংযম ও ছন্দ।নৃত্যকলা শিল্পের এমন একটি শাখা, যা খুব সম্ভবত প্রাচীনতম।
উচ্চা্ঙ্গ বা শাস্ত্রীয় নৃত্য বলতে মূলত ভরতনাট্যম, কথাকলি, কশুক, ওডিশি ও মণিপুরী নৃত্যকেই বুঝানো হয়। যদিও এই নৃত্যের উৎপত্তি প্রাচীন ভারতে তবে বাংলাদেশেও সমানভাবেই তা সমাদৃত। প্রাচীন মন্দিরগুলিতে দেবদেবীর পৌরানিক ভাস্কর্য্য ও প্রামাণিক তথ্য থেকে উচ্চাঙ্গনৃত্যের সৃষ্টি হয়েছে বলেই ধারনা করা হয়। তবে যুগের পরিবর্তন আর বিবর্তনে ভারতীয় এ নৃত্যকলা বর্তমানে এক অপূর্ব শিল্পে পরিণত হযে়ছে। এ নৃত্যের নানা কৌশল, মুদ্রা, নির্দেশ ভরতমুনি তাঁর নাট্যশাস্যে বর্ণনা করে গেছেন। নাট্যশাস্যের ভিত্তিতে সংগঠিত এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি দ্বারা পরিবর্তিত ও বিকশিত হয়ে এই ধ্রূপদী নৃত্যধারাই এখন উচ্চাঙ্গনৃত্য নামে পরিচিত।
ভরতনাট্যম
এটি ভারতীয় নৃত্যের সর্বাপেক্ষা লালিত্যযুক্ত ও লাবণ্যমণ্ডিত নৃত্যধারা। এ নৃত্যে শিল্পীরা নানা অভিব্যক্তি বিভিন্ন মুদ্রায় বিভিন্ন অর্থ বহন করে। দৃষ্টি নিক্ষেপের মাধ্যমে লজ্জা ও উপেক্ষা, ভ্রৃ এর কাজে ভয় ও সন্দেহসহ বিভিন্ন মুদ্রা, তাল লয় ও ছন্দে মনের সূপ্ত অনুভৃতি প্রকাশ পায়। এক কথায় বলা যায়, এ নৃত্য শিল্পকলার অন্তর্নিহিত ভাব ও আবেগকে দেয় প্রতীকী রূপ।
ভরতনাট্যমের সাজ-
এ নৃত্যে পোশাক, প্রসাধনী ও অলঙ্কার ব্যবহারে বৈচিত্র্য রয়েছে। প্রাচীন মন্দিরের মূর্তি থেকে পোশাকের নকশা ও সাজসজ্জার আদলে পোশাক এবং অলঙ্কারে আনা বৈচিত্র্য এই নৃত্যকে সুষমামণ্ডিত করতে সাহায্য করে। ভারী গহনা, সিঁথিপাটি,ঝুমকা, ঝুলানো সীতাহার, ছোট বিছাহার, কোমর বিছা ও কঙ্কনের সাথে সাথে শিল্পী মাথায় পরে পৌরানিক দেবীদের আদলে শোলা দিয়ে তৈরী গহনা। চুলে জরি বিজড়িত বেড়ি খোঁপা ও সাথে লম্বা বিনুনীরও চল রয়েছে। এই লম্বা বিনুনী বাঁধা হয় বিশেষ প্রক্রিয়ায়।কালো নেট জড়িয়ে তাতে কখনও কখনও বসিয়ে দেওয়া হয় কারুকার্য্যময় সোনালী বা রুপোলী ফুলের কাঁটা, বিনুনীর প্রান্তদেশে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বিশেষ ঝালর।
কথাকলি
কথাকলির জন্ম দক্ষিন ভারতে। মহারাজ বীর কেরলা বর্মা এর প্রবর্তক। এ নৃত্য মন্দির প্রাঙ্গণ অথবা উন্মুক্ত ময়দানে হযে় থাকে। মধ্যযুগের সূচনা থেকে এ ধ্রূপদী নৃত্যের ধারা ও শৈলীতে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষণীয়। এর মূল উৎস ছিল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা এবং বিবর্তনে ছিল কালারী বা জিমনাসিয়ামের প্রভাব। কালারী হচ্ছে যুদ্ধবিদ্যা শেখার আখড়া। এখানে গোষ্ঠীপ্রধান ছাড়াও বিভিন্ন যোদ্ধা রণকৌশল শিখত। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণরা কালারী থেকে রণবিদ্যা শিখে একে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে রৃপান্তরিত করে এবং তাকে নৃত্যের মাধ্যমে এক বিশেষ মর্যাদা দেয়। দৈহিক কসরত ও মনোরঞ্জনের উপাদানই ছিল কথাকলি নৃত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বৈচিত্র্যময় চরিত্রগুলিতে নাট্যধর্মিতা ছিল অনেক বেশি। তাই কথাকলি কাহিনীমূলক নৃত্যনাট্যে রুপান্তরিত হয়। এ নৃত্য সাধারণত পুরূষরাই করে থাকে। নারী-চরিত্রেও পুরূষরাই অংশগ্রহণ করে।
কথাকলি-সাজ
কথাকলি নৃত্যে নানা রঙের পোশাক, অলঙ্কার ও মুখোশের মতো বিচিত্র সাজসব্ধায় আবৃত থাকে শিল্পীর মুখমণ্ডল, যা দর্শকমনে বিস্ময়কর অনুভৃতি জাগায়। মুখে নানা রঙের জটিল নকশা, বর্ণাঢ্য এবং জাঁকজমকপূর্ণ পোষাক কথাকলি নৃত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
কশুক
কশুক উত্তর ভারত, লক্ষণৌ এবং জয়পুর অঞ্চলের নৃত্য। এর শুরু কবে হযে়ছিল তা জানা যায় না। এ সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তি আছে। তবে বিভিন্ন ধর্মীয় কাহিনী থেকে অনুমিত হয় যে, ভারতীয় অন্যান্য উচ্চাঙ্গনৃত্যের মতোই মন্দিরপ্রাঙ্গণে কশুকের জন্ম। শিল্পীরা নতুন নতুন চিন্তায় কশুক নৃত্যকে নব নব ভঙ্গি ও রসে বিকশিত করে তোলেন। প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞরা যেমন রাগসঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছেন, তেমনি কশুক শিল্পীরাও নতুন উদ্দীপনায় নৃত্যের আঙ্গিকে পরিবর্তন আনেন। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিযে় নতুন নতুন ছন্দ, লয় ও তাল উদ্ভাবন করে সৃষ্টি করেন।
কশুকের সাজ-
কশুক নৃত্যে পোশাকে বৈচিত্র্য রয়েছে। কশুক নৃত্য পুূরুষদের ধুতি ও নগ্ন শরীর, মেয়েদের ঘাগরা ও কাঁচুলির পরিবর্তে পারস্য ঢঙে চোগা-চাপকান, চুড়িদার-পাজামা ও পেশোয়াজের ব্যবহার শুরু হয়। উভয়েরই মাথায় থাকত টুপি। এ সব পোশাক ছিল জরিবুটি খচিত এবং দেখতে খুব সুন্দর ও আকর্ষণীয়।
মণিপুরী নৃত্য
ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রাজ্য মণিপুর। মনিপুরী নৃত্যের উৎপত্তি সেখানেই। নৃতাত্ত্বিকদের মতে এ এলাকায় অনেক উপজাতির বাস ছিল। এখানকার অধিবাসীরা জাতি হিসেবে মৈতি নামে পরিচিত। মৈতিরা অতি প্রাচীনকাল থেকেই বনদেবতার পূজা করে আসছে। মণিপুরী সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো নৃত্য। মণিপুরী নৃত্য হিন্দুধর্ম দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। সাধারণত কীর্তন এবং মণিপুরী ভাষা ও ব্রজবুলি মেশানো গানের সঙ্গে এ নৃত্য পরিবেশিত হয়। মণিপুরীরা অধিকাংশই বৈষ্ণ ধর্মাবলমবী। তারা অতি সরল, বিনয়ী ও কৃ্পভক্ত। তাই তাদের নৃত্যও ভক্তিমূলক এবং অতি কোমল ও মধুর। মণিপুরী নৃত্যের মধ্যে ভঙ্গিনৃত্যই প্রধান। ভঙ্গিনৃত্য আবার দুই প্রকার তাণ্ডব ও লাস্য। তাণ্ডব সাধারণত ছেলেরা পরিবেশন করে এবং লাস্য মেযে়রা। মণিপুরী নৃত্যে বহু জটিল তালের ব্যবহার হয়।
মনিপুরী নৃত্যের সাজ-
মণিপুরী নৃত্যের পোশাক-পরিচ্ছদ খুবই আকর্ষণীয়। বিশেষ করে রাসনৃত্যে মেয়েদের ঘাগরা কাঁচ ও কারুকার্য্যময় এমব্রয়ডারির নানা নকশায় পূর্ণ। সঙ্গে থাকে কোমরবন্ধনী ও হালকা-পাতলা ওড়নায় ঢাকা মস্তক-চৃড়া। ছেলেদের, বিশেষ করে কৃ্ষ্ণের পোশাক ধুতি ও মাথায় ময়ূরের পাখায় আবৃত চৃড়া। এ ছাড়াও লাইহারাওবা নৃত্যে থামি ব্যবহার করা হয়। ছেলেদের অন্যান্য নৃত্যে ধুতির ব্যবহার করা হয়।
ওডিশি নৃত্য
এই নৃত্য ভারতের উড়িষ্যা প্রদেশের নৃত্য। উড়িষ্যার বহু প্রাচীন মন্দিরে নানা দেবদেবীর ভাস্কর্যে নৃত্যগীতের প্রমাণ আছে। এসব মন্দিরে নর্তকীরা দেবতাদের উদ্দেশ্যে নৃত্য পরিবেশন করত, যাদের বলা হতো মাহারী। উড়িষ্যার সূর্যমন্দিরে এ নৃত্যের অনেক নিদর্শন আছে।মন্দিরের স্থাপত্যচিত্রে প্রচুর নৃত্যভঙ্গিমার উপস্থাপনা থেকে বোঝা যায় যে, উড়িষ্যাবাসীদের জীবনের অন্যতম অঙ্গ ছিল নৃত্য। উড়িষ্যার বিভিন্ন স্থানে নির্মিত মন্দিরগাত্রে অপরৃপ সুন্দর নৃত্যশিল্পীদের ত্রিভঙ্গ শৈলীর বহৃ ভাস্কর্যচিত্র দেখা যায়। ওডিশি নৃত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর সৌন্দর্য ও অনুপম ভঙ্গিমা।
পোশাক ও অলঙ্করণে ভরতনাট্যমের সঙ্গে ওডিশি নৃত্যের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, তবে অঙ্গভঙ্গিতে পার্থক্য আছে।ওডিশি নৃত্যের বিভিন্ন প্রয়োগ-কৌশল আয়ত্ত করা সহজ, কিন্তু এর প্রধান বিষয় ছন্দ বা তাল রপ্ত করা খুব কঠিন।
ওডিসির সাজ-
পোশাক ও অলঙ্করণে ভরতনাট্যমের সঙ্গে ওডি়শি নৃত্যের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, তবে অঙ্গভঙ্গিতে পার্থক্য আছে।ওডিশি নৃত্যের বিভিন্ন প্রয়োগ-কৌশল আয়ত্ত করা সহজ, কিন্তু এর প্রধান বিষয় ছন্দ বা তাল রপ্ত করা খুব কঠিন। ওডিসি নৃত্যে অন্যান্য অলঙ্কারের সাথে সাথে রুপোলী কোমর বন্ধনী বা চওড়া বিছা এবং মাথার খোঁপার উপরিভাবে বসানো ধাতব গোলাকার গহনা বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য বহন করে।
কত্থক-
কত্থক শাস্ত্রীয় নৃত্যের একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ধারা। প্রাচীনকালে বিভিন্ন দেবদেবীর মহাত্ন বর্ণনায় কয়েকটি সম্প্রদায় ছিলো যারা নৃত্য ও গীত দিয়ে দেবদেবীর মহাত্নাবলী পরিবেশন করতেন। এসব সম্প্রদায়গুলো কথক, গ্রন্থিক, পাঠক ইত্যাদি নামে পরিচিত। সবকটির মধ্যে কত্থক একটি বিশেষ স্থান আজও অধিকার করে রয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে ধর্মীয় উৎসব ও মন্দির কেন্দ্রিক পরিবেশনা হওয়ায় কত্থক নৃত্যের কোনো সুসংহত রুপ গড়ে ওঠেনি। মোঘল আমলে দরবারী সংগীত ও নৃত্যের যুগ সুচিত হলেই কত্থক নৃত্যের একটি সুসংহত রুপ গড়ে ওঠে।
কত্থকের সাজ-
কত্থক নৃত্যের প্রধান পোষাক লম্বা গোড়ালী পর্যন্ত পেশোয়াজ নামক এক ধরণের সিল্কের জামা ও চুড়িদার পাজামা। এ নাচে উজ্জল প্রসাধন ও অলংকার ব্যাবহৃত হয়। মাথায় মুকুট বা তাজ ও চুলে ঝাপটা, সিঁথীতে টিকলী ও চুড়ো করে বাধা খোঁপায় ওড়না বিশেষভাবে আটকানো থাকে। ঘুঙ্গর, পায়ে আলতা এ নাচের অপরিহার্য্য অংশ।
এছাড়াও প্রাচীন জনপদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে নাচ প্রচলিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মিশরীয় দেয়ালচিত্রে ও ভারতীয় গুহাচিতে নৃত্যকলার বিভিন্ন ভঙ্গী দেখতে পাওয়া যায়। নৃত্যকলার ব্যবহার যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে নাচের এই ব্যবহার ব্রাজিলীয় সংস্কৃতি থেকে শুরু করে ভারতীয় সংস্কৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত। লোকসংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়া এই নৃত্যকলাই হচ্ছে লোকনৃত্য। লোকনৃত্য নৃত্যকলার অন্তর্ভুক্ত হলেও কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে তা শাস্ত্রীয় বা ক্লাসিক নৃত্য থেকে কিছুটা আলাদা। লোকনৃত্য ছন্দের কঠোর নীতি খুব একটা অনুসরণ করে না। ক্লাসিক নৃত্যের তুলনায় লোকনৃত্যে সংযম ও ছন্দের অভাব রয়েছে, কারণ এতে মুদ্রার ব্যবহার খুব একটা নেই। লোকনৃত্যের গতি, ছন্দ, অঙ্গকৌশল অনেকটা বাস্তব জীবনের কাছাকাছি।
শাস্ত্রীয় নৃত্যের ক্ষেত্রে পোশাক ও সাজসজ্জা একটি অপরিহার্য বিষয়। কিন্তু লোকনৃত্যের ক্ষেত্রে পোশাক তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। লোকনৃত্য সাধারণত দলবদ্ধভাবে পরিবেশিত হয়। কারণ জীবনচক্রের গতিময় দলবদ্ধ আচরণই লোকনৃত্য বা পল্লীনৃত্যের অনুপ্রেরণা।
বাংলাদেশের লোকনৃত্য বা পল্লীনৃত্যের কোনো কোনোটিতে প্রাচীন সংস্কার, কোনোটিতে ধর্মের প্রভাব এবং কোনো কোনটিতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বেশ কয়েক ধরনের লোকনৃত্য প্রচলিত রয়েছে। যেমন -
জারি নাচ :
বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে এই নাচ ব্যাপকভাবে প্রচলিত। মহররম উপলক্ষে জারি নাচ অনুষ্ঠিত হয়। জারি গানের সাথেই জারি নাচ হয়। শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা তাজিয়া মিছিলে জারি নাচ নেচে থাকে।
সারি নাচ :
নৌকাবাইচের সময় সারি গানের সাথে সারি নাচ হয়। দু একজন নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে, ঘুরে ঘুরে গান গায় এবং নাচে। গানের তালে তালে বৈঠা চালানো হয়। গানের সাথে নাচের তেমন সম্পর্ক থাকে না।
বাউল নাচ :
বাংলার পল্লীর পথে-ঘাটে বাউল গান ও বাউল নাচ দীর্ঘকাল ধরে জনপ্রিয়তা অর্জন করে আসছে। বাউল নাচের কোনো মৌলিক উপলক্ষ নেই। বাউল গান ও নাচের মূল প্রেরণা হচ্ছে ধর্মসাধনা। বিশেষ করে গান বাউলদের সাধনারই অঙ্গ। বাউল নাচ বাউল গানের অনুষঙ্গ, তবে অপরিহার্য নয়।
লাঠি নাচ :
লাঠি নাচ সারা দেশব্যাপী প্রচলিত। লাঠি নাচে দৈহিক বল ক্ষিপ্রতার প্রয়োজন হয় বলে এতে অভিজ্ঞরাই অংশগ্রহণ করে। লাঠি নাচে লাঠিই একমাত্র উপকরণ নয়। তলোয়ার, ছোরা, থালা ইত্যাদি নিয়েও নাচ দেখানো হয়। লাঠি নাচে কোনো গান হয় না।
ঢাক নাচ:
ঢাকার মানিকগঞ্জ অঞ্চলে ঢাক নাচের প্রচলন বেশি দেখা যায়। এটা পুরুষদের যুদ্ধ নৃত্য। এ নাচের মধ্য দিয়ে সঙ্গীকে যুদ্ধে আহবান করা হয়। ঢাক নাচ পুরোপুরি সামাজিক। এতে লাঠি খেলার মতো লাঠি নিয়ে যুদ্ধের নানা দৈহিক কলাকৌশল দেখানো হয়।
ঢালি নাচ :
ঢাল নিয়ে নাচা হয় বলে এ নাচের নাম ঢালি নাচ। এটিও পুরুষের যুদ্ধ নৃত্য। ঢাল এবং লাঠি এ নাচের প্রধান উপকরণ। ঢালি নাচে কোনো গান নেই, তবে বাদ্য আছে। ঢোল এবং কাঁসির তালে তালে নাচা হয়।
পাহাড়ী নাচ-
নাচ বা নৃত্য পাহাড়ী বা চাকমা, মুরং খাসিয়া উপজাতিদের কাছে বিশেষ তাৎপর্য্যপূর্ণ। পাহাড়ী দের নাচ, নাচের বিষয় পোষাক পরিচ্ছদ নিয়ে লিখতে গেলে এত অল্পে হবেনা। তাদের নাচের বৈশিষ্টাবলী ও অতি আকর্ষনীয় তাল,লয় মুদ্রা ও নানা উপকরণের ব্যাবহার সত্যিই মনোমুগ্ধকর!
শাস্ত্রীয় নাচ ও নাচের সাজ ও এসবের মাঝে যে সুক্ষ তারতম্য রয়েছে সেসব সম্পর্কে আমার এ লেখা। ইদানীংকালে বিয়ে হলুদ বা সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে ছেলেমেয়েদের মাঝে ডিসকো, হিন্দী ম্যুভির আদলে স্টেপস শিখে নিয়ে নাচগুলো করাতেই বেশী আগ্রহ দেখা যায়। তবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বা নৃত্য শিক্ষার মাঝে যে পরম সাধনা আছে, আছে ধৈর্য্যের অবদান, নিষ্ঠা পরিশ্রম ও সাফল্যের আনন্দ তা একমাত্র সমঝদার মানুষের পক্ষেই জানা সম্ভব। নাচ বা নৃত্য শরীর ও মনে আনে আনন্দ, রাখে সুস্থ সবল। সুস্থ্য সাংস্কৃতিক চর্চা মেধা ও মননে আনে সফলতার ছোঁয়া।
কঠোর সাধনাপূর্ণ শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রসার ও মঙ্গল কামনা করি।
তথ্যাবলী- গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়ের ভারতীয় নৃত্যকলা।
লেখাটা আরজুপনি আপুনির পিচ্চুটা মানে যেই মেয়েটা আমার মত নাচ শিখতে চায় তাকে উৎসর্গ করছি।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৭ বিকাল ৩:১৯